কে এই বাবা লোকনাথ? ইতিহাস, নাকি নেহাতই মিথ?।। চিত্রদীপ সোম


সময়টা নয়ের দশকের (অনেকেই যাকে ভুল করে নব্বইয়ের দশক বলেন) একদম শুরুর দিক।  মাঝেমাঝেই হাতে আসতো রিকশ থেকে বিলি করে যাওয়া একটি প্রচারপত্র। হলুদ কাগজে লাল কালিতে লেখা শ্রী শ্রী লোকনাথ বাবা নামক একজন ধর্মগুরুর  মাহাত্ম্য। তার আগে আমার বাপ ঠাকুর্দা, আমার চোদ্দোগুষ্ঠির কেউ কোনোদিন লোকনাথ বাবার নাম শোনেনি। শুধু আমার পরিবার কেন, কোথাওই কেউ শোনেনি।  এবং আর পাঁচজন ধর্মগুরুর জীবনে ঘটে যাওয়া গল্পগুলির মতো এখানেও যথারীতি প্রচারপত্রের কাহিনীগুলি  ছিলো গাঁজাখুরি গল্পে ভরপুর। কোথায় কোন এক মন্দিরে নাকি পুজারী পুজা করার সময় এক সাপ তার সামনে এসে মনুষ্যরূপ ধারণ করে বলে আমি বাবা লোকনাথ। অমুক দিন অমুক উপাচারে আমার পুজা করবি এবং আমার নামে এই প্রচারপত্রটি ছাপিয়ে বিলি করবি। তাহলে এই এই ফল পাবি। পুজারী তাই শুনে বাবা লোকনাথের পুজা করে এবং এত হাজার (কোনো একটা সংখ্যা দেওয়া থাকতো) প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করে। এর পনেরো দিনের মধ্যে তার অমুক অমুক শুভ ফল লাভ হয়। এক মহিলা এই কথা শুনে এত হাজার ছাপিয়ে বিলি করে। তারও অমুক অমুক ফল লাভ হয়। আর এক ব্যবসায়ী এই কথা অবিশ্বাস করে এবং প্রচারপত্রটি ছিঁড়ে ফেলে দেয়। এই ঘটনার সাত দিনের মধ্যে তার ছেলে মুখে রক্ত তুলে মারা যায়  ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর পাঠকের উদ্দেশ্যে সরাসরি আবেদন জানানো হতো পাঠক যেন প্রচারপত্রটি অনুরূপ ভাবে কয়েক হাজার কপি ছাপিয়ে বিলি করেন। সুনিশ্চিত আশ্বাস দেওয়া হতো এর ফলে খুব শীঘ্র তার জীবনে ভালো কিছু ঘটবে, গল্পের পাত্রপাত্রীর মতো। আর অবজ্ঞা করলে বা অবিশ্বাস করলে? নেমে আসবে ভয়াবহ বিপদ!  (খেয়াল করে দেখবেন এই ধরনের প্রচারপত্রগুলিতে ঘটনার সুস্পষ্ট বিবরণ, জায়গায় ডিটেল ঠিকানা, পাত্রপাত্রীর সম্পুর্ন পরিচয় কিছুই দেওয়া থাকে না। যাতে কোনোভাবেই ঘটনাটি সঠিক কিনা তা নিয়ে তদন্ত করার কোনো সুযোগ না থাকে। অবশ্য তাতে এদের প্রচারের কোনো অসুবিধা হতো না। কারণ এইসব আজগুবি গল্পে বিশ্বাস করার মতো গর্দভ আগেও আমাদের দেশে প্রচুর ছিলো, এখনো প্রচুর আছে)। এবং এতে কাজও হচ্ছিলো। তার প্রমান এর পর মাঝেমাঝেই হাতে পেতে লাগলাম লোকনাথের প্রচারপত্র। সেই একই বয়ান। সেই একই আজগুবি ঘটনায় ভর্তি। প্রয়াত চিকিৎসক বাবার প্রভাবে আমি ছোটবেলা থেকে কোনোদিনই আস্তিক ছিলাম না। বাবার কথায় বুঝতে পারছিলাম মুরগি ধরার কাজটা ভালোই এগোচ্ছে লোকনাথের ভক্তের দল। বহু মানুষ এইসব গুলগল্পে বিশ্বাস করে নিজের ভাগ্য ফেরাবার আশায়, আর নয়তো স্রেফ ভয় থেকে এসব ছাপিয়ে বিলি করছে। এবং চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে প্রচারপত্র বিলির ঘটনা (একজন ভক্ত যদি হাজার তিনেক প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করেন, তাহলে যে তিন হাজার মানুষের কাছে এই প্রচারপত্র পৌছাবে তাদের মধ্যে অন্তত দশ জন যদি এই গুলগল্পে বিশ্বাস করে ফের কয়েকহাজার প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করে এবং সেই প্রতি তিন চার হাজারে যদি মাত্র দশজন করে এসবে বিশ্বাস করা ও ফের তাদের প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করার ঘটনা চলতে থাকে তাহলে অচিরেই সংখ্যাটা কোথায় পৌঁছাবে হিসাব করে দেখুন বন্ধুরা। সেই রাজা আর দাবার ঘর অনুসারে এক দানা করে চাল দেবার গল্পটা মনে আছে তো?)