মানব সিংহ, একপাল নেকড়ে ও এক মাড়োয়ারি বিশ্বাসঘাতকের গল্প ।। রানা চক্রবর্তী



বিংশ শতাব্দীর শুরুর একটা সময় কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামের মানুষ আতংকিত হয়ে উঠল। পাশের জঙ্গলে বিশাল একটি বাঘ দেখা গেছে। বাঘটির ভয়ে দিনের বেলায়ও কেউ রাস্তা-ঘাটে বের হয় না। রাতে তো কথাই নেই। বাঘটি প্রায়ই গ্রামের গরু, ছাগল খেতে শুরু করল। অতিষ্ঠ হ’য়ে উঠল গ্রামের মানুষ।

কয়া গ্রামে একটিই বন্দুক আর তা ছিল ফণিভূষণ বাবুর। গ্রামের জান-মাল রক্ষায় তিনি জীবনবাজী রেখে বাঘটিকে মারার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই সময়ে কৃষ্ণনগর থেকে মামা বাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন তরুণ যতীন্দ্রনাথ। মামাত ভাই ফণিভূষণ বাঘ মারতে যাবেন শুনে যতীন্দ্রনাথ তাঁর সাথে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। মামাবাড়ির সবাই যতীন্দ্রনাথকে যেতে নিষেধ করলেন। কারণ বন্দুক একটি, খালি হাতে যতীন্দ্রনাথ যাবেন কি করে, বাঘ যদি তাকে আক্রমণ করে? কিন্তু যতীন্দ্রনাথ কারও কথা শুনলেন না। খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে তিনি একটি ভোজালি নিয়ে দুপুরের পর ভাই ফণিভূষণের সাথে বাঘ মারতে রওনা হলেন।
 
শুরু হল বাঘ খোঁজা। ফণিবাবু ও যতীন্দ্রনাথ গ্রামের পাশের জঙ্গলের কাছে একটি বড় মাঠের মাঝে গিয়ে উপস্থিত হলেন। যতীন সেই মাঠের চারদিক দেখছিলেন আর ফণিভূষণ মাঠের এক প্রান্তে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছেন। গ্রামের মানুষ জঙ্গলের পাশে দাঁড়িয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ পর যতীন যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, সেইদিক দিয়ে বাঘ বেরিয়ে এল। বাঘ দেখে গ্রামের মানুষ ভয়ে পালাতে শুরু করলেন। ফণিভূষণ বাঘটি লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন। গুলি বাঘের মাথা স্পর্শ করে চলে গেল। বাঘ আহত না হয়ে বরং আরো ক্ষিপ্ত হয়ে যতীনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আক্রান্ত যতীন বাঘটিকে বাম বগলের মধ্যে চেপে ধরে বাঘের মাথার উপর সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ভোজালি দিয়ে আঘাত করতে শুরু করল। বাঘও যতীনকে কামড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। চলতে থাকে বাঘে-মানুষে লড়াই। বাঘ নখ দিয়ে যতীনের সমস্ত শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে চলল। তাঁর হাঁটুতে একটা কামড়ও বসিয়ে দিল। কিন্তু যতীন জানতেন বাঘটিকে না মারতে পারলে তাঁর রক্ষা নেই। তাই জীবন বাঁচানোর লড়াই চালিয়ে গেলেন তিনি। অন্যদিকে বাঘটিকে গুলি করার জন্য ফণিভূষণ বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। কারণ বাঘের সাথে যতীন যেভাবে গড়াগড়ি করছিলেন, তাতে গুলি ছুড়লে সেটি যতীনের শরীরে লেগে যেতে পারে। এভাবে প্রায় ১০ মিনিট লড়াই করবার পর যতীন বাঘটিকে মেরে ফেললেন এবং নিজে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।

