শুধুই কি মীরজাফর বিশ্বাসঘাতক? ।। অরিন্দম ভট্টাচার্য


১৭৫৭-এ পলাশীর 'যুদ্ধ'... ইংরেজদের হাতে সিরাজদ্দৌলার পরাজয়...বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর।

অনেকের ক্ষেত্রেই দেখেছি, এই 'বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর' শুধু মীরজাফরে আটকে থাকে না। ফরমায়েশি ইতিহাসের মাদকতায় তাঁদের চিন্তাভাবনা স্পাইরাল মোশনের মতন কুন্ডলি পাকিয়ে নির্দেশ করে এক বিশেষ 'ধর্মীয় সম্প্রদায়ের' দিকে। অর্থাৎ, মীরজাফর='ওরা'
মীরজাফর=বিশ্বাসঘাতক
'ওরা'=বিশ্বাসঘাতক।

এই বিষয়ে দুটো তথ্য প্রায় অবিকল টুকে নীচে দিয়ে দিলাম:

১। পলাশীর ষড়যন্ত্রে মুর্শিদাবাদ দরবারের অভিজাতবর্গের মধ্যে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন মীরজাফর ও জগৎশেঠ, যদিও উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ প্রমুখও এতে জড়িত ছিলেন। তাই মীরজাফরই একমাত্র 'বিশ্বাসঘাতক', এটা সত্য নয়।জগৎশেঠের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজরা প্রথমে সিরাজদ্দৌলার জায়গায় নবাব হিসেবে ইয়ার লতিফ খানকে বসাবার মতলব করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জগৎশেঠের মনোনীত প্রার্থী মীরজাফরের দিকে ঝুঁকল কারণ তারা জানত জগৎশেঠদের সাহায্য ছাড়া বাংলায় কোনো রাজনৈতিক পালাবদল সম্ভব নয়। কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল' (Jean Law), যিনি দরবারের নাড়ি-নক্ষত্রের খবর রাখতেন, পরিষ্কার লিখেছেন যে 'ইংরেজরা যা করেছে তা জগৎশেঠদের সমর্থন ছাড়া করতে কখনো ভরসা পেত না।' সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিশ্বসঘাতকতার দায় শুধু মীরজাফরের নয়-জগৎশেঠদের দায় মিরজাফরদের চাইতে বেশি বই কম নয়।

আসলে ইতিহাস পরিক্রমায় একটু পিছিয়ে গেলেই দেখা যাবে যে অষ্ঠাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার
সব কটা রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ওই সময়কার রাজনীতিতে পটপরিবর্তনের চাবিকাঠি ছিল জগৎশেঠদেরই হাতে।

২। 'জগৎশেঠ একজন না' (আমার লেখা)।

অষ্টাদশ শতকের গোড়া থেকেই বাংলার অর্থনীতিতে বণিক রাজারা বিশিষ্ট ভূমিকা নিতে শুরু করেছিলেন।
এই বণিকরাজাদের মধ্যে সবদিক থেকে অগ্রগণ্য ছিলেন জগৎশেঠরা। এঁদের বলা হয় 'Rothchilds of the East'। রাজস্থানের মারওয়ার অঞ্চলের নাগর থেকে এঁদের পূর্বপুরুষ হিরানন্দ সাহু 'ভাগ্যান্বেষণে' ১৬৫২ সালে পাটনা চলে আসেন। তাঁর সাত পুত্রের জ্যেষ্ঠ মানিকচাঁদ তখনকার বাংলার রাজধানী ঢাকায় এসে মহাজনি ব্যবসা শুরু করেন। এঁরা ছিলেন শ্বেতাম্বর জৈন।

ঢাকায় মানিকচাঁদের সঙ্গে নবাগত দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। মুর্শিদকুলি যখন ১৭০৪ সালে দেওয়ানি দফতর ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন, তখন তাঁর সঙ্গে মানিকচাঁদও ঢাকা ছেড়ে মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। তখন থেকেই মুর্শিদকুলির আনুকূল্যে জগৎশেঠদের উন্নতির শুরু। তাঁদের রমরমা এই মানিকচাঁদ ও তাঁর উত্তরসূরী ফতেচাঁদের সময়। ১৭১৪ সালে মানিকচাঁদের মৃত্যুর পর তাঁর ভাগ্নে ফতেচাঁদ গদিতে বসেন। ফতেচাঁদের সময়েই জগৎশেঠরা প্রভাব ও প্রতিপত্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছয়। সম্ভবত মুর্শিদকুলির অনুরোধে মুঘল সম্রাট ১৭২২ সালে ফতেচাঁদকে 'জগৎশেঠ' (Banker of the World) উপাধিতে ভূষিত করেন। এই উপাধি বংশানুক্রমিক।

প্রায় তিরিশ বছর ধরে বাংলার বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব বিস্তার করে জগৎশেঠ ফতেচাঁদ ১৭৪৪ সালে মারা যান। তাঁর উত্তরাধিকারী হন তাঁর দুই পৌত্র জগৎশেঠ মহতাব রায় ও মহারাজা স্বরূপচাঁদ।

তথ্যসূত্র: 'নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ'
               সুশীল চৌধুরী
               প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ
               প্রথম সংস্করণ,ষষ্ঠ মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০১৫
               পৃষ্ঠা: ৩৭ এবং ৭৩

হয়তো অনেকেরই এই বিষয়গুলো জানা, তবুও...

মীরজাফর
ছবি সৌজন্যে: উইকিপিডিয়া

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