#অযাচিত_বাক্যব্যয় পর্ব- #পর্দাপুরাণ...!।। সব্যসাচী সরকার



জয়িতা দাস -এর “পর্দাপুরাণ” গবেষনাধর্মী তথ্যসমৃদ্ধ একটি বই; যেখানে লেখিকা চারদেয়ালের অন্তঃপুরে নারীর জীবন, সামাজিক পর্দাপ্রথার আড়ালে ঘঠিত জীবনাচরণ, সংগ্রাম, নিষ্পেষণ হতে শুরু করে সামগ্রিকভাবে নারীর স্বতন্ত্র অবস্থানটুকু জাতি, ধর্ম, বর্ণ, উচ্চবর্গ, নিম্নবর্গ সহ সমাজের  সকল স্তরে কিভাবে প্রবাহমান, কি তাঁর বৈচিত্র্যময় রূপ- তার একটি বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা প্রদর্শিত হয়েছে; পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী'র স্বাধীনতা বলতে পুরুষের অধীনস্থতার স্বীকারোক্তি যেনো, নারী যেনো একটি বস্তুগত উপাদান, যার রক্ষণাবেক্ষণের সকল দায় পুরুষের; নারীর স্বতন্ত্র অস্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ নিম্নবিত্ত অংশে যতটা দূরহ ছিলো, উচ্চবিত্ত বৃহদাংশ জুড়ে এর বিস্তর প্রভাব ছিলো, যা লেখিকার কলমে কাঠখোট্টা সত্য হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে; এছাড়াও বিবাহ-পার্বণ-এ আচার নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনাও টানা হয়েছে এ বইটিতে; বোধহয় তথ্যের প্রাচুর্যতাই বইটির কলেবরে ৩২৮পৃষ্ঠার সংযোজনে প্রণোদিত করেছে লেখিকাকে; পাঠক নির্মোহ চিত্তে অবগাহন করতে পারবে এটি পঠনে, দৃশ্যপট পড়তে পড়তে যেনো দৃশ্যমান হতে শুরু করবে; তেমনি কিছু সরল পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি পাঠকপ্রিয়তা সৃষ্টিতে-

সূচি'র নামকরণে লেখিকা দূরদর্শীতা লক্ষ্যনীয়, অর্থাৎ শিরোনামেই পাঠক মনে প্রশ্নের উদ্রেক হবে, যেমন- “পিঞ্জরে সোনার পাখি”; বাকি সূচি গুলোও এমনি সূত্রে গাঁথা;

প্রারম্ভিক কথন- “মা বোনেরা, বেপর্দা হবেননা। খোদাতালা মহামূল্যবান রত্নের থেকেও আপনাদের ইজ্জত দান করেছেন। আপনারা খেয়াল করেছেন- তুলো গুল কয়লার গোলায় মালপত্র বাইরে ফেলে রাখা হয় খরিদ্দারকে দেখানোর জন্য, কখনো কি দেখেছেন সোনা হীরা মণিমুক্তা ওইভাবে বাইরে রাখা হয়? প্রথমে সাটার গেট, তারপর লোহার মজবুত গ্রিল, ভিতরে লকার সেফটি ট্রাঙ্ক, তার ভিতরে সযত্নে মহামূল্যবান রত্ন রাখা হয়। আপনারাও তেমনি পর্দা পুশিদায় থাকবেন।”

»বর্ধমানের এক আলেম সাহেবের মন্তব্য, আনসারউদ্দিন, গ্রামের মুসলিম নারীজীবন, মেয়েদের কথাকল্প।«

উল্লেখিত অংশে পাঠকের অনুভূতি একটু হলেও সাড়া দিবে, যাক তা কিরূপ হবে তা না হয় পাঠকের উপর ছেড়ে দিই, আর আরো কিছু অংশ নিয়ে কথোপকথন চালিয়ে যাই;

হাঁসাড়া গ্রামের জমিদারবাড়ির বিয়ের গল্প প্রতিভা বসু শুনিয়ে গেছেন, ‘কুলীন বাঙাল’- এর চল বা প্রথা ছিলো বিয়েতে, কেমন ছিলো তা জানতে নিশ্চয়ই ইচ্ছে হচ্ছে, তা'হলে লেখিকার লেখা হতেই সংক্ষেপে টানছি-

