সবার_উপরে_মনুষ্যত্ব।। প্রতীতি_চৌধুরী।


তখন সদ্য কলেজ পাশ করে চাকুরীতে যোগ দিয়েছি। বাড়ি থেকে প্রায় বিয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরের একটা অখ্যাত গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। কম্পিউটার স্ক্রিনে যখন প্রথম ভেসে উঠেছিল 'এমপেনেল্ড' শব্দটা, তখন খুশির চোটে আর কিছু চোখে পড়েনি। অনেক পরে বাকি সব ডিটেলস দেখি। কোনো এক হরিমায়াপুর পোষ্ট অফিসের নারকেলভাঙ্গা গ্রামে। এরকম অদ্ভুত নামের গ্রাম যে আমাদের জেলাতে আছে সেটা ভেবেই বড়ো আশ্চর্য লাগছিল। পরে অবশ্য অনেককে সেই আশ্চর্য লাগার কথা বলতে তারা মাথাভাঙ্গা, ঢোলকমুন্ডু, নরকডাঙ্গা ইত্যাদি আরো কিছু বিদঘুটে জায়গার নামও আমাকে শুনিয়েছিল। সে যাইহোক ছোটোর থেকে শহরে বড়ো হওয়ার কারনে গ্রাম সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা নিতান্তই বড়ো স্বল্প ছিল। তাই প্রথমদিন যখন স্কুলটা দেখতে যাবো বলে বাস স্ট্যান্ডে অনেক খোঁজ খবর নিয়ে বাসে চাপলাম আর বাসের কন্ডাক্টরের ইন্সট্রাকশন ফলো করে বাস থেকে নেমে আরো পাঁচশো মিটার হেঁটে স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছলাম তখন আরো নানান বিষয় প্রত্যক্ষ করে বড়ো আশ্চর্য হলাম।
হ্যাঁ, নামটা ওই নারকেলভাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় বলেই লেখা ছিল। কিন্তু ধারে পাশে জনবসতি চোখে পড়েনি। শুধু গুটি কয়েক ছাগল স্কুল বাড়ির পিলারে বাঁধা স্কুল আঙ্গিনাতে চরছিল আর একটা মাঝবয়সী লোক বট গাছের তলাতে পিঁপড়ে, পোকা উপেক্ষা করেই শুধুমাত্র একটা গামছার উপরে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। লোকটির নাসিকা গর্জনহেতু লোকটির ঘুম ভাঙ্গাতে ইতস্তত করে পুরো স্কুলটার চারপাশ ভালো করে ঘুরে দেখছিলাম আমি। দুটি রুমের রঙচটে, প্লাস্টার খসা দেওয়াল আর পাশে একটি আধভাঙ্গা দরজার বাথরুম ঘর দেখে একবার ভাবলাম হয়তো পুরোনো স্কুল বিল্ডিং এ এসে পড়েছি, নতুনটা কাছে পিঠেই কোথাও আছে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাত আর ডালের শুকনো অবশিষ্টাংশ দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না সকালের দিকে এখানে রান্না খাওয়া হয়েছে। প্রাইমারি স্কুলে চাকুরি করতে এসে মিড ডে মিল স্কিমের কথা তো আর অজানা থাকতে পারেনা। পাশাপাশি কাউকে ডেকে স্কুলটা কখন খুলেছিল জিজ্ঞাসা করবো বলে ভাবছিলাম। কিন্তু বেলা প্রায় বারোটার সময় জ্যোষ্ঠের প্রখর রোদে মাঠে কয়েকটা গরু ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাইনি। তবে ইতিমধ্যে একটা সুবিধা হয়েছিল, আমারই চলা ফেরার শব্দে ওই নাসিকাগর্জনকৃত ভদ্রলোক ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসেছিলেন। আধখোঁচা কাঁচা পাকা দাড়ির, শীর্ণকায় চেহারার ভদ্রলোককে যখন জিজ্ঞাসা করলাম,
-"কাকু স্কুলে কেউ নেই?"
তখন আমার মুখের দিকে খানিক হাঁ করে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিয়েছিলেন,
-"ইস্কুল তো মাষ্টার সক্কালেই খুলেছিল.. এখন সকাল ইস্কুল তো.."
বলতেই অবশ্য খেয়াল হয়েছিল আমার, গ্রীষ্মকালে ছোটোবেলায় আমার নিজের স্কুলও তো মর্নিং হতো। ভাবলাম এতোদূর এসে কষ্ট করে ঘুরে যাবো! তার চেয়ে যদি স্কুলের কোনো লোকাল টিচার থেকে থাকে, দেখা করে কথা বলতে পারতাম জয়েনিং এর ব্যাপারে। তাই পুনরায় ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
-"এখানের কেউ লোকাল টিচার নেই..? মানে কাছাকাছি বাড়ি?"
লোকটা মনে হয় আমার কথাটা বুঝতে না পেরেই কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞাসা করেছিল,
-"কার বাড়ি?"
আমি একটু বুঝিয়েই বললাম,
-"আপনাদের স্কুলের কোনো মাষ্টারের বাড়ি নেই কাছাকাছি?"
লোকটা এবার ঠিকঠাক করেই বলেছিল,
-"মাষ্টার তো মোটে একজনই। ওই বেনেদের। পাশের গাঁয়েই বাড়ি। তবে হেঁটে আধঘন্টা তো লাগবেই।" এসব কথা বলতে বলতেই আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম লোকটা আমার সম্পর্কেও বেশ কৌতূহলী। তবে উনি এমন কিছু প্রশ্ন করবেন সেটা আমি বুঝতে পারিনি। উনি হঠাৎ করেই বলেছিলেন,
-"তুমি কাদের ঘরের?"
