ভারতবর্ষ ইংরেজ কর্তৃক দখলীকৃত না হলে... || রাণা


অদ্ভুতুড়ে ভাবনা। যদি ইংরেজরা ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধে বা ১৭৬৪ সালের বক্সার যুদ্ধে হেরে বসত তাহলে ২০১৭ তে এসে পৃথিবীটাকে কেমন দেখতাম। ভৌগোলিক থেকে নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশের চালচিত্র কেমন হত!

ভারতীয় উপমহাদেশের মানচিত্র কেমন হত?

1707 সালে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য ক্রম ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। ফলে ভারতের বিভিন্ন অংশের উপরে মুঘলদের নিয়ন্ত্রণ কমতে থাকে। সুবে বাংলা, হায়দ্রাবাদের মত অনেকে স্বাধীনভাবে রাজপাট চালাতে শুরু করে। যে মারাঠাদের হাত  ধরে ভারতের ছোট ছোট রাজ্যের উপরে একীভূত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ আসতে শুরু করেছিল, তাও মারাঠাদের অন্তর্কলহে ম্রিয়মান হতে থাকে। শিখদেরও উত্তর বা উত্তর-পশ্চিম ভারতের অংশ ছাড়া সারা ভারতজুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের বিশেষ লক্ষণ দেখা যায় না। মহীশুর রাজ্যও দক্ষিণ ভারতের এক নির্দিষ্ট অংশেই সীমাবদ্ধ ছিল। নিজেদের সীমানাটুকু রক্ষা ছাড়া বাড়তি বিস্তারের দিকে বিশেষ মনযোগ দেখা যায়নি। সুবে বাংলাও পূর্ব ভারতের নিজের সীমা রক্ষার্থেই বেশি মনযোগী ছিলেন। 

১৭৫৭-র পর বৃহৎ কোন রাজশক্তির আবির্ভাবের সম্ভাবনাও কম ছিল। ভীষণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী আগ্রাসী রাজশক্তিকেও ভারতের বৃহৎ অংশজুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করতেও ১০০ বছর লেগে যাওয়ার কথা। ইতিহাস তেমনই বলে। ভারতের প্রথম কেন্দ্রীভূত রাজশক্তি মোর্য্য সাম্রাজ্যকে ধরা হলে সেই সাম্রাজের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটে তৃতীয় পুরুষ অশোকের আমলে। মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ১৫২৬-এ বাবর যে সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, তার সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটে ষষ্ঠ পুরুষ ঔরঙ্গজেবের আমলে, প্রায় ১৫০ বছর পর। সুতরাং ভারতের ২০০০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলা যায় যে ১৭৫৭ সালের পরের দেড়শ বছরে ভারতের মানচিত্রে খুব বিশেষ ফারাক হত না। ভারতে বিদেশি শক্তিরা এসেও যে ভারতের বৃহৎ অংশকে একীভূত করবে তেমন সম্ভাবনা আরো কম ছিল। আফগানেরা নিজেদের মধ্যে অন্তর্কলহে ও লুঠতরাজে বেশি মনযোগী ছিল। ধর্মীয় গোড়ামি পারস্য, ইরাকের মত শক্তিদের হীনবল করে রেখেছিল। প্রাচীন সেই মহান সাম্রাজ্যেরা আজও হীনবল ও মেরুদন্ডহীন। আর্য থেকে মুঘল ভারতে বরাবর বিদেশি আগ্রাসন হয়েছে পশ্চিম দিক থেকে। ১৭৫৭ পরবর্তী সময়ে তেমন সম্ভাবনা ছিল শূন্য। চীনা জুজু কোনকালেই ছিল না। চীন কোনকালেই ভারতে দখলদারির দিকে মনযোগী ছিল না। 
কেউ যদি ভেবে থাকেন উনবিংশ শতাব্দীতে এসে কোন রাজা-বাদশা ঘোড়া-তরোয়াল বা দো-নলা বন্দুক নিয়ে সারা ভারত জুড়ে যুদ্ধ করে চলেছেন, তাও হাস্যকর। কারণ আধুনিক পৃথিবী পাল্টাতে শুরু করে দিয়েছে। পৃথিবী নিজের সীমারেখা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে শুরু করেছে, জাত্যাভিমান তৈরি হতে শুরু করেছে, গণতান্ত্রিক মানসিকতা বিস্তার লাভ করছে। তাই নেপোলিয়ন বা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া অষ্টাদশ শতকের পরবর্তী সময়ে অন্যের সীমানার দখলদারি বড় দেখা যায় না। এমনকি মহাশক্তিধর আধুনিক আমেরিকাও জমি দখল না করে সম্পদের দখলে বেশি মনযোগী। ইরাক বা আফগানিস্তানে অত দামি যুদ্ধের পরেও সে দেশের মাটি ছেড়ে দিতে আমেরিকা দ্বিধা করে না।