“...সেকালে বড়মানুষদের মধ্যে টাকা দিয়ে কুল কেনার চল ছিলো। হাঁসাড়ার জমিদারবাড়িতেও ছেলেদের বিয়ের সময় কনে হিসেবে কুলীন পরিবারের মেয়ে যৌতুক দিয়ে কিনে আনা হতো। বিয়ে হতো নিজেদের বাড়িতেই। এঁরা বলতেন ‘কুলীন বাঙাল’ প্রথা। তো একবার এই জমিদারবাড়িতে দুইভাই-বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে একইদিনে... ... ছেলের জন্য পছন্দসই কুলীন কন্যে জোগাড়ের কাজটি অভিভাবকরা অনেক আগেই সেরে রেখেছেন। হবু কনেকেও তাঁর আত্মীয়স্বজন সহ তুলে আনা হয়েছে। বিয়ে শেষ না হওয়া অবধি এই নতুন কুটুমরা জমিদারবাড়ির অতিথি...

...সেকালের লোকেরা ছিলেন ‘বড়ো পরিবার সুখী পরিবার’ তত্ত্বে বিশ্বাসী... ... তা জমিদারবাড়ির মেয়ে আর কুলীন কনে তো সাজগোজ করে ছাঁদনাতলায় এলেন। দুজনকে সাজানো হয়েছে একইরকম করে। কারো সাধ্যি কী যে দেখে বুঝতে পারে কে কোন কনে! ফলে বিয়ের আসরে এক মারাত্মক ভুল হয়ে গেলো। কুলীন মেয়েটিকে ভুল করে নিয়ে বসিয়ে দেয়া হলো জমিদারবাড়ির মেয়েটির বরের পাশে, আর ভাইয়ের পাশে তাঁর নিজের বোনটিকে। দুজনের পরনেই লালচেলি, একবুক ঘোমটা টানা- কেউ এই ভুল ধরতে পারছেনা। দুই বরও কনে বদলের কিছু টের পাননি। বোন কিন্তু ঘোমটার ফাঁকে কীভাবে যেনো দেখে ফেললেন ভাইয়ের মুখ। তাঁর মনের অবস্থাটা এবার পাঠক চিন্তা করে দেখুন! 

সেকালের পুরুষদের সঙ্গে তো দূরের কথা, বাড়ির গিন্নিদের সঙ্গেও মেয়েদের কথা বলার চল ছিলোনা। বিয়ের কনে এই ভরা সভায় কথা বলেন কি করে! তবু যাই হোক, বাপের বাড়ি বলে রক্ষে! বোনটি কাঁদতে কাঁদতে ভাইকে বলেন, ‘সোনাদা, আমি টুনি।’... ... ‘গরু চিনি বলনে, নারী চিনি চলনে’?- নারীর চলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে অন্তঃপুরে তখন বিধিনিষেধের কত না ঘটা।”

উপরোল্লিখিত ঘটনা চিত্রে লেখিকা তৎকালীন সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর মাঝের নারীর চলাফেরায় নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ নিয়ে কড়চা করেছেন; অর্থাৎ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের তালিকাটি বোধহয় নারীদের জন্যে বেশ লম্বাই ছিলো;

আরেকটি ঘটনার উদ্ধৃতি টানছি- “...কল্যাণী দত্তের এই অভিজ্ঞতা বিশ শতকের প্রথমপর্বে। তখন মেয়েদের ভয় দেখাতে কত মিথ্যেই না বলতেন অভিভাবকরা। কল্যাণী দত্তদের বাড়িতে মেয়েদের ভয় দেখানোর জন্য বলা হত, ভগবান ঘুমোনোর সময় মেয়েদের দেহে শিশুদের রেখে যান। অন্তঃসত্ত্বা হবার ভয়ে কুমারী মেয়েরা তাই ঘুমের মধ্যেও সতর্ক থাকতেন। ‘এ ভয়েতেই হাঁ-মুখ করে ঘুৃমোতাম না, যদি...।’ কল্যাণী দত্তের স্বীকারোক্তি...”