মৃত বাঘ ও অচেতন যতীনকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। গ্রাম্য ডাক্তার দেখানোর পর যতীন একটু সুস্থ হলেন। কিন্তু তার শরীরের প্রায় ৩০০ স্থানে ক্ষত দেখা গেল। ডাক্তার তাঁর অবস্থা দেখে তাড়াতড়ি কলকাতায় নিয়ে যেতে বললেন। যতীনের মেজ মামা হেমন্তকুমার তখন কলকাতায় ডাক্তারি করতেন। মামার কাছে তাঁকে পাঠানো হল। হেমন্তকুমার ভাগ্নের অবস্থা আশংকাজনক দেখে কলকাতার সেকালের বিখ্যাত সার্জন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারীর উপর চিকিৎসার ভার দিলেন। প্রখ্যাত এই ডাক্তারও যতীন্দ্রনাথকে বাঁচানোর ও পুরাপুরি সুস্থ করার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। যতীন মাসখানেক পর একটু সুস্থ হয়েছিলেন কিন্তু তাঁর পায়ে পচন ধরেছিল। ডাক্তার তাঁর পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু যতীনের মামাদের আপ্রাণ চেষ্টা ও ডাক্তারদের সুচিকিৎসার ফলে শেষ পর্যন্ত তাঁর পা দুটি রক্ষা পেয়েছিল। ডাক্তার সুরেশ প্রসাদ সর্বাধিকারী যতীনের বীরত্ব আর অদম্য আত্মবিশ্বাসে বিস্মিত হয়েছিলেন এবং তাঁকে ‘বাঘা যতীন’ নামে ভূষিত করেছিলেন। মানুষের কাছে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন ‘বাঘা যতীন’।

তাঁর এই তেজের সূত্রপাত কৈশোর থেকে। একটা পাগলা ঘোড়াকে কাবু করে এক শিশুকে বাঁচিয়েছিল কিশোর যতীন। কলকাতার রাস্তাতেও ইংরেজ সেনাদের উদ্ধত ব্যবহার সহ্য না করতে পেরে তাঁদের বেদম পিটিয়েছিলেন তিনি। এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন দার্জিলিং যাওয়ার পথে শিলিগুড়ি স্টেশনেও। সেখানেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করে কয়েক জন ব্রিটিশ সামরিক কর্মচারীকে উত্তমমধ্যম দিয়েছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই বাঘা যতীন অকুতোভয়। স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। প্রতিদিন গীতা পাঠ করতেন। সে অভ্যেস তাঁর রয়ে গিয়েছিল আজীবন। মহুলডিহার শালবনে অজ্ঞাতবাসে থাকার সময়ও শিলাসনে বসে উদাত্ত গলায় গীতা পাঠ করতেন। সাক্ষী ছিলেন তাঁর সঙ্গী নলিনীকান্ত কর। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, "আমরা সেই অপরূপ রূপ দেখতে দেখতে আত্মহারা হয়ে যেতাম। মনে হত যেন গৌতম মুনি স্বয়ং বেদমন্ত্র উচ্চারণ করছেন।"

“তোমার গালে যদি কেউ এক চড় মারে, তাকে যদি দশ চড় ফিরিয়ে না দাও, তুমি পাপ করবে। ঝাঁটা লাথি খেয়ে চুপটি করে জীবন যাপন করলে, ইহকালে নরকভোগ, পরকালেও তা-ই”।

স্বামী বিবেকানন্দ পরাধীনতার শিকল ছিঁড়তে বাঙালিদের উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে উপরের উক্তিটি করেছিলেন। ভেবেছিলেন হয়তো বাঙালি যখন পাল্টা আঘাত করতে শিখবে তখনই কেবল মুক্তি সম্ভব। আঘাতের বিরুদ্ধে আঘাতের কোনো বিকল্প নেই বলেই মনে করতেন স্বামীজি। তাঁর চিন্তা বা চেষ্টা বিফলে যায়নি। অনেকেই তার চিন্তা এবং বাণী গ্রহণ করেছেন সাদরে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

বাঘা যতীন যদি ইংরেজ হতেন, তা হলে ইংরেজরা ট্রাফালগার স্কোয়্যারে নেলসনের পাশে তাঁর স্ট্যাচু বানিয়ে দিতেন।’— বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে বলেছিলেন ব্রিটিশ পুলিশ চার্লস টেগার্ট। বালেশ্বরের যুদ্ধে যাঁর পরিকল্পনা মতো এগিয়ে ব্রিটিশ সেনা শেষ করেছিল যতীন্দ্রনাথকে। বাঘা যতীনকে তিনি বলেছিলেন ‘ডিভাইন পার্সোনালিটি’, তুলনা করেছিলেন ইংল্যান্ডের বীর যোদ্ধা হোরাসিও নেলসনের সঙ্গে।