দেশ বা দেশের সীমারেখা সতত পরিবর্তনশীল। আমাদের পূর্বপুরুষেরা হাজার বছর আগে দেশ বলতে যা বুঝতেন, এখন আমরা দেশকে ভিন্নরূপে দেখি। ভারতের বৃহৎ জনগণ ষাট-
সত্তর-আগেও সরকার ও দেশ বলতে বুঝতেন জমিদার ও নিজের ছোট্ট গ্রামকে। তাই আজও যখন গ্রামের মানুষ ছুটিতে শহর ছেড়ে নিজের গ্রামের দিকে পাড়ি দেন, বলেন "দেশ যাব।"
দেশের জমি-সীমারেখা নিয়ে দেশ চালকেরা যতই জনগণের মধ্যে উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা করুক, প্রকৃত সত্য হল দেশ জনগণ তৈরি করে না। দেশ তৈরি করে কতিপয় রাজন্য গোছের মানুষ।

"দেশের মানচিত্র পরিবর্তন করতে দেব না বলে" যতই আস্ফালন করি, ১৯৪৭ সালের পরেও দেশের মানচিত্র বারেবারে পাল্টেছে।  ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তান কাশ্মীরের এক বৃহৎ অংশ দখল করে নেয়, যা আজও তাদের দখলীকৃত। চীনও বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে। লাদাখের এক বড় অংশ আজ চীনের দখলে। স্বাধীনতার পরে ভারতের মানচিত্র সঙ্কুচিত হয়েছে। আবার সংযোজনের সংখ্যাও কম নয়। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে হায়দ্রাবাদ রাজ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানের ফলে ভারতের অংশীভূত হয়। হায়দ্রাবাদের নিজামের অবস্থা দেখে ১৯৪৯ সালে স্বাধীন দেশীয় রাজ্য ত্রিপুরা ও মনিপুরের শাসকগণ ভারতের অন্তর্ভুক্তিতে সায় দেন। ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। আজ যা লাইন দেখছি কাল যে সে লাইন পাল্টাবে না তা কে হলফ করে বলতে পারে। এখন তো নতুন দেশের গঠন হচ্ছে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক ভাবনার উপর ভিত্তি করে। যুগোশ্লেভিয়া ভেঙেছে, চেকোশ্লেভিয়া ভেঙেছে, আফ্রিকাতেও ছোট ছোট দেশ গড়ে উঠছে। আধুনিক বিশ্বে সংযোজনের ইতিহাস বরং কম। ১৯৮৯ সালে একমাত্র পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি নিজেদের জাতিগত পরিচয়ে একীভূত হয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার একীভূত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তা নিজেদের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক নৈকটত্বের কারণেই। এইরকম আরো বেশ কিছু অঞ্চল ও জাতির ভবিষ্যতে একীভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ধর্ম বা রাজনেতারা যতই সীমারেখা টানার চেষ্টা করুক।