উপরোল্লিখিত ঘটনাটি তৎকালীন নারীসমাজে প্রচলিত কুসংস্কার গুলোও নারীর স্বাধীন জীবনযাপনের কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলো তা লক্ষ্যনীয়; এরকম পর্যাপ্ত ঘটনার উল্লেখ লেখিকার বইটিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে প্রতিটি পৃষ্ঠায়;

পর্দাপ্রথার প্রভাব সকল সম্প্রদায়ে বিভিন্নভাবে তার অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলো, এর আরো কিছু উদাহরণ টানছি লেখিকার লেখা হতেই, বিষয়বস্তু এখানে চিকিৎসা বিষয়ে সচেতনতা নিয়ে- 

“...মুসলমান বাড়ির অবস্থা আরো করুণ। সাধারণত মেয়েরা অসুস্থ হলে রোগীর অবস্থা শুনেই ডাক্তার ওষুধ দিতেন। অসুখ কঠিন হলে কখনো কখনো ডাক্তার রোগীকে পরীক্ষা করে দেখতে চাইতেন। তা ডাক্তার চাইলেই তো আর রোগী কে ডাক্তারের সামনে নিয়ে আসা যায়না। বাড়ীর লোকেরা আগে রোগীর পর্দার একটি সুবন্দোবস্ত করে তবে ডাক্তারকে ডেকে পাঠাতেন। সেই ব্যবস্থা  বেশ অভিনব। রোগীকে প্রথমে একটি বিছানায় মশারির ভেতর শুইয়ে রাখা হত। পরে চারপাশে মোটা চাদর দিয়ে মশারিটা ভালো করে ঢেকে দেওয়া হতো। ডাক্তার এসে বসতেন সেই বিছানার পাশে একটি চেয়ার নিয়ে। রোগী মশারি থেকে হাত বের করত না, ডাক্তার মশারির ভিতর হাত ঢুকিয়ে রোগীর নাড়ি পরীক্ষা করতেন। ...ডাক্তার স্টেথোস্কোপ কানে লাগিয়ে তার অন্য দিকটা মশারির ভিতর পাঠিয়ে দিতেন। আর ভেতরে বসা (ছোট) ছেলেটির হাত উঠানামা করতো ডাক্তারের নির্দেশ মতো। ‘রবারের নইলে মশারির চাদরের বসায় আর অনভ্যস্ত হাতের কল বসানোতে ডাক্তার যতটা বুঝতে পারতো, তাতেই ওষুধ দিত। আয়ু থাকলে বাঁচত, না হয় মরত। ...মা-নানিরা বলাবলি করতেন, মেয়েদের মান সম্মানের সাথে মরাই তো ভালো।’

...হিন্দু লেডি ডাক্তাররা মুসলিম পরিবারের রীতি রেওয়াজের সঙ্গে ততটা পরিচিত নন। ফলত চিকিৎসার সময় নানা সমস্যা দেখা দিত। এই সমস্যার সমাধান করতে গেলে অবিলম্বে স্বধর্মী মহিলা ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু তখনো মুসলিম পরিবারের কোনো মেয়ে ডাক্তারি পড়তে শুরু করেননি। ১৮৭৪ সালের জানুয়ারি মাসের ‘বালারঞ্জিকা’য় এ প্রসঙ্গে একটি খবর প্রকাশিত হয়:-

A correspondent of the (Bala Rnjika), Abdoor Rohim, of Gopalpore, says that the non-existence of female Mohamedan physicians is a source of in calculable mischief. As Purdahnusheen Mohamedan women, can not, in strict conformity with their usage, show themselves to any but their own relations, they suffer much, and in many cases die simply for want of female physicians. He, therefore, calls upon his

co-religionists to consider his proposal to give Medical Education to poor Mohamedan women, who would be only too glad to earn a livelihood by the practice of the healing art, and to see that it is carried into effect. ”

“...১৬৬২সালে তিন তিনবার আগুন লেগেছিল রাজধানী দিল্লিতে। বার্নিয়ের ছিলেন সেই অগ্নিকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে বার্নিয়ের সেই অভিজ্ঞতার কথাই বর্ণনা করে গেছেন। শাজাহানের প্রিয়তমা কন্যা জাহানারাও একবার তাঁর এক প্রিয় নর্তকী গুলরুখকে বাঁচাতে গিয়ে আগুনে বীভৎসভাবে পুড়ে যান। তবু শাহজাদির মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোয়নি। এই ঘটনার দুশো বছর পরেও উনিশ শতকের শেষপর্বে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের হারেমে কখনো অসাবধানতাবশত আগুন লাগলে অনেক মহিলাই আগুনে পুড়ে মরেছেন, কিন্তু হারেমের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেননি।...”