প্রথম পরিচয়ে ভদ্রলোক আমার নাম, কি জন্য এসেছি, কোথা থেকে এসেছি এসব জানতে চাইতে পারেন ভাবছিলাম। কিন্তু "কাদের ঘরের!" এ কেমন প্রশ্ন তা বুঝার মতো ক্ষমতা থাকেনি। আমি ভালো ভাবেই বললাম,
-"এই স্কুলে মাষ্টারি পেয়েছি.. তাই অনেক দূর থেকে আসছি।"
লোকটার যেন এসবে তেমন একটা আগ্রহ নেই। পুনরায় একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল আমাকে,
-"ওহ.. সে হলো.. কিন্তু কাদের ঘরের!"
মনে মনে ভাবলাম আচ্ছা মুশকিলে পড়লাম তো! কোনো রকম নামের সাথে সারনেম পর্যন্ত বলে সেখান  থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। যদিও 'চৌধুরী' সারনেম শুনে উনি খুব একটা সন্তুষ্ট থাকেননি। চৌধুরী পদবীতে যে উচ্চবিত্ত ব্রাক্ষ্মন থেকে কায়স্ত জমিদার, সদগোপ, গয়লা, এমনকি মুসলিম পর্যন্ত হতে পারি সেটা অনুমান করেই উনি নাক সিঁটকিয়ে ছিলেন। গ্রামের মানুষের কাস্ট কনশাসনেসটা বুঝতে আমার আরেকটু সময় লেগেছিল। মানে ওই স্কুলের হেডমাষ্টারের ঘরে গিয়ে ওনার মুখেও একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি শোনা পর্যন্ত।
আমার হাতে ছিল একটা ফাইল আর ফাইলে ছিল কম্পিউটারাইজড নিয়োগপত্র। আর তাতে কাষ্ট উল্লেখ থাকেনি। তাই সেই প্রধান শিক্ষক ঘরের সামনে যখন ধান ঝাড়া মেশিনটা বন্ধ করে এসে, লুঙ্গির ভাঁজটা খুলে, লুঙ্গিটা নামিয়ে আমার সেই কম্পিউটার প্রিন্টেড পেপারটা মনোযোগ সহকারে পড়েছিলেন তখন তিনি আমার পদবী ছাড়া আমার সম্পর্কে আর কিছু জানতে পারেননি। আমার পরনে ছিল খুব সাধারণ একটা হালকা রঙের সূতির চুড়িদার। আর প্রখর রোদের কারনেই আমি মাথাটা ঢাকা দিয়ে রেখেছিলাম চুড়িদারের সাদা ওড়নাটা দিয়ে। গালের দুপাশে তখনও ঘাম গড়াচ্ছে, দু কিলোমিটার হেঁটে ভীষণই ক্লান্ত। ভেবেছিলাম আমি ওনার এসিস্টেন্ট টিচার শুনেই হয়তো জল টল অফার করবেন, বাড়িতে ঢুকে পাখার তলায় বসতে বলবেন। কিন্তু উনি সেসবের ধার দিয়েও গেলেন না। উলটে ওনার বাড়ির সামনে রাখা দড়ির খাটটাতে আমি নিজে থেকেই যখন বসতে গেলাম উনি আমাকে প্রায় থামিয়ে দিয়েই বললেন,
-"অনেকটাই ছোটো তুমি... তাই তুমি করেই বলছি.. আমার স্কুলে তো একজন বামুনদের দিদিমনি আছেন.. তাছাড়া মাত্র একচল্লিশজন স্টুডেন্ট, আর তো কোনো টিচার নিয়োগ করার কথা নয়.. মানে ভ্যাকেন্সি নেই আর কি!"
আমি সেদিন পর্যন্ত জানতাম কাজ ভাগ করে নেওয়ার লোক এলে মানুষ খুশিই হয়। কিন্তু উনি এমন ভাবে কথাটা বললেন যেন আমি ওনার বেতনে ভাগ বসাতে এসেছি। এতোদূর থেকে রোদে পুড়ে এতোটা হেঁটে আসার পর ওনার এরকম কথাটা শুনে মাথাটা যেন আরো গরম হয়ে গেল। তবুও যে স্কুলে জয়েন করতে চলেছি উনি সেই স্কুলেরই মাথা ভেবে নিজেকে শান্ত করে বলেছিলাম,
-"সরকারী ভাবে নিয়োগ করেছে, এই স্কুলেরই তো নাম দিয়েছে, দেখুন..."
উনি আমার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ মাথা নাড়ার পর সেই প্রশ্নটা করেই ফেলেছিলেন অবশেষে,
-"চৌধুরী মানে কি ব্রাক্ষ্মন না....!"
আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য না হয়ে উপায় থাকেনি আমার। গ্রামের সাধারণ নিরক্ষর মানুষ, যারা গরু, ছাগল চরায় তারা হয়তো শিক্ষার অভাব থেকে এসব নিয়ে ভাবতে পারে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর একজন শিক্ষক হয়েও যে এসব জাতপাত নিয়ে উনি পড়ে আছেন সেটা ভেবেই কান পর্যন্ত লাল হয়ে উঠেছিল আমার। ইচ্ছা করেছিল জিজ্ঞাসা করতে আপনি কি কাষ্ট অনুসারে শিক্ষা দেন ছাত্রদের! কিন্তু ওনার বয়স আর মর্যাদার কারনেই সেদিন হয়তো বলতে পারিনি কিছু। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলাম,
-"না ব্রাক্ষণ নই, তবে হিন্দু... মানে সদগোপ.."