১৭৫৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত ছিল ৫০০-র উপর দেশীয় রাজ্য নিয়ে। ১৯৪৭-এ ইংরেজ যখন ভারত ছাড়ে তখন ভারতীয় উপমহাদেশে দেশীয় রাজ্যের সংখ্যা ছিল ৫৬৫। ইংরেজ দখলীকৃত ভারত বাদ দিয়ে প্রায় ৪৮% শতাংশ ভারত এদের অধিকারে ছিল। এই দেশীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে যেমন দুই লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের হায়দ্রাবাদ ছিল, আবার ৪৯ বর্গকিলোমিটারের লাওয়া রাজ্য ছিল। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ অব্দি বিশ্লেষণ করে বলা যায় যদি ইংরেজরা ভারতে শাসকের রাজদণ্ড নিয়ে না আসতেন, তবে ভারতবর্ষকে রাজনৈতিকভাবে অন্য রূপে পেতাম। মুর্শিদাবাদ বা ঢাকাকে কেন্দ্র করে বৃহৎ বাংলা, দিল্লীকে কেন্দ্র করে উত্তর ভারত, লাহোরকে কেন্দ্র করে পঞ্জাব, অযোধ্যা, মারাঠাদের বৃহৎ মহারাষ্ট্র, বারোদা, জুনাগড়, দক্ষিণে হায়দ্রাবাদ, মহীশুর, ত্রাভাঙ্কুর উত্তর-পূর্বে ত্রিপুরা, মনিপুর এইভাবে বিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তখন কোন বাঙালিকে দক্ষিণ ভারত বা আগ্রার তাজমহল ঘুরতে গেলে ভিসা করতে হত। হয়তো ইউরোপের মত সমস্ত দেশগুলিকে নিয়ে ভারতীয় ইউনিয়ন গড়ে উঠত, যেখানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে ভিসা লাগত না।



ইতিহাসের কিছু ছিন্নমুহূর্ত বাদ দিয়ে গোটা ভারত কখনোই কোন শাসনতন্ত্রের অধীনে ছিল না। ভারতবর্ষ বরাবরই বিভক্ত হয়ে ছিল। আজ যে ভারতবর্ষের রূপ দেখি ইতিহাসের কোন সন্ধিক্ষণেই ভারতকে এমন রূপে পায় না। আজ বৃহৎ ভারতের যে মানচিত্র দেখি তা ইংরেজদের তৈরি করে যাওয়া। ইংরেজরা চাইলে বর্তমান মায়ানমারও ভারতের অন্তর্ভূত হতে পারত। ১৯৩৭ সাল অব্দি মায়ানমার ভারতের অন্তর্ভূত ছিল। আবার ইংরেজরা না থাকলে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের লজ্জাজনক অধ্যায়েরও আমাদের সাক্ষী হতে হত না।

আজ যখন ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে ভারত মাতা কি জয় বলার রেওয়াজ উঠছে, তখন ১৭৫৭ সালে এইসব বীর ভারতীয়দের পূর্বপুরুষেরা কোন ভারতের কথা স্মরণ করে ভারত মাতার জয় বলতেন? নিজামের হায়দ্রাবাদ কে গোটা ভারত ভাবতেন, না দিল্লীর মুঘল বাদশা, না আলিবর্দির বাংলা, অথবা পুণের মারাঠাদের - ঠিক কোন ভারত কে তারা ভারতমাতা কল্পনা করতেন?

শাসন পরিচালন ব্যবস্থা কেমন হত?