এভাবে লেখিকা তাঁর লেখনি সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারী সমাজে পর্দা কিরূপ প্রভাব বিস্তার করে বর্তমান অবস্থায় এসেছে, তার একটি ঐতিহাসিক রূপরেখা অঙ্কনের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন; পাঠক এ বই পঠনে পর্দারীতির একটি সরব চিত্র সম্পর্কে জ্ঞাত হবেন বলেই আশ্বস্ত করা যায়।

সবশেষে আরো একটি ঘটনার উদ্ধৃতি টেনে শেষ করবো-

“...ঠাকুরবাড়ির আর এক কীর্তির সাক্ষী হল শহর কলকাতা। সেটা ২৬ফেব্রুয়ারি ১৮৮১ সালের কথা। ...‘বৎসরে একবার দেশের সমস্ত সাহিত্যিকগণকে একত্র করিবার অভিপ্রায়’-এ ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’ নামে একটা সভা স্থাপিত হয়েছে। তা এই বিদ্বজ্জন সভা উপলক্ষ্যেই জোড়াসাঁকোতে অভিনীত হল ‘অভিনব গীতিনাট্য - বাল্মীকিপ্রতিভা’। এই নামটির মধ্যেই অক্ষয় হয়ে রইল নারীমুক্তির এক ইতিহাস। নামকরণের এই ইতিহাস প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন, ‘আমি বাল্মীকি সাজিয়াছিলাম এবং ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভা সরস্বতী সাজিয়াছিল; বাল্মীকিপ্রতিভা নামের মধ্যে সেই ইতিহাসটুকু রহিয়া গিয়াছে।’ ...এই প্রথম কোনো ভদ্র পরিবারের মেয়ে রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করলেন প্রকাশ্যে অনাত্মীয় পুরুষদের সামনে। তখন তাঁর বয়স চোদ্দ-পনেরো। ...অন্তঃপুর থেকে বেরিয়ে এসে মেয়েরা প্রকাশ্যে অভিনয় করছেন- সেকালে এই ঘটনা ছিলো চমকে দেয়ার মতো। রক্ষণশীলরা অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেননি। ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘পিরালি বামুন তো, ওদের আবার সমাজ কী!’।

...এককালে বাড়ির কর্তারা বারবাড়ি থেকেই রক্ষিতার বাড়ি ছুটতেন। অন্তঃপুরে অসহায় অবহেলিত বধূরা নীরবে এই অপমান মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। অবশ্য হাতে টান পড়লে বাবুরা ঠিকই ফিরে আসতেন অন্তঃপুরে। ... পরিবারের প্রতি ওয়ালিউল্লাহ্ সাহেবের এই অবহেলা সুফিয়া সহ্য করতে রাজি নন। সুফিয়ার জন্ম ১৯২৩ সালে। তবে মুসলিম পরিবারের মেয়েরা তখনো পদার্নশিন। সুফিয়াকেও পর্দা মানতে হয়। তা পর্দা মেনেই সাহেবের তাসের আড্ডায় বন্ধুদের বাড়িতে তিনি যাতায়াত শুরু করলেন। ইচ্ছে, এদের বিবিদের নিয়ে দল পাকিয়ে তাসের আড্ডা ভণ্ডুল করা।

... বিশ শতকের মেয়েরা এমনি করেই ধীরে ধীরে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন...”।

পর্দাপুরাণ বইটির নারীর সমাজচিত্র ধারাবাহিক পরিবর্তন গুলো পরিস্থিতি মাফিক কিরূপে এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সাথে লড়তে লড়তে আজকের অবস্থায় এসেছে সেটিই প্রতিফলিত হয়েছে এখানে; নারীর মানুষ হয়ে উঠার এ রোমাঞ্চকর যাত্রায় সঙ্গী হওয়ার আমন্ত্রণ রইলো...!🍁🍁🍁

[২০১৮ সালের কোনো একসময় লিখেছিলাম আমার পাঠক অনুভূতি, কষ্টেসৃষ্টে খুঁজে পেলাম...!]


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