সেদিন আমি দুটো জিনিস বুঝতে পেরেছিলাম। এক, গ্রামের মানুষ জাত না জেনে ঘরে ঢুকোনো, জল খাওয়ানো তো দূর, কথাও বলতে চায় না। আর দুই, আমার ওই রোদের কারনে বিশেষ ভাবে ওড়না নেওয়ার ধরণেই ওনাদের সবাই হয়তো আমাকে মুসলিম ভেবে ভুল করেছে।
অবশ্য ভুলটা ঠিক ওদের না, ভুলটা আমারই। ছোটো থেকে শহরের যে পাড়াতে থাকতাম তার অর্ধেক ঘর হিন্দু, অর্ধেক মুসলিম। কোনোদিন কোনো ছুঁতমার্গ থাকেনি আমার মধ্যে। স্কুলে মুসলিম বান্ধবী ইয়াসমিনের সাথে টিফিন ভাগ করে খাওয়ার জন্য বাবা মায়ের কাছে আলাদা করে পারমিশন নিতে হয়নি। বরং বাবার এক মুসলিম বন্ধু মহসিন কাকুকে অনেকবার আমার ঘর আসতে দেখেছি। মায়ের হাতের মিষ্টি চায়ের প্রশংসা করতে শুনেছি। আমি অবশ্য ওনাকে ছোটোর থেকেই ক্যাডবেরি কাকু বলে ডাকতাম। আমার জন্য ভালো ভালো ক্যাডবেরি আনতেন কি না! ছোটো থেকেই মায়ের সাথে অনেকবার গেছি কুরবান বাবার মসজিদে। হিন্দু ধর্মের মতোই ওখানেও পূজো দিতাম পাটালি দিয়ে। তাই আলাদা করে মনের মধ্যে কোনো জাত নিয়ে ভাব তৈরি হওয়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু বোঝা উচিৎ ছিল আমার। আমি কর্মসূত্রে যেখানে যাচ্ছি সেটা আমার প্রাণের শহরটা নয়। সেখানে এখানের মতো হিন্দুরা মসজিদে যায় না, মুসলিমরা চার্চে গিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে আসে না, খ্রীষ্টানরা দূর্গা পূজোতে দূর্গা মায়ের সামনে সেলফি তোলে না। তবে সেদিনের পর থেকে জাতপাত নিয়ে ওই গ্রামের মানুষদের মনোভাব বুঝতে খুব একটা আর অসুবিধা হতো না আমার। হয়তো নিজের সেফটির জন্যই অন্তত ওখানে গিয়ে ওই ভাবে ওড়নাটা মাথাতে দিতাম না আর।

****

আস্তে আস্তে গ্রাম্য জীবন, গ্রাম্য মানুষের সাথে পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করেছিলাম। যদিও আমার উপর ওখানের মানুষের অভিযোগ এবং আগ্রহের অন্ত ছিল না। অনেকেই বলতো স্কুলের দিদিমণি শাড়ি কেন পরে আসবে না! কিছু মানুষকে বুঝিয়ে শান্ত করা হতো যে অনেক দূর থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করি, জলে কাদায় নানা রকম সমস্যা হয়। কেউ কেউ আবার এসে অভিযোগ করতো চুলে বিনুনি নেই কেন! ডে স্কুল শুরু হওয়ার পর যাত্রী প্রতিক্ষালয়ে প্রায়ই বসে থাকতে হতো ঘন্টার পর ঘন্টা। কয়েকটা মাত্র বাস ছিল ওই কর্ড রুটে। যাত্রী প্রতিক্ষালয়টাও ছিল বেশ শুনশান। দুয়েকটা বড়ো গাছ ছাড়া আর তেমন কিছুই থাকেনি ওখানে। বেশিরভাগ দিনই ওই স্টপেজ থেকে বাসের অপেক্ষায় একমাত্র যাত্রী থাকতাম আমি। হয়তো কেউ কেউ সেটা লক্ষ্য করেই বলতো, "দিদিমনি ভর্তি দুপুরবেলা একলা বসে থাকে... খোলা চুলে ভুতে টুতে ধরেছে মনে হয়.."
দেখতাম গ্রামের মানুষ নিজে পরের বেলা কি খাবে সেটা চিন্তা না করে অন্য কেউ কি খাচ্ছে সেটা সমালোচনা করতেই বেশি ভালোবাসে। এরকম সংস্কারকে আত্মস্থ করা কোনোদিনই আমার পক্ষে সম্ভব থাকেনি, তবে চাকুরী রক্ষার্থে গা সওয়া করে নিতে হয়েছিল অনেক কিছুই।
বেশিরভাগ দিনই স্কুলে টিফিনের জন্য মা পাঠিয়ে দিত জ্যাম-পাউরুটি বা চাউমিন। খুব সক্কালে ভাত খেয়ে স্কুল আসার পর ওটাই ছিল আমার লাঞ্চ। ফিরতে প্রায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যেত। প্রতিদিন যখন স্কুলে বসে টিফিন করতাম তখনও হেড মাষ্টার আর ওই বামুন দিদিমণির কাছে শুনতে পেতাম অনেক মানুষের সমালোচনা। যেটাকে চলতি ভাষাতে পরনিন্দা, পরচর্চা বলে আর কি! হেড মাষ্টার মশাই টিফিন আনতেন না, তবে দিদিমণির কাছ থেকে পরোটা, তড়কা, আপেল সবই খেতেন। আমিও বেশ কয়েকবার অফার করেছিলাম হেডমাষ্টার মশাইকে, মনে হয় আমি ব্রাক্ষ্মণ না হওয়াতে উনি সেই তৃপ্তি নিয়ে আমার টিফিন খেতে পারতেন না। বেশ কয়েকদিন না করে দেওয়ার পর আমারও ভালো লাগতো না ওদের টিফিন ভাগাভাগি করে খাওয়া দেখতে। বরং মনে পড়ে যেত ছোটো বেলায় একসাথে বন্ধুদের সাথে বড়ো টিফিন বক্সে কেমন মুড়ি মেখে খেতাম! একদিন ওদের সমালোচনা থেকে একটু দূরে ইচ্ছা করেই টিফিন খেতে বসলাম। দেখলাম বাচ্চাগুলোর ততক্ষণে মিড ডে মিল খাওয়া হয়ে গেছে। তবুও ওদেরকে একটুকরো করে জ্যাম পাউরুটি, কলা অফার করলাম। ওরা ফূর্তি করে আমার পাশে বসে খেতে শুরু করলো। তারপর প্রায় দিনই এরকম মজা করেই টিফিন খেতাম। ওদের মধ্যে কার যে কি কাষ্ট ছিল আমি জানতাম না... আর জানবার চেষ্টাও করিনি। তবে জানতে পেরেছিলাম একদিন যখন ওদের মধ্যেই একজনের গার্জেন এসে বলে আমার ছেলে এখানে পড়ে.. "আমরা আচার্য", "কুলিন ব্রাক্ষ্মণ" ইত্যাদি। সাথে এটাও বলে "দুলে, বাউরী ওদের সাথেই তো এখন খেতে, পড়তে হচ্ছে আমাদের ছেলেকেও"। ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করি একদম ছোটোবেলাতেই জাতপাতের বীজটা কতো গভীরে স্থাপন করে দেয় বাবা মা। যেটা বড়ো হয়ে মহীরুহ ধারণ করে। আর তখন উৎপাটন করা আরো কঠিন হয়ে যায়। তবে এসব থেকে নিজেকে যতটা সরিয়ে রাখা যায়, যতটা স্বতন্ত্র রাখা যায়, তারই প্রতিনিয়ত চেষ্টা করতাম আমি।
কিন্তু আমার একার চেষ্টাতে যে সফল হওয়া যায় না, সেটাও বেশ বুঝতাম। খুব খারাপ লাগতো যখন রাঁধুনিরা এসে বলতো, "মাষ্টার মশাই তরকারিটা একটু খেয়ে দেখুন", আর হেড মাষ্টার মশাই ওই নিচু জাত, ছুঁতমার্গের কারণে কোনোদিনই সেটা খেয়ে দেখতেন না। এমনকি স্কুলে মাংস হলে, আলাদা করে মাংস কিনে এনে স্কুলের দিদিমণিকে দিয়ে রান্না করাতেন স্কুলের আলাদা স্টোভে। বাউরী আর বামুনের হাতের রান্নার স্বাদের পার্থক্যটা বোধহয় উনিই ভালো বুঝতে পারতেন। আমার খারাপ লাগলেও বলার অধিকার সীমিত ছিল। একে তো জুনিয়ার টিচার, তারপর আবার রান্নার 'র' টুকুও জানিনা।
তার মাঝেই একদিন খবর পেলাম, কাছেই না কি কোথায় একটা মুসলিম গ্রাম আছে হিঞ্জুল বলে, সেখানের মানুষের সাথে একজন হিন্দু শিক্ষকের খুব বাক বিতন্ডা হয়েছে। সেই শিক্ষক আর মোটেও ওই গ্রামে শিক্ষকতা করতে চাননা, সেই মর্মে চিঠিও দিয়েছেন আমাদের স্কুলের পরিদর্শক অফিসে। আগেই বলেছি আমি ছিলাম আমার স্কুলের বাড়তি টিচার। অতএব আমাকে ওই স্কুলে দেওয়ার সম্ভাবনার কথাটা অন্যান্য শিক্ষক মারফৎ কানে এলো। সাথে কিছুটা ভীতিও আমার মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। একে মেয়েছেলে, তারপর অবিবাহিত, বাস রাস্তা থেকে প্রায় দুই কিমি ভিতরে, তাই ওই রকম মুসলিম গ্রামে গিয়ে পড়লে আমার না কি আর শিক্ষকতা করাই হবে না। ততদিনে মোটামুটি যেই স্কুলে শিক্ষকতা করি, সেই স্কুলের বাচ্চাগুলোর সাথেও বেশ পরিচয় হয়ে গেছে, ওদের ঘরের নানান গল্প টল্পও শুনি। আর ওদের কাছেই শুনতাম কিভাবে কারু গরু, ছাগল হারিয়ে গেলে অবধারিত ভাবে ওরা ধরে নিত ওই হিঞ্জুলেরই কারো কাজ। এমনকি সন্ধ্যের পর ওই রাস্তায় হরিমায়াপুর বা নারকেলডাঙ্গার মানুষরা কেউ ভুলেও যেত না। আর গেলেও শুধু অন্তর্বাস পরেই ফেরৎ আসতো, বাকি না কি সব লুট হয়ে যেত। সুতরাং ভয় যেন ক্রমশ আমার মধ্যেও দানা বাঁধতে শুরু করেছিল তখন। যতই আমি নিজের শহরে কবি নজরুলের কথা মতো, "মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম, হিন্দু মুসলমান" হয়ে থাকি, এখানের অজানা জায়গা, অচেনা মানুষের ভিড়ে যা শুনি, তা বিশ্বাস না করতে চাইলেও ভীতি তৈরি হয় হৃদয়ে। তারপর টিভিতে রোজগার খবর তো রয়েছেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আতঙ্কবাদ, ইত্যাদির। সবে মিলে কেমনই যেন বুকের ভিতর ভয় জমতে করেছিল মুসলিমদের নিয়ে। পাছে ওই হিঞ্জুলের স্কুলেই গিয়ে পড়তে হয় আমাকে, যেখানে কি না কোনো হিন্দু শিক্ষক টিকতেই পারছে না!
তারই মধ্যে কি ভাবে এলো অন্য সার্কেল থেকে একটা মিউচুয়াল ট্রান্সফারের অফার, আমার তরফ থেকে সেভাবে কিছু সুবিধা না হলেও কিছুটা এই ভীতির কারণেই এপ্লাই করে দিলাম। তার সাথে এই গাঁয়ের মানুষদের নানান রকম আবদার, আগ্রহ থেকে বাঁচার জন্যও বটে। যখন থেকে গ্রামে জেনেছিল কোনো অবিবাহিতা সদগোপ মেয়ে নারকেলভাঙ্গা স্কুলে জয়েন করেছে, তখন থেকে নিত্যদিন পালি করে পাশের কোনো সদগোপ গ্রাম থেকে সম্বন্ধ আসাও শুরু হয়েছিল। তার সাথে স্কুলের হেড মাষ্টারমশাই বা দিদিমণির ওই অন্যের সমালোচনা, জাতপাতের সংস্কার এসবেও আমি বিরক্ত ছিলাম। আর ওদের দলের না হওয়াতে ওদেরও আমাকে পছন্দ ছিল না। তাই ওই সবে মিলে পালিয়ে বাঁচা আর কি!