। তো এইভাবেই নয়ের দশকের শুরুর দিক থেকে মানুষের মনে জাঁকিয়ে বসতে লাগলো লোকনাথ বাবা নামের এক নবাগত ধর্মগুরুর শ্রদ্ধার আসন। তার আগে লোকনাথের নামও কেউ শোনে নি। ভক্তও কেউ ছিলো না। 

এবং এইখান থেকেই খটকা লাগে। লোকনাথ নামে কি আদৌ কোনো ধর্মগুরু ছিলেন?  নাকি পুরোটাই একটা বানানো চরিত্র?  ভক্তদের কথা থেকে জানা যায় লোকনাথের জন্ম নাকি ১৭৩০ সালে উত্তর চব্বিশ পরগনার কচুয়া বা মতান্তরে চাকলায়। আর মৃত্যু ১৮৯০ সালে বাংলাদেশের নারায়নগঞ্জে। অর্থাৎ ভক্তদের বিশ্বাস অনুসারে ১৬০ বছর বেঁচেছিলেন তিনি!  ভক্তরা চিরকালই একটু বাড়িয়ে বলে। ১৬০  বছর আজ অবধি পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ বাঁচেনি। সর্বাপেক্ষা দীর্ঘজীবি ব্যক্তিরই মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিলো ১৩৯ বছর। জাপানের নাগরিক ছিলেন তিনি। নামটা আমার মনে নেই। কিন্তু সেটা তর্কের বিষয় নয়। ধরে নিলাম লোকনাথ ১৬০ বছর না বাঁচলেও হয়তো দীর্ঘজীবি ছিলেন, হয়তো ৯০/১০০ বছর বেঁচেছিলেন, ভক্তির আতিশয্যে সেটাকেই ভক্তরা ১৬০ বানিয়ে দিয়েছে। বেশ ঠিক আছে। তাও নাহয় মানা গেলো। কিন্তু ইতিহাসে তো লোকনাথ বাবার অস্তিত্বেরই কোনো প্রমান পাওয়া যায় না। মনে রাখবেন ইতিহাস আর মিথ কিন্তু আলাদা। মিথ দাঁড়িয়ে থাকে কল্পনা আর বিশ্বাসের উপর, কিন্তু কট্টর প্রমান ছাড়া ইতিহাস কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না।  ইতিহাস সেই ব্যক্তির অতীত অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে যার অস্তিত্বের কোনো প্রমান পাওয়া যায়। সেই প্রমান উক্ত ব্যক্তির ব্যবহার করা কোনো জিনিসপত্র হতে পারে, ঘরবাড়ি হতে পারে, তাঁর লেখা কোনো বইপত্র হতে পারে, তার সম্পর্কে সমসাময়িক অন্যদের লেখা কোনো বইপত্র হতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এসব কোনো ধরনের কোনো প্রমান না পাওয়া গেলে শুধু জনশ্রুতি বা মানুষের বিশ্বাসের উপর ভর করে ইতিহাস কোনো ঘটনা বা ব্যক্তির অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয় না। মনে রাখবেন, আপনার ব্যক্তিগত বিশ্বাস যাই হোক, ইতিহাসের কাছে তার চার পয়সা মূল্য নেই, যদি না আপনার বিশ্বাসের পিছনে কোনো 'প্রমান' আপনি হাজির করতে পারেন। আর এই কারণেই ইতিহাস বইয়ে মহম্মদ বা বুদ্ধ বা শ্রীচৈতন্যের কথা লেখা থাকলেও শ্রীকৃষ্ণ বা রামচন্দ্রের কীর্তিকাহিনীর কোনো বিবরণ থাকে না। কারণ এরা পৌরাণিক চরিত্র, ঐতিহাসিক নন। এরা বেঁচে আছেন মানুষের বিশ্বাসে ভর করে। ইতিহাসে এদের অস্তিত্বের কোনো প্রমান পাওয়া যায় নি  