একই ধরনের কথা শ্রী অরবিন্দের লেখাতেও পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন, "তিনি (বাঘা যতীন) ছিলেন অভিনব ব্যক্তি। মানবতার পুরোভাগে ছিল তাঁর ঠাঁই। এমন সৌন্দর্য ও শক্তির সমন্বয় আমি দেখিনি, আর তাঁর চেহারাই ছিল যোদ্ধার অনুরূপ।"

বিপ্লবী অতুলকৃষ্ণ ঘোষ লিখেছিলেন, "শিবাজীর মতো রণকুশলী ও চৈতন্যের মতো হৃদয়বান একাধারে পেলে আমরা পাই যতীন্দ্রনাথকে।"

তাঁকে ‘ভারতীয় বিপ্লবের গ্যারিবল্ডি’ বলেছিলেন যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়।

বাঘা যতীনের জীবনের নানা ঘটনা জানা যায় যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের বই ‘বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি’ থেকে। যেমন, এক বৃদ্ধার ঘাসের বোঝা তাঁর কাছ থেকে নিজে মাথায় করে নিয়ে তাঁর ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আর একবার ওলাওঠা রোগীর মলমূত্র নিজের হাতে সাফ করে তার সেবা করেছিলেন। আর এক বার তো পুরো বেতন অন্য এক জনকে দিয়ে তারই কাছ থেকে পাঁচ পয়সা ধার করে ট্রামে করে বাড়ি ফিরেছেন। শ্রান্ত, যন্ত্রণাকাতর সহযোদ্ধাদের নিজে হাতে শুশ্রূষা করতেন যতীন। গরমের দিনে পাখার বাতাস করে ঘুম পাড়াতেন তাঁদের। যাদুগোপাল তাঁর বইয়ে লিখছেন, "শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিতে তিনি এত বলীয়ান ও উচ্চস্তরে বিচরণ করতেন যে, তাঁর সঙ্গে তুলনা করতে পারি এমন দ্বিতীয় ব্যক্তি চোখে ঠেকেনি। মানুষ হয়তো পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। কিন্তু পূর্ণতার কাছাকাছি যারা পৌঁছেছেন, তাঁদের মধ্যে যতীন্দ্রনাথের স্থান সুনিশ্চিত।"

১৯১৩ সালে বর্ধমান ও কাঁথির ভয়াবহ বন্যায় ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই সময়ের কথা জানা যায় ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে, "যতীনদা বসেছেন উদার আকাশের নীচে দৌলতপুর কলেজ হোস্টেলের দোতলার খোলা বারান্দায়। গভীর রাত। আমি একলা ওঁর দিকে চেয়ে বসে। যতীনদার ওই মুখখানা, ওই চোখ দুটো, ওই বুকখানার সঙ্গে ওই আকাশখানার কোথায় যেন যোগ আছে, কোথায় যেন মিল আছে।"

এই মানুষটাই কিন্তু বিদেশি শক্তির সাহায্যে প্রথম দেশ স্বাধীন করার কথা ভেবেছিলেন। জার্মান জাহাজ ধরা পড়ার খবরে শান্ত ভাবে তিনি বলেছিলেন, "আমরা বিদেশের সাহায্যে ভারতকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলাম। দেশ কিন্তু নিজের জোরে দাঁড়াবে। অপরের সাহায্যে নয়।"

বালেশ্বরের অজ্ঞাতবাস থেকে দিদি বিনোদবালাকে চিঠিতে যতীন লিখেছিলেন, "সংসারে সমস্তই যে কত অস্থায়ী তাহা আপনি অনেক প্রকারে দেখিয়াছেন এবং বুঝিয়াছেন। এই অস্থায়ী সংসারে অস্থায়ী জীবন যে ধর্মার্থে বিসর্জন করিতে অবকাশ পায়, সে তো ভাগ্যবান।"

বাঘা যতীন জন্মেছিলেন ১২৮৬ সালের ২১ অগ্রহায়ণে (১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর)। তৎকালীন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার কয়া গ্রামের মাতুলালয়ে। বাবা উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মা শরৎশশী দেবী। তাঁদের আদি নিবাস ছিল যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার রিশখালী গ্রামে। বাঘা যতীনের ৫ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। এরপর মা ও বড়বোন বিনোদবালার সাথে তিনি মাতামহের বাড়ি কয়া গ্রামে চলে আসেন। স্বভাব কবি মায়ের আদর-স্নেহে মাতুলালয়েই তিনি বড় হতে থাকেন। এখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর।