****

ট্রান্সফার হওয়াটা অবশ্য যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ ছিল। তার আগেই একদিন বাসে করে বাড়ি ফেরার সময় একজন শিক্ষকের কাছে বিস্তারিত শুনলাম। উনি না কি হিঞ্জুলে বদলীর জন্য আমার স্পেশাল অর্ডার অফিসে তৈরি হতে দেখে এসেছেন। তবে গোপন সূত্রের খবর, তাই ওনার নাম কাউকে জানাতে বারণ করলেন। এদিকে পরের দিন জেলার শিক্ষা দপ্তরে খবর নিয়ে জানলাম আমার সেই মিউচুয়াল ট্রান্সফার রেডি হতে বেশ দেরী আছে। একে নতুন চাকুরী, তারপর সবাই অচেনা, বয়স কম হওয়ার কারণে অভিজ্ঞতাও কম। আবার আমার রোগা পিটপিটে চেহারা দেখে কেউ শিক্ষিকা বলে যেই সম্মান দেওয়ার কথা, সেটুকুও দিত না। তাই এরকম অবস্থায় সেই কুখ্যাত হিঞ্জুলে গিয়ে পড়লে কি অবস্থা হবে, সেটা মনে করলেই কাঁপুনি শুরু হয়ে যেত। ভাবতাম শেষমেশ কি তবে চাকুরিটাই ছাড়তে হবে না কি! কয়েকটা মানুষ, পরিস্থিতি, একটা গ্রামের নাম কিভাবে একটা জাতি, একটা ধর্মের প্রতি আমার মনে ভীতি সঞ্চার করেছিল আজও তার সাক্ষী আমি নিজেই। অথচ এই আমিই ওখানে যাওয়ার আগে পর্যন্ত না জাতপাত নিয়ে কখনো ভেবেছিলাম, না মানুষে মানুষে বিভেদ করেছিলাম। বরং কেউ সেরকম করলে তাকে বুঝাবার চেষ্টা করতাম যে প্রতিটা মানুষ সমান, প্রত্যেকের শরীরেই লোহিত রক্ত বইছে।

****

দেখতে দেখতে এলো প্রবল বর্ষার দিন। যেদিনের কথা বলতে যাচ্ছি শুধু সেদিন নয়, তার আগের দুদিনও নিম্নচাপের জন্য সূর্য উঠেনি। বাসে যেতে যেতেও দেখছিলাম রাস্তার একদিকে গ্রামগুলোতে ক্ষেত আর রাস্তা অথৈ জলে মিলেমিশে প্রায় এক হয়ে গেছে। রাস্তার অন্যদিকে বয়ে গেছে নদী। নদীর জলের দিকে তাকালে আর গর্জন শুনলেই মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা। তারপর সেই হিঞ্জুলিতে বদলীর ভয়টা তো চেপেই আছে মাথার উপর। তবুও ছুটি পাবার উপায় নেই। নতুন চাকুরির একবছর না হলে তেমন ভাবে কোনো ছুটি পাওয়া যাবেনা বলেই জানিয়েছিলেন আমাদের প্রধান শিক্ষক এবং বিদ্যালয় পরিদর্শক। অতএব ঝড়ো হাওয়া, জল, কাদা উপেক্ষা করেই স্কুল করলাম কোনো রকম। ছেলে মেয়েও বিশেষ আসেনি সেদিন, তবুও কোনো রকম মিড ডে মিল খাইয়ে টিফিন পর্যন্ত ছেলেমেয়েগুলোকে রাখার পর হেডমাষ্টার মশাই স্কুল ছুটি দিয়ে, স্কুলে তালা চাবি দিয়ে ঘর চলে গেলেন। উনি বাইকে আসতেন, তাছাড়া আগেই বলেছি ওনার বাড়ি, স্কুল থেকে দু কিলোমিটারের বেশি নয়। সমস্যাটা হলো আমার। স্কুল থেকে পাঁচশো মিটার ছাতা মাথায় হেঁটে এসে সেই জনমানবহীন প্রতিক্ষালয়ে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে সবে আড়াইটে। যদিও বেলা দেখে বোঝার উপায় নেই কটা বাজে! আমার বাস ছিল দুটো পঁয়তাল্লিশের দিকে। তাই টিফিনটা তাড়াতাড়ি করে নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম বাসের জন্য। কিন্তু যখন প্রায় তিনটে বেজে গেল, তখন ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো আমার। ফোনটা ব্যাগ থেকে বার করে ফোন করলাম বাসের ড্রাইভারকে। তখন অবশ্য স্মার্ট ফোন মার্কেটে আসেনি, আর এলেও সদ্য পাওয়া চাকুরীতে স্মার্টফোন কেনার মতো ক্ষমতা থাকেনি। ছিল একটা নোকিয়া কিপেড ফোন, তাও ফোন করতে গিয়ে দেখলাম ব্যাটারি লেভেল লাস্ট পরশেনে। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে গত রাত্রি থেকে আমার বাড়িতেও লাইন না থাকায় ফোন চার্জ করতে পারিনি। তো ড্রাইভার সাহেবকে ফোন করতেই উনি জানালেন কোথায় না কি ব্রিজ ভেঙ্গে গেছে তাই বাস চললেও উনি আজ আর ফিরতে পারবেন না। শুনেই মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা। একে এরকম দুর্যোগের দিন, তারপর বাসটাও নেই। সাড়ে তিনটেই ছিল বাড়ি ফেরার শেষ বাস। তার আগেই মেঘের ছায়া এতো অন্ধকার করে এলো যে মনে হচ্ছিল এখনই সন্ধ্যে নেমে যাবে। ধৈর্য ধরতে না পেরে শেষ বাসের কন্ডাকটরকে ফোন করলাম প্রায় মরিয়া হয়ে, উত্তর এলো আজ না কি ওনাদের বাস চলেইনি। সাথে একটু ফ্রিতে জ্ঞানও পেলাম, "এতো দুর্যোগে কেউ স্কুল আসে!" ফোনটা