তবে কি ফিরে আসছে ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হবার যুগ?।।অরিন্দম চ্যাটার্জি



হাওয়ায় উড়ছে প্রশ্নটা । বিভিন্ন মিডিয়া বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করছে '‘ফিন্যান্সিয়াল রেজোলিউশন অ্যান্ড ডিপোজিট ইনসিউরেন্স বিল' । বেশ খটমট নাম, বিষয়টাও খটমট! ফিনান্স, ব্যাঙ্ক, শেয়ার এইসব শুনলে আমার মধ্যে খানিকটা ‘লুব্ধক প্রবৃত্তি’ জেগে ওঠে। এই তো খারাপ ভাবলেন, কুকুর কিন্তু জাত ‘সত্যানুসন্ধনী’, অন্তত মানুষের মতো জেগে ঘুমোয় না। জানা যাচ্ছে এই বিল এখন যুগ্ম সংসদীয় কমিটির টেবিলে। বিলে কি আছে সেটা আমজনতা জানে না। আর জানবেই বা কেন আমারা তো লাইনে দাঁড়িয়ে আমাদের ‘অভিভাবক’ ঠিক করি। তারপর আবির মাখি, মিষ্টি খাই অতঃপর? তারপর আমাদের কাজ নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমনো। কুম্ভকর্ন ঘুমতেন ছয় মাস...আমারা..আমাদের ঘুম দেখলে তিনি নিশ্চিত লজ্জা পেতেন! যাদের আমারা ‘অভিভাবক’ ঠিক করি তারা কি করছেন? কাদের স্বার্থে কাজ করছেন এইসব প্রশ্ন তুললেই কোন একটা তকমা দিয়ে দেওয়া হবে। “ঐ ব্যাটা প্রশ্ন করছে ,ওকে তালিকাভুক্ত কর!”। ভারতে স্বাক্ষরতা ৭৪.০৪%। এর মধ্যে ডেবিট,ক্রেডিট বোঝে কতো শতাংশ? আর বেল আউট বা বেল ইন বুঝবে তার কত শতাংশ? সংখ্যাটা হিসেবের জন্য দশমিকের বিশেষ প্রয়োজন পড়বে। মিডিয়া মারফৎ যেটুকু জানা যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে এই বিল নির্ধারণ করবে ব্যাঙ্কে রাখা আমার আপনার অর্থের ভবিষ্যৎ, যা বেশ অন্ধকার সেটা কোনো অন্ধ মানুষও বলে দিতে পারে।

তবে যেটুকু পরিস্কার ভাবে বোঝা  যাচ্ছে, এই বিল পাশ হলে ক্ষমতার অনেকটাই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাত থেকে অর্থ মন্ত্রকের হাতে চলে যাবে। কেউ বলতেই পারেন, আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবরে লাভ কি বাপু??? যারা ব্যাংকিং  ইন্ডাস্ট্রির কিঞ্চিৎ খবর রাখেন তারা জানেন, দীর্ঘ দিন ধরেই অর্থমন্ত্রক এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিভিন্ন বিষয়ে আলাদা মতামত সামনে এসেছে। কিন্তু যেহেতু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে ক্ষমতার অনেকটাই ছিল তাই এতোদিন ব্যাংকিং পরিসেবায় অর্থমন্ত্রক তাদের ইচ্ছার ছড়িটি ইচ্ছামতো ঘোরাতে পারেননি।

ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ  হবার ফলে ভারতের প্রান্তিক মানুষ, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভেবেছিলেন, আর যাই হোক ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে, জমানো অর্থ হাপিশ হয়ে যাবে না! যদিও তারা অনেকেই জানতেন না ১৯৬১ সালের একটি আইন যার সংক্ষিপ্ত নাম  ডি.আই.সি.জি অ্যাক্ট। যেখানে বলা আছে ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হলে মাত্র ১ লক্ষ রুপি(ইনস্যুরেন্স) পর্যন্ত আমানত গ্রাহকের হাতে ফেরাতে বাধ্য দেশের সরকার। তার বেশি হলে কিন্তু সরকার অর্থ ফেরাতে বাধ্য নয়।অবাক হচ্ছেন? সন্দেহ হচ্ছে মাত্র ১ লক্ষ টাকার কথাটা ঠিক কিনা, এটা ভেবে? ইন্টারনেট খুঁজে আইনটা একবার পড়ে ফেলুন। আপনার এক লক্ষের বেশি অর্থ জমা আছে? না না রক্তচাপ বাড়াবেন না! টাকাপয়সার পরে আগে শরীরের ভালো মন্দ!  তবুও তো কিছু মানুষ যারা সামান্য অর্থ জমা রেখেছেন তারা তাদের অর্থ ফিরত পাবেন, এটা এই আইনের ভালো দিক। মিডিয়া থেকেই পাওয়া একটি হিসেব বলছে এই মানুষের সংখ্যা, যারা ১ লক্ষের কম জমা রেখেছে প্রায় ৭৯ %। এই ১ লক্ষ্যের এই সীমা উঠে গেলে এরাও বিপদে পড়বেন। কিন্তু বড় প্রশ্ন হঠাৎ  করে ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হবার কথা উঠছে কেন? ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়!”🧐🧐

যারা নতুন ব্যবসা করার জন্য ঋণ নিতে ব্যাঙ্কে গেছেন, একটা দোকান করতে চান বা একটা গাড়ি কিনে ভাড়ায় খাটাবেন কিংবা একটা ছোট্ট গ্রিলের কারখানা বা এই ধরণের কিছু তারা জানেন কি ভয়ঙ্কর সমস্যা তাদের পোহাতে হয়েছে। এদের মধ্যে বেশিভাগই ঋণ পাননি আর যারা পেয়েছেন তারা একটা কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে কি ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন সেটাও অজানা নয়। আর কৃষি ঋণ!!! এইসব বিতির্কিত বিষয় তুললে কিন্তু আপনাকে ‘লাল কার্ড’ দেখানো হবে! আমাদের কৃষকরা এক এবং একমাত্র ‘পারিবারিক বিবাদ’-এ আত্মহত্যা করে! অনেকেই জানেন  হুমকি, গুণ্ডা পাঠানো কিছুদিন আগেও তো জলভাত ছিল ব্যাঙ্কগুলির কাছে। কিন্তু আপনার আমার পাশেই হাতেগোনা কিছু মানুষ আছেন, যাদের আমারা টেলিভিশনে দেখি, খবরের কাগজে বড় ব্যবসায়ী, ধন কুবের হিসেবে নাম পড়ে থাকি তারা কিন্তু ঋণ নিয়ে বেমালুম ভুলে যান। মানে হজম করে নেন আর কি!! একজনের নাম তো আমারা সকলেই জানি, তিনি মিস্টার মাল...মালি...মালা থুড়ি মাল্য। তবে তিনি একা নন তার সঙ্গী তাবড় শিল্পপতিরা, যাদের নাম ধনকুবের হিসেবে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে জায়গা করে নেন, তারা হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপ করে বহালতবিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমন ভাবার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ নেই এই পরের ধনে পোদ্দারি করা ঋণ খেলাপি কুবেররা এক বছর বা পাঁচ বছর ধরে এই কাজ করছেন, তারা এটা করে চলেছেন যুগযুগ ধরে।