বেশিরভাগ অংশে রাজতন্ত্র, বা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের মধ্যে গণতন্ত্র বাস করত। বৃহত্তম গণতন্ত্রের অধিবাসী হয়ে এমন কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে? পাশের দেশ নেপাল ও ভূটানকে দেখুন। ভূটানে এখনো রাজতন্ত্র বিদ্যমান। নেপালে কয়েকবছর আগে অব্দি রাজতন্ত্র বিদ্যমান ছিল। ভারতের বিভিন্ন অংশে তেমন শাসনব্যবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল। কারণ?
ভারতীয়রা যেমন আছে তাতেই খুশি। হিন্দু ধর্মই এইভাবে খুশি থাকতে শিখিয়েছে। পূনর্জন্মবাদ ও কর্মফল ভারতীয়দের সব ব্যবস্থা মেনে নিতে শিখিয়েছে। অন্য দেশ হলে তথাকথিত অচ্ছুতরা উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতই। তা কোন কালেই হয়নি। ধর্মই শিখিয়েছে অত্যাচারের কারণ শাসক নয়, অত্যাচারিতের কর্মফল। এই জন্মে নীরবে কর্মফল ভোগ করলে পরের জন্মে মিলবে স্বর্গসমান জীবন। রাজা তো ভগবানের সাক্ষাত প্রতিনিধি। পূর্বজন্মের পুণ্যের ফলে তিনি রাজকার্য পরিচালনার ভার পেয়েছেন। রাজা যদি অত্যাচারী হন, সেই পাপের ফল তিনি পরজন্মে পাবেন। সাধারণ মানুষের কোন অধিকারই নেই রাজবিদ্রোহ করার। অতএব ভারতে রাজারা যেমন নির্বিঘ্নে রাজশাসন করে গেছেন, তা ভবিষ্যতেও করতেও অসুবিধা হত না।
পঁয়ষট্টি বছর গণতন্ত্র অনুশীলন করার পরেও আমাদের রাজন্যপ্রেম ও রাজভক্তি যায়নি। তাই মোতিলাল নেহেরু থেকে রাহুল গান্ধিকে বংশবদ রাজন্যপ্রথার মত নতমস্তকে মেনে নি। ব্লক স্তরের নেতাও যখন গ্রামের সামন্ত প্রভুর মত আচরণ করে তাও আমাদের গা-সওয়া হয়ে যায়। আমাদের রক্তেই রয়েছে রাজভক্তির বীজ। ইংরেজরা এক গণতন্ত্র উপহার দিয়ে গেছে, এক সংবিধানের কাঠামো দিয়ে গেছে - তাই আমরা মনেপ্রাণে অনুকরণ করে যায়।

ইংরেজি শিক্ষার ফলে ভারতে পাশ্চাত্যের বিপ্লবী কর্মকান্ডের খবর বয়ে আনে। আয়ারল্যান্ডের গুপ্ত সমিতির অনুপ্রেরণায় ভারতে অনুশীলন, যুগান্তর বা গদর পার্টির মত গুপ্ত সমিতিগুলো গড়ে ওঠে। ফ্রান্স, জার্মানির বিপ্লবী কর্মপন্থা শিক্ষিত ভারতীয়দেরও উদ্বেল করে। দেশের ধারণা গড়ে ওঠে, ভারতীয়ত্ববোধ জাগ্রত হয়। ইংরেজরা আসার আগে সাধারণ ভারতীয়রা কবে নিজের দেশকে শিখেছিল। নিজের ছোট গন্ডীর মধ্যেই সহস্র বছর ধরে আবদ্ধ ছিল। ইংরেজি ভাবধারা ছাড়া দেশে জাত্যাভিমান গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কম ছিল। 
সম্ভাবনা ছিল রাশিয়া বা চীনের বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশে কিছু বিদ্রোহ হওয়ার। কিন্তু কর্মফলের যাঁতাকলে পড়ে সেইসব বিদ্রোহ অসফল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল।

শিল্প-শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা কেমন হত?