যতক্ষণে রাখলাম আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। যে কোনো সময় ফোনটা সুইচ অফ হয়ে যাবে বলে দুবার সাইরেন দিতেই কিছুটা বিরক্ত হয়ে, কিছুটা শেষ চার্জের ফোঁটাটুকু সংরক্ষিত করার জন্য নিজে থেকেই ফোনটা সুইচ অফ করে দিলাম। ভাবলাম এখানে তো সেইভাবে চেনাও কেউ নেই। কার কাছেই বা সাহায্য চাইবো! এদিকে সন্ধ্যার পর লুটের ভয়, ডাকাতের ভয় ভেবেই গা হিম হয়ে এলো। যদিও পার্সে গুণে গুণে দুশো টাকা, হাতের আংটিটা, আর ওই ছোট্ট মোবাইলটা ছাড়া আমার কাছে তেমন কিছুই লুট করার মতো ছিল না, তাও এরকম বৃষ্টি ভেজা বর্ষার ঠান্ডা বিকেলেও ভয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম দিতে শুরু করলো। ঘরের নিশ্চিন্ত নরম বিছানা আর বাবা মায়ের মুখগুলো মনে করে যেন কান্না পেয়ে গেল। ভাবলাম আদৌ আর কখনো ঘর ফিরতে পারবো তো! অন্য দিন যদিও দুয়েকটা গবাদি পশুকে মাঠে চরতে বা কোনো মানুষকে ক্ষেতে কাজ করতে দেখতে পেতাম, সেদিন সেটুকুও থাকেনি। ছোটো বড়ো বালি ট্রাকগুলো ছাড়া আর কোনো কিছুই ওই রাস্তা দিয়ে পেরোবার ছিল না। রাস্তার পাশ দিয়ে নদীটা বয়ে গেছল আর নিকটে বালি খাদগুলো ছিল বলেই ট্রাকগুলো তবু প্রায় সন্ধ্যে পর্যন্ত যাতায়াত করতো। যদিও এদিকের বেশ কিছু মাষ্টার মশাইকে বাস না পেয়ে কোনো কোনো দিন ট্রাকে করে ঘর যাওয়ার ঘটনাও শুনেছিলাম, তবুও একটা মেয়ে হয়ে ট্রাকে করে ঘর যাওয়াটা সাহসে কুলোচ্ছিল না। এদিকে প্রতিক্ষালয়ে বসে থাকাও যেন মনে হচ্ছিল প্রতিমুহূর্ত মৃত্যুকে হাতছানি দেওয়া। হাতঘড়িতে মাত্র চারটে পেরোলেও আকাশ বলছিল সন্ধ্যা হতে অল্পই দেরী। কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে কয়েকটা ট্রাককে পরপর হাত দেখিয়ে থামবার জন্য অনুরোধ করলাম। বৃষ্টির মধ্যে ওড়নাটা মাথায় দিয়ে যখন কোনোরকম একটা ট্রাক দাঁড় করাবার চেষ্টা করছি, তখন পাঁচ সাতটা ট্রাকের পর একটা থেমে গেল। ট্রাকের পাগড়ি পরা ড্রাইভার হিন্দি বাংলা মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, "কাঁহা জায়োগি?"
আমি আমার গন্তব্যের সাথে এটাও উল্লেখ করলাম যে আমি এখানের নারকেলভাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলের টিচার, আজ বাস না পেয়ে বিপদে পড়েই সাহায্য চাইছি। ড্রাইভার সম্ভবত খালাসিকে কিছু ইঙ্গিত দিতেই একটা কাঠের শক্ত মতো পাটাতনে ভর করে হাত ধরে আমাকে উঠে আসতে বলল। আমার ওজন খুবই হালকা থাকাতেই সম্ভব হলো খালাসির দুটো হাতে ভর করে উঠে যেতে।
ট্রাকে উঠে খেয়াল করলাম পাগড়ি পরা কমবয়সী এক ভদ্রলোক গাড়ি চালালেও যিনি আমার হাত ধরে টেনে তুললেন তিনি বেশ বয়স্ক। সাদা লম্বা দাড়ি, আর বিশেষ টুপি দেখে আমি আন্দাজ করলাম উনি মুসলিম। হিঞ্জুলির যেই ভয়টা এতোদিন ধরে বারেবারে আমার হৃদয় কাঁপিয়েছে, সেটাই আরো বেশি করে জাঁকিয়ে বসলো। একেক বার মনে হচ্ছিল মাথাতে ওড়নাটা দিয়ে রেখেছিলাম, ওনারা হয়তো নিজের ধর্মের ভেবেই ট্রাকে তুলেছেন। অন্য ধর্ম জানতে পারলে কি করতে পারেন ভেবে প্রায় দম বন্ধ করে বসে রইলাম ট্রাকে। মাঝে মাঝেই রাস্তার লোক ট্রাক দাঁড় করাচ্ছিল নানান গ্রামে। একটা করে কিসের সব রসিদ দিচ্ছিল আর সেই সাদা পোশাক পরিহিত বয়স্ক ভদ্রলোক সেই রসিদ নিয়ে পাঁচটাকা করে ধরিয়ে দিচ্ছিল। আদায়কারীদের অবশ্য বাসে যাতায়াত সূত্রে অনেক বাস স্টপেজে আগেও দেখেছিলাম। কিন্তু বারে বারে এরকম টাকা দেওয়ার জন্য ট্রাক থামানোতে যেমন দেরী হচ্ছিল, তেমনই কৌতূহল তৈরি হচ্ছিল। ভাবছিলাম এখন কিসের পূজো, যার জন্যে চাঁদা নিচ্ছে! দেখলাম প্রতিটা রসিদই ড্রাইভার হাতে নিয়ে বড়ো তাচ্ছিল্য সহকারে একটা প্লাস্টিকের ঝুড়িতে রেখে দিচ্ছে। একই ঘটনা বার পাঁচেক হওয়ার পর রসিদগুলো পড়লাম, সবই ওমুক মন্দির, বা তমুক মসজিদ নির্মান প্রকল্পের। যদিও ওনাদেরকে কিছু বলতে সাহস হলো না। আমি কিছু না বললেও আমার মনোভাব বুঝতে পেরে পাঞ্জাবী ভদ্রলোক বললেন,
-"ইধার ইয়ে সব চলতা হ্যা.. কভি মন্দির তো কভি মসজিদকে নাম পে.."