পরিবারেই যতীনের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। শরৎশশী দেবী ছেলেকে আদর্শবান ও স্পষ্টভাষী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রাথমিক লেখাপড়া শেষে বড় মামা বসন্ত কুমার দুরন্ত স্বভাবের যতীনকে কৃষ্ণনগরের অ্যাংলো ভার্ণাকুলার হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। স্কুলের পড়াশুনা আর খেলাধূলার পাশাপাশি ঘোড়ায় চড়া, শিকার করা, মাছ ধরা, গাছে চড়া, দৌড়-ঝাঁপসহ নানা দুরন্তপনায় মেতে থাকতেন যতীন। পড়াশুনায় ভাল, দুষ্টমিতে সেরা ও স্পষ্টভাষী, এসব গুণের কারণে যতীন তাঁর সহপাঠী ও শিক্ষক মহলে প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। পাড়া-মহল্লা ও স্কুলে নাটকে অভিনয়ও করতেন তিনি। মামারা খুব ভালবাসতেন ভাগ্নেকে। তাই বড় মামা যতীনকে নিয়ে যেতেন সবখানে এমনকি কুস্তি খেলা দেখতেও নিয়ে যেতেন তাঁকে। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বড়বোন বিনোদবালা যতীনকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের গল্প, রানাপ্রতাপ, শিবাজী, সীতারাম রায়ের কাহিনী শোনাতেন। এসব ইতিহাস শুনে শিশু যতীন বড়বোনকে প্রায়ই বলতেন, “আমি বড় হয়ে ইংরেজদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেব”।

অ্যাংলো ভার্ণাকুলার হাইস্কুল থেকে তিনি ১৮৯৮ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এন্ট্রান্স পাস করেন। এরপর ক্যালকাটা সেন্ট্রাল (বর্তমানে ক্ষুদিরাম বোস কলেজ) কলেজে ফাইন আর্টস এ পড়ার জন্য মেজমামার কাছে কলকাতার শোভাবাজারে চলে যান। এখানেই তিনি উপার্জনের লক্ষ্যে অ্যাটকিনসনের কাছে শর্টহ্যান্ড ও টাইপরাইটিং শিখতে শুরু করেন। এই সময়েই তিনি স্বামী বিবেকানন্দের সান্নিধ্যে আসেন এবং বিবেকানন্দ তাঁকে শরীরচর্চা শিক্ষার জন্য অম্বুগুহের কুস্তির আখড়ায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে যতীন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন এবং দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হন। তখনই তিনি প্রখ্যাত জীবনী লেখক পণ্ডিত যোগেন্দ্র বিদ্যাভূষণের পুত্র মোহন বাগান ফুটবল ক্লাবের ক্যাপ্টেন শচীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে আসেন, শচীন তাঁকে নিয়ে যান নিজের বাসায় এবং পিতা পণ্ডিত যোগেন্দ্র বিদ্যাভূষণের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, যার প্রভাবেই তিনি দেশের কাজে ব্রতী হন। এসময় সিস্টার নিবেদিতার সহযোগী হিসেবে যতীন তাঁর বন্ধুদের নিয়ে নানা রোগে আক্রান্ত রোগীদের সেবা ও সমাজ সেবামূলক কাজও শুরু করে দেন।

টাইপরাইটিং শেখা শেষে তিনি কলকাতার একটি ইউরোপীয় সওদাগরী অফিসে মাসে ৫০ টাকা বেতনে চাকরী নেন। এখানে বেশ কিছুদিন চাকুরী করার পর তিনি ১৮৯৯ সালে মোজফফরপুরে ব্যারিষ্টার প্রিঙ্গল কেনেডির স্টেনোগ্রাফার হিসেবে ৫০ টাকা বেতনে নিযুক্ত হন। তিনি অচিরেই একজন আন্তরিক, সৎ, দক্ষ কর্মচারী হিসেবে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে সক্ষম হন। চাকুরীর কারণে তাঁর আর এফ.এ. ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া হলো না। ব্যারিস্টার কেনেডী যতীনকে তাঁর সততার জন্য পছন্দ করতেন। কেনেডির উৎসাহে মোজফফরপুরের তরুণদের জন্য যতীন ফুটবল ও অ্যাথলেটিক ক্লাব গড়ে তোলেন।