১৭৫৭ সালে ইংরেজরা ভারতের মাটিতে পা দেওয়ার জায়গা পাওয়ার পর, ধীরে ধীরে সাম্রাজ্য বিস্তারে মনযোগী হন। এবার এই বৃহৎ সাম্রাজ্যকে দেখভালের জন্য প্রশাসনে এক বিশাল সংখ্যক অনুগত বাহিনীর প্রয়োজন ছিল। সাগর ডিঙিয়ে জল-জঙ্গলের দেশে শিক্ষিত  ইংরেজদের আনা কষ্টকর ছিল। নিজেদের প্রয়োজনে ইংরেজরা করনিক শিক্ষাব্যবস্থা শুরু করেন। তদানন্তীন রাজধানী কলকাতাকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। এর সাথে উইলিয়াম কেরি, ডেভিড হেয়ার বা ডিরোজিওর মত ভারত বন্ধুরাও উল্লেখনীয় অবদান রাখেন। নতুন প্রভুর সাথে মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনে বাঙালি হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষাকে অন্তঃস্থ করতে এগিয়ে পড়েন। পশ্চিমা হাওয়ায় সবকিছু উলোটপালোট হতে শুরু করে। টুলো পন্ডিতের কাছে সংস্কৃত পুথি মুখস্ত বা মৌলবির কাছে পারসি শিক্ষা অপেক্ষা ইংরেজ অধিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করা যেতেই পারে। বীরসিংহ গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থা পরিত্যাগ করে পিতা ঠাকুরদাস বিদ্যাসাগরকে কলকাতায় আনেন এই ভরসায় যাতে দুপাতা ইংরেজি পড়ে রোজগারের বন্দোবস্ত হয়। যদিও বিদ্যাসাগর  আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার মিলন ঘটান। এরকমভাবে অনেকেই বাংলায় নবযুগের আনয়ন করেন। পয়ার ছন্দভিত্তিক কবিতাকে পাশে সরিয়ে মধুকবি ইউরোপীয় সনেটের অনুকরণে বাংলা কবিতায় নতুন ধারার প্রচলন করেন। মঙ্গলকাব্য ও চিরাচরিত বৈষ্ণব পদাবলীর পরিবর্তে বাংলা কবিতায় মানবিক প্রেম-প্রকৃতিপ্রেমের আগমনে আধুনিক যুগের সূচনা হয়।

আধুনিক সাহিত্যের প্রধান ধারা গদ্যসাহিত্য। উপন্যাস, প্রবন্ধ সাহিত্য, সংবাদের ভাষা গদ্যসাহিত্যের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। আশ্চর্য হতে হয় বাংলায় প্রথম গদ্যের আদিরূপ প্রকাশ পায় ১৮৪৮ সালে। প্যারীচাঁদ মিত্রের 'আলালের ঘরের দুলাল' বাংলা গদ্যসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। পরবর্তীতে বিদ্যাসাগর, কালিপ্রসন্ন সিনহা, বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে বাংলা গদ্য আধুনিক রূপ পেতে শুরু করে। 
গদ্যসাহিত্য রচনার ভিত্তি হল অক্ষরবিন্যাস, শব্দগঠন ও আধুনিক ব্যাকরণ। এই কাজে ইউরোপীয়রা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। পরবর্তীতে মৃত্যঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর এবং আরো অনেক ভারতীয় ও ইউরোপীয় সুধীজনের হাত ধরে বাংলা ভাষার আধুনিক কাঠামো গড়ে ওঠে। প্রবন্ধ সাহিত্য নামে সাহিত্যের নতুন ধারা গড়ে ওঠে। সংবাদপত্রের ভাষা বিকশিত হতে শুরু করে। ইউরোপের অনুকরণে সংবাদপত্র প্রকাশ হতে শুরু করে। নিজেদের দাবিদাওয়া জানানোর মাধ্যম গড়ে ওঠে। ইউরোপ ফেরত শিক্ষিত ভারতীয়রা ইউরোপীয় সমাজের অনুকরণে সভা-সমিতির গঠন শুরু করেন। রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ হয়। ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে ওঠে।

