উন্নয়ন ও উচ্ছেদ || রাণা


গ্রামের বটবৃক্ষেরা বলতেন, সেই ইংরেজ আমলে ধবধবে সাদা সাহেব এসেছিল। আর এসেছিল বাঘ, গ্রামের খুব কাছাকাছি জঙ্গলে। এছাড়া গ্রামের জীবন ছিল ভীষণ নিস্তরঙ্গ। সরকারি বাবুরা কদাচিৎ গ্রামে আসতেন। তা নিয়ে গ্রামের লোকেদের কোন অভিমানও ছিল না। ভোট এলে ভোট দিত। নির্বাচনের ফলের পর গ্রামের মানুষ বুক ফুলিয়ে জানিয়ে দিত, যে জিতেছে তাকে ভোট দিয়েছি। এত সাহসী মানুষ খুব কম গ্রামে পাওয়া যায়! এমন সাহসী গ্রামে রাজনৈতিক হানাহানিও তাই হয়নি।

লটিয়াবনী ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম। বাঁকুড়ার শাল-পলাশের জঙ্গল ঘেরা এই গ্রামে দারিদ্র ছিল, শান্তিও ছিল। প্রায় ৩৫০ পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা এই গ্রামে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় সবকিছু নিজেরাই মিটিয়ে নিত। অন্যের উপরে ভরসা করতে হত না। এক বা দু ফসলি জমিতে ধান আর মরসুমি শাকসবজি, মাঠে অনাদরে বেড়ে ওঠা শাক - খাবারের অভাব ছিল না। আম-জাম-কাঠালের মত মরসুমি ফলও এর ওর গাছে হত। তিরিশ বছর আগে বিনিময় প্রথাও চলত। চালের বিনিময়ে সবজি বা অন্যকিছু। তিরিশ বছর আগে অব্দি গ্রামে কারো বাড়িতেই দরজা ছিল না। দরজা লাগানো মানে প্রতিবেশীদের অপমান করা। নিজেদের লোকেরা আবার চুরি করে নাকি!শহর বা গঞ্জবাসীদের দেখিয়ে গ্রামের লোকেরা গর্ব করে বলত, ওদের শরীর দেখো, হবে নাই বা কেনো! সব ভেজাল। আর আমদের অক্সিজেনেও বিষ নেই। সবার কি আর সারাজীবন সুখ সয়!

আশির দশকের প্রথমার্ধে কংগ্রেসি সরকার লটিয়াবনী সংলগ্ন বৃহৎ জায়গা নিয়ে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী এসে শিলান্যাসও করেন। কিন্তু প্রকল্পের কাজ বিভিন্ন কারণে থমকে থাকে। পরে  দীর্ঘ টালবাহানার পর ১৯৯৬ সালে মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নামে পথ চলা শুরু করে। জঙ্গল ও কৃষিজমির উপরে এই কারখানা স্থাপন হয়। বিভিন্ন গ্রামের মানুষ সানন্দে তাদের জমি কারখানা কর্তৃপক্ষকে নামমাত্র দামে বিক্রি করে দেন। অনেক পরিবার থেকে এই কারখানায় চাকরি পান। অর্থনীতি ও পরিবেশ দুটোই পাল্টাতে শুরু করে।

একসময় যে গ্রামে বিনিময় প্রথা চালু ছিল, সেখানে মানুষ টাকা দিয়ে বহুজাতিক পণ্যের স্বাদ পেতে শুরু করেন। আগে যেখানে পণ্য ও যাতায়তের মূল মাধ্যম ছিল গোরুর গাড়ি ও সাইকেল, সেখানে মানুষের কাছে যন্ত্রচালিত দুই ও চারচাকা সহজলভ্য হয়ে ওঠে। ভাগচাষীরা কারখানা বা অনুসারী শিল্পে ঠিকা শ্রমিক হিসাবে অর্থলাভ করতে থাকেন। কৃষিজীবি থেকে শ্রমজীবিতে উত্তরণের এক জীবন্ত কাহিনী।

উন্নয়ন ও আত্মিক সুখ একে অপরের পরিপন্থী। লটিয়াবনীর অধিবাসীরাও ধীরে ধীরে বুঝতে পারে এ উন্নয়ন নয়, কারখানা এক দূষণ দৈত্য। গ্রামকে গোল করে ঘিরে মূল কারখানা ও ছাইপুকুর স্থাপিত হয়। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যে বিপুল পরিমাণ ছাই নির্গত হয়, তা ঐ ছাইপুকুরে ফেলা হয়। নিয়ম হচ্ছে পুকুরগুলো জল দিয়ে ভরাট করে রাখতে হয়, যাতে ছাই আর্দ্র অবস্থায় থাকে ও শুকনো ছাই যাতে না ওড়ে। কোন শিল্প আর সাধারণ মানুষের কথা ভাবে?


উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ছাই উড়তে শুরু করে। উন্নয়নে বিভোর গ্রামবাসী তা খুব একটা পাত্তা লাগায় না। পরে সমস্যা বাড়তে থাকে। যে দিঘি একসময় গ্রামের মানুষদের পানীয় জল জোগাতো, তা পোষ্যদের স্নানেরও অনুপযোগী হয়ে ওঠে। দুফসলি জমির উপরে ছাইয়ের পুরু আস্তরণ পড়তে থাকে। বাড়ির ছাদে ছাই জমতে থাকে। গ্রামজুড়ে ছাই উড়তে থাকে।

প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের পম্পেই শহর ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাতের ফলে ধ্বংস হয়ে যায়। তার আগে পম্পেই শহরে ছাই উড়তে শুরু করে। প্রকৃতির রোষ কয়েকদিনই ক্ষণস্থায়ী ছিল। আর মনুষ্যসৃষ্ট এই ছাই কুড়িবছর ধরে লটিয়াবনী গ্রামে উড়েই চলেছে। মনে হয় প্রকৃতির থেকে মানুষের ধ্বংসকারী ক্ষমতা অনেক বেশি।

এখন গ্রামবাসীদের অভিমান হয়,  সরকারের কেউ কেন গ্রামে আসে না? কেন তাদের দুর্দশার প্রতিকার হয় না? যে গ্রাম কখনো সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেনি। নিজেদের প্রয়োজন নিজেরাই জুগিয়ে নিয়েছে, তারাই এখন এর-ওর কাছে আবেদন নিবেদন করছে। "স্যার আমাদের উচ্ছেদের নোটিস দিন। পুনর্বাসন দিন।" উন্নয়ন হয়তো মানুষকে পরজীবি করে তোলে। নিজেদের পা ভুলে ভিক্ষার ডান্ডা নিয়ে ছুটতে হয়।

মানুষ যখন 'সভ্য' হয়নি, তখন আগুনের চারধারে বসে মিলেমিশে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে নিতে যুথবদ্ধ ভাবে শিকার ভাগ করে নিত। কৃষিব্যবস্থার উত্তরণেও এই গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে প্রভাব ফেলেনি। আধুনিক সভ্যতা মানেই কি তাহলে যুথবদ্ধ ব্যবস্থার ভাঙন?


লটিয়াবনীরও উত্তরণ হয়েছে। আদিম আয়েশি জীবন থেকে সভ্যতার দিকে। বাসস্থান ছেড়ে উচ্ছেদের পথে। প্রকৃতির অক্সিজেন ছেড়ে ফুসফুসে সভ্যতার গরল নিতে। কৃষিজীবি ভুলে শ্রমজীবি হতে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