১৯০০ সালে যতীন ব্যারিস্টার কেনেডীর সুপারিশে বাংলা সরকারের অর্থসচিব হেনরি হুইলারের স্টেনোগ্রাফার হিসেবে ১২০ টাকা বেতনের একটি চাকুরী পেয়ে আবার কলকাতায় চলে আসেন। ওই বছর তিনি ইন্দুবালাকে বিয়ে করেন। তাঁদের পরিবারে ৪টি সন্তানের জন্ম হয় - অতীন্দ্র, আশালতা, তেজেন্দ্র, ও বীরেন্দ্র।

বেঙ্গল গভর্ণমেন্টের চাকরীসূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে হত যতীনকে। তেমনই এক সফরে ১৯০৮ এপ্রিল মাসে দার্জিলিং এর পথে শিলিগুড়ি ষ্টেশনে প্রথমে তর্ক তার পরে হাতাহাতি এবং একা হাতে শেষে তুমুল উত্তম মধ্যম দিয়ে দিলেন গুর্খা বাহিনীর ৪ ইংরেজ সদস্যকে। এদের মাঝে ছিল ক্যাপ্টেন মার্ফি ও লেফটেন্যান্ট সামারভিল প্রমুখ। চারজনের চোয়াল ভেংগে ধরাশায়ী করে দেবার অপরাধে যতীনের নামে মামলা হলে সারাদেশে সারা পড়ে যায়, কাগজে কাগজে এই নিয়ে লেখালেখির বহর দেখে সরকার চাপ দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করে। ঠাট বজায় রাখতে ম্যাজিস্ট্রেট যতীনকে শাসিয়ে দেন, "এমনটি আর যেন না ঘটে!" দর্পভরে যতীন জবাব দেন, "নিজের সম্মান বা দেশবাসীর সম্মান বাঁচাতে যদি প্রয়োজন হয়, এমনটি যে আবার করব না, এ শপথ আমি করতে অপারগ।" এই ঘটনার পর হেনরি হুইলারের একদিন ঠাট্টা করে যতীনকে জিজ্ঞাসা করেন, "আচ্ছা, একা হাতে ক'টা লোককে আপনি শায়েস্তা করতে পারেন?" হেসে যতীন বলেন, "ভাল মানুষ হয় যদি, একটাও নয়: দুর্বৃত্ত হলে যতগুলি খুশি সামলাতে পারব।" একবার ফোর্ট উইলিয়ামের কাছে গোরাবাজারে অন্যায় কাজের জন্য এক গোরা সৈন্যকে বেধড়ক পিটুনি দিয়েছিলেন যতীন। 

১৯০২ সালে স্বদেশী আন্দোলনের নেতা অরবিন্দ ঘোষ বারোদায় ৭০০ টাকা বেতনের চাকুরী ছেড়ে কলকাতায় চলে এসে শ্যামপুকুর স্ট্রীটে পন্ডিত যোগেন্দ্রনাথের বাড়ীতে অবস্থান নেন। এখানে অবস্থান করে তিনি কলকাতার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে গোপনে ইংরেজ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বিপ্লবের বাণী প্রচার করতে শুরু করেন।

১৯০৩ সালে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের বাড়িতে শ্রী অরবিন্দের সাথে পরিচিত হয়ে যতীন্দ্রনাথ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। অরবিন্দ ঘোষের সাথে যতীন, যোগেন্দ্রনাথ, লোলিতনাথ চট্যোপাধ্যায় ভারত মুক্তির উপায় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ পান এসময়ই। মনে করা হয় এই সমস্ত আলোচনারই ফল “যুগান্তর”। সরকারী নথিপত্রে যতীন পরিচিত হন শ্রী অরবিন্দের ডানহাত হিসাবে। অরবিন্দ ঘোষের সংস্পর্শে এসে যতীন আখড়ায় গাছে চড়া, সাঁতার কাটা ও বন্দুক ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যতীন বুঝতে পেরেছিলেন, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশকে তাড়ানো সম্ভব নয়। সে কারণে তিনি ব্রিটিশের কবল থেকে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবী পথ বেছে নেন। বাঘা যতীন সরকারি চাকরিরত অবস্থায় অত্যন্ত সুকৌশলে ও গোপনে বিপ্লবী সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। “যুগান্তর” দলে কাজ করার সময় সম্ভবতঃ ১৯০৬ সালে এম.এন রায়ের (নরেনের) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং অচিরেই একে-অপরের আস্থাভাজন হন।