ইংরেজ রাজত্বে ভারতীয় উপমহাদেশে আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যাবস্থার মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা শহর। ভারতীয় সংস্কৃতির নবজাগরণের কেন্দ্রও ছিল কলকাতা। ফলে কলকাতা কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক বিকাশের সাথে সাথে আধুনিক ভারতও এগিয়ে যেতে শুরু করে। শিক্ষা-সাহিত্য থেকে সবদিক দিয়ে অবশিষ্ট ভারত কলকাতা থেকে পুষ্ট হতে শুরু করে। কলকাতার সাথে সাথে অবশিষ্ট ভারতও আধুনিক হতে শুরু করে। ইংরেজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আধুনিক সড়ক ও রেলপথ, ডাকব্যবস্থার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান বৃদ্ধি পায়।
ইংরেজ বিনে আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগ হতে বেশি সময় লাগত। তাই এখনও তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমরা এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে শুরু করেছি। চীন-জাপানের মত দেশও আধুনিক শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে এসে।

এর খারাপ দিককেও অস্বীকার করা যায় না। ভারতের যে নিজস্ব শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারা ছিল, তা সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়। আজও আমরা অন্ধভাবে ইংরেজি প্রথাকেই অনুকরণ করে চলেছি। ভালো হোক বা মন্দ আমাদের নিজস্বতা বলে আর কিছু নেই।

তবু আরো একটু কল্পনায় শান দিতে দোষ কি? ইংরেজরা ভারতে না এলে রবীন্দ্রনাথ কী করতেন? সমাজচ্যুত পিরালী ব্রাহ্মণের পূর্বপুরুষেরা কলকাতায় এসে ব্যনিজ্য করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পেতেন না। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদের বাস করতে হত বঙ্গের কোন এক অখ্যাত গ্রামে। সমাজচ্যুত পরিবার তথাকথিত নীচুবর্ণের যজমানি করে দিনাতিপাত করতেন। বিদ্যাসাগর মেদিনীপুরের কোন টোলে স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপনা করতেন। রাজা রামমোহন রায় ফারসি ভাষায় শিক্ষিত হয়ে কোন আমীর-ওমরাহের দরবারে কাজে যোগ দিতেন। সম্ভাবনা তেমনই বেশি ছিল। ইংরেজ আসার আগে এমন ব্যাপকভাবে ভারতীয় সমাজে উথালপাতাল হয়নি। জগদ্দল পাথরের মত সময় এক জায়গায় আটকে ছিল। চৈতন্য বা কবীরের মত ভক্তিবাদীদের হাত ধরে ধর্মে কিছুটা উদারপন্থা এলেও তা যথেষ্ট ছিল না। যে ভারত এক সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় বাকি বিশ্বকে পথ দেখায়, গুপ্ত যুগের শেষ পর্ব থেকে তা ধর্মীয় গোড়মির চরম পর্যায়ে নিমজ্জিত হতে শুরু করে। আজকের ডিজিটাল দুনিয়া তৈরিতে প্রাচীন ভারতের উল্লেখযোগ্য অবদান আছে, কিন্তু তার পরে আর তো কোন অবদান দেখি না। পরবর্তীকালে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা আবার জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে নিজেদের অবদান রাখতে শুরু করে। সেই চতুর্বর্ণ প্রথা, সেই একই শাস্ত্র প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মুখস্ত করা, পুরোহিত ও রাজন্যবর্গ কর্তৃক নীরবে পিষ্ট হওয়া ছাড়া অষ্টাদশ শতক অব্দি অবশিষ্ট ভারত এগিয়েছে কোথায়?

