‘অগাধ, গাধ, গাধা, গাধি, গাধী’ - ইত্যাদি শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ-ব্যাখ্যা' ।। কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তী


আমাদের দেশের প্রাচীন শব্দশাস্ত্রীরা দৃশ্য জগতকে কীভাবে বর্ণিত করবেন তা নিয়ে একেবারেই চিন্তিত ছিলেন না। কারণ তা দৃশ্যমান, সকলেরই গোচরীভূত এবং প্রত্যক্ষ। “অদৃশ্য অথচ সক্রিয়” সত্তাগুলিকে সমাজসদস্যদের কাছে কীভাবে কমবেশী বোধগম্য করানো যায় এমন একটি দুরূহ সমস্যার সমধান কীভাবে করা যায় তাই ছিল তাদের ভাষাজগৎ নির্ম্মানের অনুপ্রেরণা। কী ছিল তাদের সমাধান? প্রথমত, 'ক্রিয়ার আধাররূপে ক্রিয়াকারিত্ব অনুসারে সত্তাগুলির নামকরণ করা'। দ্বিতীয়ত, 'সত্তাগুলির উদ্ভব, বিকাশ ও ক্রিয়াকলাপের কাহিনী প্রচলিত ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় বর্ণনা করা'। তৃতীয়ত, 'প্রতীকী ছবি আঁকা'। চতুর্থত, 'প্রতীকী মূর্ত্তি বা ভাস্কর্য্য নির্ম্মান করা'। পঞ্চমত, 'সত্তাগুলি সম্পর্কে  প্রতীকী আচার-অনুষ্ঠান রূপে প্রথাসমূহের প্রচলন করা যা থেকে সত্তাগুলিকে অনেক স্পষ্টরূপে অনুভব করা সম্ভব'। 'এককথায় উপলব্ধ সত্তাগুলিকে নামশব্দে, কাহিনীতে, ছবিতে, ভাস্কর্য্যে, প্রতিমায় এবং আচার-অনুষ্ঠানের অজস্র বিধি-বিধানে আবদ্ধ করে অনুবাদ করে নিয়ে জনমানসের সামনে হাজির করা। প্রত্যেকের উপলব্ধির স্তর কিংবা অনুধাবন করার ক্ষমতা অনুযায়ী এই ‘অদৃশ্য অথচ সক্রিয়’ সত্তাগুলিকে তারা চিহ্নিত করতে পারবেন ও বুঝতে পারবেন এমন উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁরা অজস্র নামবাচক শব্দ সৃষ্টি করেছিলেন এবং সত্তাসমুহের ক্রিয়াকলাপই ছিল যার ভিত্তিমূল'। পুরাণের প্রায় সব সত্তাগুলিকেই এইভাবেই তাঁরা এই নিয়মসমূহ মেনেই তৈরি করেছিলেন।  তবে পৌরাণিক সত্তাগুলি ছাড়া এমন অনেক সত্তাও নির্ম্মিত হয়েছিল যেখানে এই পাঁচটি নিয়মের সবকটি করে দেখানোর প্রয়োজন অনুভূত হয় নি। লক্ষ্ণাত্মক বা সাদৃশ্য রূপটিকে চিহ্নত করেই সেই কাজ বহু ক্ষেত্রে সম্পন্ন করা সম্ভবপর ছিল। কালক্রমে কর্ম্মযজ্ঞ পরিবর্ত্তনের সাথে সাথে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থের ক্রম-সঙ্কোচন ঘটে। অভিধার্থ,  ব্যঞ্জনার্থ, ব্যাপ্তার্থ ভুলে শুধুমাত্র সাদৃশ্য অর্থের স্থির প্রতীকী রূপটিকে অর্থাৎ লোগোসেণ্ট্রিক রূপটিকে পেশ করাই শব্দার্থ নিরূপণের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে যায়।

‘গাধা’ শব্দটিও তেমনি একটি শব্দ। তবে গাধা-কে বোঝার আগে ‘গাধ’এবং ‘অগাধ’ এই শব্দদুটিকেও বুঝে নেওয়া দরকার। 

অগাধ=”নাই (অ) গাধ যাহাতে; অথবা যাহা অগভীর নয় (সুগভীর); অথবা যাহাতে গাধ (প্রতিষ্ঠা) নাই। গম্ভীরমহত্ত্ব, অতিগভীর, অতলস্পর্শ, প্রচুর, বিপুল”। গাধ শব্দের অর্থের বিপরীতে অগাধ হল, যেখানে গামী থামছে না, চলছে, অনন্ত বা অসীমের দিকে। তাই অগাধ প্রচুর অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