১৯০০ সাল থেকে মূল 'অনুশীলন সমিতি'র প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জেলায় জেলায় যতীন পত্তন করেন গুপ্তসমিতির শাখা। ১৯০৫ সালে যুবরাজের ভারত সফরকালে কলকাতায় বিরাট শোভাযাত্রা উপলক্ষে যতীন স্থির করলেন এদেশে ইংরেজদের আচরণ প্রত্যক্ষ করাবেন যুবরাজকে। যুবরাজ দেশে ফিরে গিয়ে ১৯০৬ সালে ১০ মে দীর্ঘ আলোচনা করেন ব্রিটিশসচিব মর্লি'র সংগে এর প্রতিকার চেয়ে। ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বপরিবারে যতীন দেওঘরে বাস করতে থাকেন, বারীণ ঘোষের সংগে একটি বোমা কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। এই কারখানার অভিজ্ঞতা নিয়ে অবিলম্বে কলকাতার মানিকতলায় বারীণ আরো বড় করে কারখানা খোলেন।

১৯০৭ সালে বিশেষ কর্ম-দায়িত্ব নিয়ে হুইলারের সচিবদের সংগে যতীন সপরিবারে দার্জিলিংয়ে স্থানান্তরিত হলেন। সমস্ত উত্তর বাংলার মতো এখানেও যতীন "অনুশীলন"-এর সক্রিয় শাখা স্থাপন করেছিলেন। ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসে ক্যাপ্টেন মার্ফি ও লেফটেন্যান্ট সমারভিল প্রমুখ চারজন সামরিক অফিসারের সঙ্গে যতীনের মারপিট হয় শিলিগুড়ি স্টেশনে। চারজনের চোয়াল ভেংগে ধরাশায়ী করে দেবার অপরাধে যতীনের নামে মামলা রুজ্জু হলে সারাদেশে বিপুল হর্ষ জাগে-কাগজে কাগজে এই নিয়ে লেখালেখির বহর দেখে সরকার চাপ দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করে।

১৯০৬ সাল থেকে স্যার ডেনিয়েল হ্যামিলটনের সহযোগিতায় যতীন একাধিক মেধাবী ছাত্রকে বৃত্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। শুরু হয় তারকনাথ দাসকে দিয়ে; পরপর তাঁর পিছু পিছু রওনা হন গুরনদিৎ কুমার, শ্রীশ সেন, অধর লস্কর, সত্যেন সেন, জিতেন লাহিড়ি, শৈলেন ঘোষ। এদের কাছে নির্দেশ ছিল, উচ্চশিক্ষার সঙ্গে আধুনিক লড়াইয়ের কায়দা ও বিস্ফোরক প্রস্তুতের তালিম নিয়ে আসতে এবং বিদেশের সর্বত্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করতে। ১৯০৮ সালে বারীণ ঘোষের প্রথম প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখন গোপনে শ্রীঅরবিন্দের ঘনিষ্ঠ দুই প্রধান বিপ্লবী কানে কানে রটিয়ে দিলেন, "ওরে, হতাশ হস্‌নে! যতীন মুখার্জি হাল ধরে আছে!"

এই দু'জনের নাম অন্নদা কবিরাজ ও মুন্সেফ অবিনাশ চক্রবর্তী। বাস্তবিক সভা-সমিতি যখন বেআইনি, সারাদেশ যখন ধড়-পাকড়ের আতংকে বিহ্বল, যতীন তখন স্যার ডেনিয়েলের কাছ থেকে জমি লীজ নিয়ে গোসাবা অঞ্চলে পত্তন করলেন Young Bengal Zamindari Cooperative। পলাতক কর্মীদের গ্রাসাচ্ছাদনের সংগে তিনি সোদপুরের শশীভূষণ রায় চৌধুরী'র দৃষ্টান্ত অনুযায়ী শুরু করলেন স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য নৈশ বিদ্যালয়, ছোট ছোট কুটিরশিল্পের প্রতিষ্ঠান, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে বিপ্লবীদের এই প্রথম প্রত্যক্ষ পরিচয় অত্যন্ত সুফল আসলো।