তাদের কিছু হচ্ছে না কেন? আবার একটা বেমক্কা প্রশ্ন করে বসলেন তো! বারবার বলা হয়েছে প্রশ্ন করলেই কিন্তু আপনাকে ‘তালিকাভুক্ত’ করা হবে, তাতেও আপনার সামান্য ভয় নেই? একট মগজ খাটান! যদি সেইসব ‘প্রভু’-দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা হলে আপনি আমি যখন মাঝেমাঝেই লাইনে দাঁড়িয়ে আমাদের ‘অভিভাবক’ বাছাবাছি করি সেই সময়ে অভিভাবকদের জেট প্লেনের ভাড়া দেবে কে? পেল্লায় কাট আউটের খরচ জোগাবে কে? মিটিং, সেটিং, ইটিং এসব তো আছেই। ‘অভিভাবক’ বোঝেন তো? ঠিক ধরেছেন, সমঝদারও কে লিয়ে ইশারাই কাফি! যতদূর জানা যাচ্ছে, যদি ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে যায় তবে ঐ ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের অর্থের বেশ কিছু অংশ গ্রাহক তিনি তার ইচ্ছে মতো তুলতে পারবেন না।  এর কিছুটা ফিক্সড ডিপোজিটে পরিবর্তন হয়ে যাবে আর কিছুটা ইকুইটি বা শেয়ারে। কোন কোম্পানির ইকুইটি শেয়ার? যদি দেউলিয়া হওয়া ব্যাঙ্কটির হয় তবে  সর্বনাশ, কারণ দেউলিয়া হতে বসা ব্যাঙ্কটির ইকুইটির দাম কোন ভাবেই বাড়বে না। অর্থাৎ সেখানেও আমানতকারীর লোকসান। ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’! এতো লোকসান দিয়ে কি কিছু লাভ  হবে? লোকসান করে লাভ! বেশ বলেছেন। আপনি  আবার কিন্তু প্রশ্ন করছেন! এবার আপনি অবশ্যই ‘তালিকাভুক্ত’ হবেন! ভেবে দেখা হবে কোন তকমাটা আপনাকে দেওয়া যায়? লাস্ট ওয়ার্নিং- এবার প্রশ্ন না থামালে , আপনাকে ‘অর্থনৈতিক মৌলবাদী’ কিংবা ‘ফিনানশিয়াল সন্ত্রাসী’  তকমা সেঁটে দেওয়া হবে। আরে লাভ হবে, একটু সবুর করুন। এতো বছর ধরে অপেক্ষা করছেন, এখনও অভ্যাস হলো না? যাবে যাবে, ২০২২ সালে জিডিপি ডবল ডিজিটে যাবে। আচ্ছা ২০২২ না হোক ২৫, আপনাদের সব কিছুতেই হাভাতেপনা!  দেখতে পান না চারিদিকে কেমন  সুখি সুখি, উন্নতি উন্নতি মিঠে হাওয়া বইছে। এতো বছর ধরে হাওয়া বইছে আর হাভাতের দল নেই নেই করে হেদিয়ে মরছে!
সবকিছুর সারবত্তা দু-দশজন ‘ঋণ খেলাপি’-এর জন্য ১ শ২৭ কোটি সমস্যায় পড়লে সমস্যাটা কোথায়?🤔🤔🤔 ঋণ খেলাপি হোক আর যাই হোক ওনারা আমাদের লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে নির্বাচিত ‘অভিভাবক’-দের ‘প্রভু’ বলে কথা। এইরে কিসব ভুল্ভাল বলছি!!! এইসব কথা বলতে নেই, ‘পাপ’ হয়। ওনাদের জন্য একটু ধৈর্য ধরে সয়ে নিন, ভেবে নিন যা হয় সেটা ভালোর জন্যই হয়! না হলে কিন্তু....... ভেবে দেখতে হবে  ‘অর্থনৈতিক মৌলবাদী’ কিংবা ‘ফিনানশিয়াল ফ্যসিস্ট’  নাকি অন্য কিছু ‘লেবেল’ লাগানো যায় আপনার পিঠে।
 পিঠে শুনে জিভ বার করলেন কেন? এটা গো কূল কিংবা পুলি কিনা চিন্তা করছেন? আর ভাবছেন আপনার অর্থ নিয়ে আপনার মতামত কেউ জানতে চাইছে না কেন? আবার প্রশ্ন? এবার কিন্তু আপনি বাস্তবে ‘লাল কার্ড’ দেখবেন! ধৈর্য ধরুন, লম্বা শ্বাস নিন, ভাবতে থাকুন, একমনে ভাবতে থাকুন... এসব তো আপনার ভালোর জন্যই!!!!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