আমি বললাম,
-"কিন্তু এরা তো সবাই মিথ্যা বলে নিচ্ছে.."
পাশের বয়স্ক ভদ্রলোক পরিস্কার বাংলাতে বলল,
-"জানি বেটি.. কিন্তু না দিলে ওরা গাড়ির চাকার তলায় ছাগল বা মুরগি ঢুকিয়ে দেবে পরেরবার। তখন আবার আরো অনেক বেশি খরচা করে গাড়ি ছাড়াতে হবে মালিককে.. "
ভদ্রলোকের কথাতে যেন মনে হলো আমি এতোক্ষণ যতটা ভয় পেয়ে সিঁধিয়ে ছিলাম ওনারা ততটাও ভয়ঙ্কর নন। জিজ্ঞাসা করলাম,
-"আপনারা কোথা থেকে আসছেন?"
পাঞ্জাবী ভদ্রলোক বলল,
-"হাম তো বহুত দূর সে.. এম পি মে হামারা গাঁও হ্যায়.. ইয়ে রফিক জি ইধার কা লোক হ্যায়.."
বয়স্ক ভদ্রলোকের নাম রফিক শুনে পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম যে উনি মুসলিম। বয়স্ক ভদ্রলোকই বললেন,
-"আমার এই হিঞ্জুলেই বাড়ি বেটি.. বালি তোলারও কাজ করি.. ট্রাক নিয়ে যায়.."
হিঞ্জুল শুনেই যেন একটা ঠান্ডা স্রোত ঘাড়ের পাশ দিয়ে নেমে গেল। যা দুয়েকটা কথা বলছিলাম, ভয়ে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। তবে আমার কথা বন্ধ হয়ে গেলেও উনি থামলেন না। বলতে রইলেন,
-"এবারের প্যানেলে মাষ্টারি পেয়েছো না তুমি.. আমার বড়ো বেটিটাও ফর্ম ফিলাপ করতো। বয়সটা দুমাস কম ছিল বলে দিতে পারলো না, বড়ো আফসোস করছিল। আবার কখন এপয়েনমেন্ট হবে কে জানে!"
আমার যেন নিজের কানকেও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। এতো স্পষ্ট ইংলিশ টার্মগুলোর উচ্চারণ। তাও একটা ট্রাকে বা বালিখাদানে কাজ করা সাধারণ বয়স্ক মানুষের! একটু থেমে আবার ভদ্রলোক বললেন,
-"তোমাকে নারকেলভাঙ্গা স্টপেজে আগেও দেখেছি মনে হচ্ছে.."
আমি আমার ভীত শুষ্ক মুখে একটু মলিন হাসি টেনে বললাম,
-"দেখে থাকবেন.. ওখানেই রোজ বাস ধরি তো.."
কিন্তু মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, তার মানে এই রফিক জি আমার জাত, ধর্ম সবই জানে হয়তো... যদি না জানে আবার জিজ্ঞাসাও করে ফেলতে পারে ভেবে আমিই অন্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম,
-"আপনার কজন ছেলে মেয়ে?"
বয়স্ক ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বলল,
-"দুটো বেটির পর এক বেটা আছে.. তবে বেটি বলে অবহেলা করেছি ভেবো না। বড়োটা কলেজে পড়ছে, চাকুরী না হলে অবশ্য সাদির কথা ভাবতে হবে.. ছোটো মেয়েটা আর ছেলেটা হরিমায়াপুর হাইস্কুলেই পড়ে।"
দেখলাম ভদ্রলোক ছেলেমেয়েদের নিয়ে সত্যিই গর্বিত। মনে মনে ভাবলাম সবাই বলে হিঞ্জুলির সব লোকগুলো ডাকাত আর দস্যু, কেবল লুট করে খায়, তবে এনাকে দেখে তো এরকম মোটেও মনে হচ্ছে না। সত্যিই কি কয়েকটা মানুষের জন্যে একটা পুরো জাত বা ধর্ম খারাপ হয়ে যায়!
পাঞ্জাবী ভদ্রলোক বাংলা হিন্দি মিশিয়ে নিজের কথা বললেন। উনি হয়তো দুমাস ছাড়া একবার ঘর যান। ঘরে মা, বৌ, আর ছোট্ট ছেলে আছে। ওনাকে দেখেও মনে হচ্ছিল বেশিদিন বিয়ে হয়নি। মাঝখানে একবার ইতস্তত করে আমাকে আপেল অফার করেছিলেন ওনারা। কিছুক্ষণ আগেই টিফিন করেছি বলে আমি আর খেতে চাইনি। হয়তো অন্য ধর্মের বলেই ওনারাও আমাকে জোর করবার সাহস পাননি। তবে আমি দেখছিলাম কিভাবে একজন বয়স্ক মুসলিম ভদ্রলোক একজন শিখ সর্দারের সাথে হাসতে হাসতে আপেল থেকে জলের বোতল সব কিছু শেয়ার করছিলেন! ধর্মের বিভেদটা যে সম্পূর্ণ মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত সেটা আরেকবার অনুভব করলাম নিজের জীবন দিয়ে। হয়তো সেই বর্ষণমুখর দিনটা আমার জীবনে না এলে আমি সারা জীবন একটা ধর্মের প্রতি, একটা গ্রামের সকল মানুষদের প্রতি আতঙ্কিত, বীতশ্রদ্ধ হয়ে থাকতাম। কারণ হিঞ্জুল আমাকে যেতে হয়নি, তার আগেই আমি মিউচুয়াল ট্রান্সফারের অর্ডার কপিটা হাতে পেয়ে যাই। চলে যায় অন্য সার্কেলে।
সেদিন ট্রাকটা যখন আমার গন্তব্যের কাছাকাছি তখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওই বয়স্ক ভদ্রলোককে,
-"আপনারা তাহলে রাত্রে কোথায় থাকেন?"