তাই ইতিহাস সঙ্গত কারণেই এদের স্বীকৃতি দেয় নি। এই একই কথা প্রযোজ্য লোকনাথের ক্ষেত্রেও। সমসাময়িক পত্র পত্রিকা, বই, চিঠিপত্র, খ্যাতনামা মানুষদের আত্মজীবনি, স্বাক্ষাৎকারের বিবরণ, কোথাও তার কোনো উল্লেখ নেই। পুরো ভ্যানিশ তিনি। ১৯৮০/৯০ সালের আগে তাকে নিয়ে কোথাও একটা লাইনও লেখা হয় নি। কেউ দেখাতে পারবেন না। তিনি ঐতিহাসিক চরিত্র হলে যা হওয়াটা স্বাভাবিক ছিলো। তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র বলে যেগুলো দাবী করে তার ভক্তরা সেসব দাবীরও কোনো ঐতিহাসিক সারবত্তা নেই। কোনো ঐতিহাসিক আজ অবধি সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সেগুলোর প্রাচীনত্ব নিরুপন করেন নি বা সেগুলো লোকনাথেরই ব্যবহার করা জিনিস বলে রায় দেন নি। অর্থাৎ সোজাকথায় নূন্যতম এমন কোনো প্রমান আজ অবধি ভক্তরা হাজির করতে পারেন নি যা থেকে প্রমানিত হয় তিনি সত্যিই ছিলেন। তাই খুব সুস্পষ্টভাবেই বলা যায়, লোকনাথ বলে কেউ কোনোদিনই ছিলো না, স্রেফ একটা কাল্পনিক চরিত্রকে ব্যবসায়িক স্বার্থে গড়ে তোলা হয়েছে। আর কিচ্ছু নয়। 

       অন্যদিকে আরো একটা অ্যাঙ্গেল থেকেও ব্যাপারটা ভেবে দেখুন। যদি লোকনাথ বলে সত্যিই কেউ থেকে থাকেন এবং ১৭৩০ থেকে ১৮৯০ যদি তার সময়সীমা হয় তার মানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের একদম শুরুর দিক থেকে মাঝের দিকের লোক তিনি। তিনি চোখের সামনে দেখেছেন ব্রিটিশদের একটু একটু করে ভারতভূমি দখল করা। দেখেছেন বল্গাহীন ব্রিটিশ শোষন, সীমাহীন অত্যাচার আর অকল্পনীয় সম্পদ লুন্ঠন।  দেখেছেন কিভাবে ভারতকে সম্পদশালী একটি দেশ থেকে মাত্র পঞ্চাশ বছরে ভিখারীতে পরিণত করছে ব্রিটিশরা। অথচ এই পুরো সময়টায় তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। কেন?  কিসের স্বার্থে?  কার তাঁবেদারি করতে গিয়ে?  কোথায় ছিলো তার অলৌকিক ক্ষমতা তখন?  কোথায় ছিলেন যখন ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে অন্যায় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এক কিশোর নবাবের পরাজয়ের মাধ্যমে বিকিয়ে যাচ্ছিলো বাংলার সার্বভৌমত্ব?  কোথায় ছিলেন যখন ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে বাংলাকে লুন্ঠনের রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছিলো ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাতে? কোথায় ছিলেন যখন ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষে খাবারের অভাবে কুকুর বিড়াল মেরে খাচ্ছিলো অসহায় মানুষ, শূন্য হয়ে যাচ্ছিলো হাজার হাজার জনপদ, মা বিক্রি করছিলো মেয়েকে, স্বামী তার স্ত্রীকে, যখন খাদ্যাভাবে মারা গিয়েছিলো সরকারী হিসেবেই প্রায় দুই লক্ষ মানুষ?  কি করছিলেন, যখন ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে আপামর ভারতবাসী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলো ব্রিটিশ প্রভুদের বিরুদ্ধে?  শুরু করেছিলো মরণপন লড়াই?  কোন গর্তে মুখ লুকিয়েছিলেন তখন? কেউ তার টিকিটিও দেখতে পায় নি কেন?  