ব্যবসা-ব্যানিজ্যে ভারতবর্ষ বরাবরই সমৃদ্ধ ছিল। ইংরেজ আসার আগে অব্দি ভারতীয় পণ্যের নিজস্ব বাজার ছিল। ভারতীয় বস্ত্র ও মশলা জগৎ বিখ্যাত ছিল। ইংরেজ সহ ইউরোপীয়রা ভারত আবিষ্কার করে ভারতীয় পণ্যের টানে। আরব বনিকদের ভারতীয় পণ্যের উপরে যে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল তা নির্মূল করতেই ইউরোপীয়দের এদেশে আসা। ভাবলে অবাক হতে হয় পণ্যের গুণমান রক্ষণে কতটা সততা থাকলে প্রায় দুহাজার  বছর ধরে গ্রাহকেরা ভারতীয় পণ্যে মোহাবিষ্ট হয়ে থাকতে পারে। ইংরেজরা এসে ভারতের নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। পরিবর্তে নিজ পণ্য উৎপাদন পদ্ধতি ও নীতিমালা প্রয়োগ শুরু করে। ইংরেজরা ভারতে আসে লুন্ঠনের তাগিদে। ফলে তাদের মূল নীতিই ছিল যে কোন উপায়ে সম্পদের লুন্ঠন। ভারতীয় ব্যবসায়ী ও উৎপাদকেরা যে সততার পথে চলতেন, ইংরেজ প্রভুর খপ্পরে পড়ে তা বিনষ্ট হতে শুরু করে। যে ভারতীয় বস্ত্রে পৃথিবী মোহাবিষ্ট ছিল, এখন ভারতীয়রা ম্যাঞ্চেষ্টারের কলের কাপড় পরিধান করা শুরু করেন। ইংরেজরা ভারতের নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতাকে ধ্বংস করে। যে ভারত একসময় কৃষি ও শিল্পে স্বয়ম্ভু ছিল, যে ভারতীয় পণ্যের হাত ধরে ইউরোপীয় সম্পদের আগমন ভারতের দিকে হত, সেই ভারত বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। ইংরেজরা আসার পরে ব্রিটিশ পণ্য ভারতীয় বাজার ছেয়ে ফেলে, ভারতীয় সম্পদ ইউরোপের দিকে পাড়ি দেয়। এখনো সেই ট্রাডিশনে ঘাটতি পড়েনি। বর্তমান ভারতে রপ্তানি কম, আমদানি বেশি। ব্যনিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বছরভর বেড়েই চলেছে। এমন ব্যবস্থাও ইংরেজদের দান। 

এরপরেও ছিল ইংরেজ কর্তৃক  ভারতবর্ষকে ব্যাপক লুণ্ঠন। যার তুলনায় আসতে পারে স্প্যানিশ কর্তৃক ইনকা সাম্রাজ্যের লুন্ঠন।
ব্রিটিশ ডাকাতদের দ্বারা ঠিক কত সম্পদ লুন্ঠন হয়েছে তার সঠিক হিসেব ঐতিহাসিক বা অর্থনীতিবিদেরা করতে পারেননি। তবুও এক ছোট্ট পরিসংখ্যান দেওয়া যেতেই পারে। ইংরেজরা আসার আগে ২০০০ বছর অব্দি বিশ্বের মোট সম্পদের মধ্যে ভারতের অংশীদারিত্ব ছিল ২৪-২৫ শতাংশ। আর ইংরেজরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময় তা নেমে আসে ৪-৫ শতাংশে। এই পুঁজি ভারতের মধ্যে থাকলে আমার দেশ আজ বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারত। ভারত বহু সময় বিদেশি শাসকদের পদানত ছিল। কিন্তু বিদেশি শাসকেরা পরে এই দেশকেই নিজেদের আপন করে নিয়েছেন। ফলে দেশীয় সম্পদ কোনকালেই বিদেশে পাচার হয়নি। সুলতান মামুদ বা নাদির শাহের মত কয়েকজন লুণ্ঠনকারী বাদ দিয়ে আফগান থেকে মুঘলেরা এই দেশেই তাদের সম্পদ রেখেছেন। ইংরেজদের মত এভাবে ব্যাপকভাবে দুইশত বছর ধরে কেউ ভারতীয় সম্পদ বিদেশে পাচার করেননি। ইংরেজরা এই দেশে এসে ভারতীয় অর্থ ও আত্মা দুইয়েরই লুন্ঠন করেছে। হয়তো এত বড় দেশ হত না, হয়তো আমার দেশ ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হত। কিন্তু তাও কৃষিজ ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ভারতের বিভিন্ন অংশ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই সম্পদশালী হয়ে উঠত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মত হয়তো ভারতীয় ইউনিয়ন বিশ্বের দরবারে এক বিশেষ সম্মানের আসন লাভ করত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