সাদা লম্বা দাড়ির বয়স্ক ভদ্রলোক বলেছিলেন,
-"বেলা থাকলে আমি বাড়ি ফিরে যায়.. তবে আজ ডেলিভারি দিয়ে ফিরতে রাত হবে... গাঁয়ে আর যাবো না। এমনিতেই হিঞ্জুলের রাস্তাটাই গা ঢাকা দিয়ে রাত্তির বেলা লুটেরারা সব বসে থাকছে.. যা পাবে সব নিয়েও যে ছেড়ে দেবে এমন কথা নেই। বড়ো রাস্তাতে এসে ট্রাকগুলো পর্যন্ত লুট করছে.. এই তো সেদিন আমাদের আগের গাড়িটাতেই ডাকাতি হয়ে গেল। তাই রাত হলে ওই দূর্গাপুর হাইওয়েতে কোথাও গাড়ি দাঁড় করিয়ে ধাবায় কিছু খেয়ে গাড়িতেই ঘুমিয়ে যায়।"
সর্দার জি হাসতে হাসতে বলল,
-"আগলে দিন সুভা সে ফের কাম শুরু.. আপ লোগকে জ্যায়সা লাইফ কাঁহা হ্যায় হামারা!"
মনে মনে ভাবলাম সত্যিই তো ভুল কিছু বলেননি এনারা। একটা দিন বাড়ি ফিরতে না পারলে কোথায় থাকবো, কি করবো, কিভাবে ফিরবো ভেবে আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি। আর এনারা দিনের পর দিন এই একই ভাবে ট্রাকে করে মাল পৌঁছানো, বালি তোলা করে যাচ্ছেন। কতো অনিশ্চিত এনাদের জীবন। না আছে প্রতিদিন বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা, না আছে ঘরের নরম বিছানা বালিশে প্রতিদিন মাথা শোওয়াবার সামর্থ্য। এমনকি পরিবারের মানুষগুলোর মুখও নিয়মিত দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবুও তাদের ভালো চেয়ে, তাদের স্মৃতি বুকে করেই এক ঝাঁক উৎসাহ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। না আছে ছুটি! না আছে সুরক্ষা! তবুও ভালোবেসে নিয়েছেন কাজকে, মিলেমিশে এক হয়ে গেছে জাতি, ধর্ম, ভাষা।
ট্রাক থেকে নামবার সময় টাকা দিতে চেয়েছিলাম। বয়স্ক ভদ্রলোক টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন,
-"বেটি, টাকা দিয়ে ছোটো করো না তোমার চাচাদের। তোমাকে ঠিক সময়ে পৌঁছে দিতে পেরেই আমরা খুশি..."
সর্দারজিও ট্রাকের স্টিয়ারিং এ হাত রেখেই বললেন,
-"ফির কভি মিলেঙ্গে.."
ওনাদের অলবিদা জানিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছিলাম সেদিন। ক্ষণিকের জন্য ওনারা আমার জীবনে এলেও শিখিয়ে গেছলেন অনেক কিছু। হয়তো ওনারা আমার জীবনে না এলে যেই আদর্শ নিয়ে আমি ছোটোর থেকে বড়ো হয়েছিলাম সেই আদর্শ ধরে রাখতে পারতাম না নারকেলভাঙ্গা থেকে বদলী হয়ে আসার পরেও। মনে হতো হিঞ্জুলি গ্রামের সব মানুষগুলোই ডাকাত। মনে হতো মুসলিম মাত্রই হিন্দু বিদ্বেষী। ঠিক এই ভাবেই তো কিছু রটনা, কিছু গুঞ্জন, কিছু সমালোচনা প্রভাবিত করে আমাদের মনকে, ধুয়ে দেয় আমাদের নিজস্ব চিন্তা ভাবনা, বিষিয়ে দেয় আমাদের মস্তিষ্কে থাকা ঠিক আর ভুলের সূক্ষ্ম ধারণাগুলোকে। আমরা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের নাগরিক। নানান ভাষা, ধর্ম, জাতির মানুষ বারেবারে এসে মিলিত হয়েছেন আমাদের দেশে। আর এই মহান দেশের নাগরিক হয়ে কি একটু উদারমনস্ক হতে পারিনা আমরা!
শুধু আমার শহরটাই কেন! সেজে উঠুক আমার দেশের প্রতিটা শহর আমার শহরটার মতো করে। যেখানে প্রতিটা মানুষের হৃদয়ে নির্বিশেষে বাজবে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দামামা নয়, সম্প্রীতির মধুর সুর। এক হয়ে যাবে দূর্গাপূজোর বীরেন্দ্রকৃষ্ণভদ্রের স্ত্রোত্র পাঠের সঙ্গে ঈদের আজান ধ্বনি। রবি ঠাকুরের ভাষায় আমরা গাইতে থাকবো,
"হে মোর চিত্ত, পূণ্য তীর্থে, জাগো রে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।"

-সমাপ্ত-
©শিশির ধ্বনি - প্রতীতি চৌধুরী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