গাধ=”যাহা গমনকারীকে (গা) ধারণ (ধা) করে; অথবা যাহার তল স্পর্শ করা যায়; অথবা যেখানে প্রতিষ্ঠা বা স্থিতি আছে। অগভীর, সুখোত্তরণীয়, স্থিতিশীল”।

গাধি=গাধের সক্রিয়ণ বা গতিশীলতা থাকে যাহাতে। গামীর আধার হল দৃষ্টি, বাক, গান, কথা, উৎপাদিত বস্তু, পণ্য ইতাদি। এই সকল গামী ধৃত যা’তে তাই ‘গাধ’। এ হ’ল গামীর গতিশীলতা যেখানে থেমে গেছে। হতে পারে সেটি গমনলব্ধ ফল বা অন্য কিছু। এই গাধ-এর সক্রিয়ণ বা  বিকাশ সাধন থাকে যে আধারে সে হল গাধি।

গাধী=”গাধির আধারই হল গাধী [ গাধীর পুত্র অর্থাৎ গাধিনন্দন বিশ্বামিত্রকে বুঝতে হলে গাধ, গাধি এই দুটি শব্দের সঙ্গে পরিচয় থাকা দরকার” ]। “গাধী চন্দ্রবংশীয় নৃপতিবিশেষ, কুশীর পুত্র, কুশনাভের পৌত্র এবং বিশ্বামিত্রের পিতা। রাজা কুশী ইন্দ্রতুল্য পুত্রলাভের জন্য তপস্যা আরম্ভ করলে ইন্দ্র ভীত হয়ে তার কাছে এসে কিছু না বলে চলে যান। তারপর সহস্র বৎসর পরে আবার ইন্দ্র এঁকে দেখে যান। কুশীর উগ্র তপস্যা দেখে ইন্দ্র এঁর পুত্রজন্মের জন্য নিজ অংশ দান করেন। কুশীর স্ত্রী পৌরকুৎসীর গর্ভে গাধী জন্মগ্রহণ করেন” - (পৌরাণিক অভিধান)। 

“গামী যদি মানসফল বা ‘জ্ঞানবাক্য’ হয়, গাধী তবে সেকালের দার্শনিক ঋষি; আর গামী যদি দেহমনের যৌথফল হয়, গাথী তবে পণ্যজীবী। সমাজেতিহাসের প্রেক্ষিত থেকে বুঝতে হয়, তিনি ঠিক কী। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেই প্রেক্ষিতে রয়েছে কুশনাভ, কান্যকুব্জ, চন্দ্রবংশ, এবং সর্ব্বোপরি বিশ্বামিত্র। এই সত্তাগুলিকে যৌথসমাজ থেকে ব্যক্তিগতমালিকানাভিত্তিক সমাজে উত্তরণের প্রাথমিক পর্য্যায়ে নানা রূপে সক্রিয় দেখা যায়। সেই সুবাদে 'গাধী' সেকালের পণ্যজীবী সত্তাই হবেন। হতে পারে তিনি তাঁর আচরণের সপক্ষে  সকল সওয়াল করেছিলেন, এবং তা বহু ‘জ্ঞানবাক্য’ সহযোগেই করেছিলেন”।

গাধা=”গাধ-এর আধার (আ) যে; অথবা, যাহা অগভীর আধার মাত্র; কিংবা যে একটু কিছু হইলেই চেঁচায়। হিতাহিতজ্ঞানহীন, মূর্খ। (সাদৃশ্যে) গর্দ্দভ।” 

“ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুসারে ‘গাধ-এর বা অগভীর জ্ঞানের আধারকে ‘গাধা’ বলে। যে ব্যক্তি কোনো বিষয়ে তার উপরি-উপরি বা ভাসা-ভাসা জ্ঞান (superficial knowledg) সম্বল করে চলে, বাংলাভাষী তাকে ‘গাধা’ বলে থাকে। যেমন “দূর গাধা! বললাম পাদোদক খাস, চরণামৃত খাস (শ্লোকের, পদ্যের, পয়ারের পদে পদে বা চরণে চরণে ধরে রাখা জ্ঞানরস পান করিস), আর তুই কি না গুরুর পা-ধোয়া জল খেলি! গাধা কোথাকার!”। বলে রাখা ভালো, বাংলার অধিকাংশ মানুষ কিন্তু গাধা (ass) কেমন জন্তু তা চাক্ষুষ দেখেন নি কোনদিনই, যদিও কথাবার্ত্তায় ‘গাধা’ শব্দের ব্যবহার করে আসছেন বহু কাল থেকে। কেননা, বাংলাভাষী মাত্রেই মনের গভীরে জানেন শব্দটির অর্থ ভাসা-ভাসা-জ্ঞানী, অল্পজ্ঞানী, মূর্খ বা বোকা মানুষ। শব্দশাস্ত্র অনুসারে এটিই ‘গাধা’ শব্দের অভিধার্থ বা প্রকৃত অর্থ। বঙ্গমনীষা সত্তাটিকে বহুকাল আগেই শনাক্ত করে তাকে উল্লেখ করার জন্য ‘গাধা’ ও ‘নিম্ন-অধিকারী’ শব্দ দুটি সৃষ্টি করেছিল। আমরা তার অগভীর জ্ঞানধারণক্রিয়াকে বোঝাতে আরও একটি নতুন ‘পাদোদক-মূঢ়’ শব্দটি তৈরি করি।

যাঁরা জন্তু গাধাকে (ass-কে) দেখেছিলেন, তাঁরা লক্ষণার্থে শব্দটির প্রয়োগ করেন ঐ জন্তুটির ক্ষেত্রে। শব্দশাস্ত্রানুসারে, সারূপ্যে বা সাদৃশ্যে (জলে ভিজলে পিঠের বোঝা হাল্কা হয়, তা চিনির বস্তা হোক আর কাপড়ের বস্তাই হোক, এইরূপ ভাসা-ভাসা জ্ঞানবুদ্ধি যার তদ্রূপ) ভারবাহী পশু ‘অ্যাস’-কেও (ass-কেও) তাই গাধা বলা হয়ে থাকে। মোট কথা, বাংলাভাষায় ‘গাধা’ শব্দের প্রথম অর্থ বা অভিথার্থ (প্রকৃত অর্থ) হল, ‘গাধ-ধারী’ অর্থাৎ ‘ভাসা-ভাসা-জ্ঞানী’ বা বোকা (a dull, stupid fello) এবং দ্বিতীয় অর্থ বা প্রতীকী অর্থ হল ‘অশ্বতর প্রজাতির ধূসর রঙের এক প্রকার চতুষ্পদ জন্তু’ (ass / donkey)। ইংরেজী ভাষা বহুযুগ আগেই আদি ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দেহবাদী হয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ প্রতীকী ভাষায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল বলে, তাতে ass বা donkey শব্দের প্রথম অর্থ হল a small, usually grey, long-eared animal of the horse genus) এবং দ্বিতীয় অর্থ হল a dull, stupid fellow। এই দ্বিতীয় অর্থটি অতীতের চিহ্ন রূপে ইংরেজী ass শব্দের পিছনে আজও লেগে রয়েছে।”

আমাদের চারপাশে এমন অনেক সত্তার বিচরণ আমরা দেখতে পাই যা অগভীর কিংবা স্থিতিশীল। সমাজসদস্যদের অনেকের কাছে কিংবা নিম্ন-অধিকারীরা এই সত্তাকে যাতে অনুভব করতে পারেন তার জন্য একটি দৃশ্য সত্তাকে যথা প্রাণীকে প্রতীক হিসাবে নির্ব্বাচন করেছিলেন কারণ এই জন্তুটির ভিতরেও সেই সত্তার উপস্থিতি রয়েছে, আর এই অগভীর সত্তার সঙ্গে সমাজসদস্যদের পরিচিত করার উদ্দেশ্যেই সত্তাটিকে ‘গাধা’ শব্দে বর্ণিত করা হয়েছিল এবং প্রাণীটিও সেই সুবাদে গাধা নামাঙ্কিত হয়ে যায়। কালক্রমে বিশেষত পাশ্চাত্যভাষাতত্ত্বের প্রভাবে বাংলাভাষাতেও শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক বহুরৈখিক অর্থকে ফেলে দিয়ে শুধুমাত্র প্রতীকী ও স্থির একরৈখিক সাদৃশ্য অর্থটিই ফিক্সিটি পেয়ে যায়। হারিয়ে যায় ‘গাধা’ শব্দের অদৃশ্য ক্রিয়াভিত্তিক অভিধার্থ, ব্যঞ্জনার্থসমূহ। 

 - [ কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তী প্রণীত “সরল শব্দার্থকোষ”, "বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ" এবং "বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান" গ্রন্থ থেকে সঙ্কলিত।                                 - প্রশাসক, বঙ্গযান। ]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