কোথায় ছিলো তার অলৌকিক ক্ষমতা, যখন ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৯-৬০ সালের নীল বিদ্রোহ, ১৮৭৫ সালের দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ চলেছিলো?  কেন তার অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়ান নি তিনি? এই সমগ্র সময়পর্বে যিনি নিশ্চুপ থাকেন, যিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েও দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনে সেই ক্ষমতা কাজে লাগান না, দেশের মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার দেখেও যিনি চুপ থাকেন, দেশের সম্পদ শোষণ যার মনে কোনো দাগ কাটে না,  কেন তাকে 'ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল' তথা সরাসরি 'দেশদ্রোহী' বলে আখ্যা দেওয়া হবে না? শুধু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই নয়, তৎকালীন ভারতে যে সমস্ত কুপ্রথাগুলি ছিলো, যেমন সতীদাহ প্রথা, বহুবিবাহ প্রথা, মহিলাদের শিক্ষার সুযোগ না থাকা, শূদ্রদের  গ্রামের কুয়ো থেকে জল নিতে না দেওয়া,  ইত্যাদির বিরুদ্ধেও কেন তিনি সোচ্চার হন নি?  কিসের ভয়ে বা কিসের লোভে মুখ লুকিয়ে বসেছিলেন? 

আসলে লোকনাথ একটি কাল্পনিক চরিত্রমাত্রই। মানুষের নিজের কল্পনায় তৈরী করা একটি চরিত্র। আর এই কুসংস্কারকে ঘিরে আজ তৈরি হয়েছে ব্যবসার এক বিপুল ক্ষেত্র। বহু লোকের করেকম্মে খাবার মাধ্যম আজ লোকনাথবাবা।  কচুয়া আর চাকলা দুটিতেই শত শত ভক্তের আগমন লেগেই থাকে রোজ। বিশেষ বিশেষ দিনে যা লক্ষের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। রমরম করে ফুল বেলপাতা, মিষ্টি বিক্রী করে স্থানীয় দোকানগুলি। ভক্ত সমাগম বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাবার মন্দিরের চাকচিক্য ও সাইজ। বেড়েছে অনান্য ব্যবসাও। কুড়ি বছরের মধ্যে কয়েক হাজার টাকা বিঘে থেকে জমির দাম পৌঁছেছে কাঠা প্রতি প্রায় কোটি টাকায়! আর এভাবেই কল্পকাহিনী আর ব্যবসা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দিনের শেষে ঘর্মাক্ত, শোষিত জনগনের হাতে পড়ে রয়েছে শুধু পেন্সিলটুকুই, যেমনটা গত কয়েক হাজার বছর ধরেই ছিলো...!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

নামহীন বলেছেন…
faltu article. gaar pakami.
নামহীন বলেছেন…
Baler article tui gajakhuri

asole iswar manis na ati murkho tui khankir chele toke kelano uchit Hindu somajer kolonko tui
নামহীন বলেছেন…
TOR JODI PROCHAR PAOAR ICCHA THAKE TAHOLE ULONGO HOYE RASTAY GHURE BERA PRACHAR PABI VIRAL O HOBE . AAR HA TOR BABA AR CHODDO GUSTI KI ORIGINALLY MANUS CHHILO ? NAKI SETAO GOLPO KAHINI ? TOR BABA NAKI DOCTOR CHHILO TAHOLE KI PORASHUNA KORE DOCTOR NAKI JALI MAL ? AAR HISTORY TUI KI JANIS ? PORASHUNA KOR JANTE PARBI ---- JIBON BHOR GADHA HOYE THEKE LABH NEI.. BEST OF LUCK FOR YOUR FUTURE GADHA...