জেলার সুবিদিত অস্ত্র-ব্যবসায়ী নূর খাঁ'র কাছে আগ্নেয়াস্ত্র কিনে যতীন নিয়মিত বাদা অঞ্চলে গিয়ে নির্বাচিত কর্মীদের তালিম দিতেন। আলিপুর বোমা মামলার অভিযুক্ত বিপ্লবীদের ব্যয়ভার বহন, অস্ত্র সংগ্রহ ইত্যাদির জন্য অর্থের প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও যতীন এইবার গণ-চেতনায় প্রত্যয় জাগানোর জন্য দুর্ধর্ষ কিছু স্বদেশী ডাকাতির আয়োজন করলেন। ১৯০৮ সালের ২ জুন থেকে ধাপে ধাপে এই অভিযান হয়ে উঠল ইংরেজ সরকারের বিভীষিকা। এই পর্যায়ের তুংগস্থান এসে পড়ল ১৯০৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রসিকিউটর আশু বিশ্বাসের হত্যা এবং ১৯১০ সালের ২৪ জানুয়ারি ডেপুটি কমিশনার শামসুল আলমের হত্যায়। এঁরা দু'জনে সোনায় সোহাগার মতো যথেচ্ছভাবে আলিপুর বোমার আসামীদের ঠেলে দিচ্ছিলেন মর্মান্তিক পরিণামের দিকে; মূল অভিসন্ধি ছিল শ্রীঅরবিন্দকে চরম দণ্ড দেওয়া।

২৫ জানুয়ারি ১৯১০, প্রকাশ্য সভায় বড়লাট মিন্টো ঘোষণা করলেন: "অভিনব এক মানসিকতা আজ দেখা দিয়েছে, যা চায় ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করতে।"

২৭ জানুয়ারি ১৯১০, যতীনকে গ্রেপ্তার করা হল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে। শুরু হল হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা। দশম জাঠ বাহিনীকেই বিপ্লবীদের সংগে সহযোগিতার অপরাধে ভেঙ্গে দেওয়ার আগে প্রধান অফিসারদের ফাঁসিতে ঝোলানো হল। এক বছর ধরে এই মামলা চলতে দেখে নতুন বড়লাট হার্ডিঞ্জ অসহিষ্ণু হয়ে দাবি করলেন "একটিমাত্র অপরাধী"কে দণ্ড দিয়ে বাকি আসামীদেরকে রেহাই দেবার। "একটিমাত্র অপরাধী" হিসেবে যতীন কারাগারে বসেই খবর পেলেন যে অদূর ভবিষ্যতে জার্মানির সঙ্গে ইংল্যান্ডের লড়াই বাঁধবে।

যতীনের নির্দেশে সামসুল আলম হত্যাকান্ডের পর ব্রিটিশ সরকার যতীনের উপর গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করে। টেগার্টকে পাঠানো হলো যতীনকে গ্রেফতার করার জন্য। যতীন তখন কয়েকজন সহযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে কলকাতার ২৭৫ নং আপার চিৎপুর রোড়ের বাড়িতে তাঁর এক অসুস্থ মামার সেবাযত্ন করছিলেন। সেই বাড়ি থেকে যতীনকে টেগার্ট গ্রেফতার করে। এরপর যতীনকে আটক রেখে চালানো হয় অত্যাচারের স্টিম রোলার। কিন্তু একটি তথ্যও বের করতে পারেনি। তাঁকে বিভিন্ন ধরনের লোভ ও প্রলোভন দেখানো হয়। এতেও কোনো কাজ হয়নি। হতাশ হয়ে সরকারি মহল তাঁকে প্রথমে প্রেসিডেন্সি জেলে, পরে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠায়। তাঁর নামে দেয়া হয় বিখ্যাত “হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা”। এ মামলা চলে এক বছরেরও বেশী সময় ধরে। এই মামলায় যতীনসহ কয়েকজন বিপ্লবীকে জড়ানো হয়। এ সময় “অনুশীলন সমিতি”কে বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশদের নির্মম অত্যাচারের ফলে কয়েকজন বিপ্লবী মারা যান এবং অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। যথাযথ প্রমাণের অভাবে যতীনকে দোষী প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় ব্রিটিশ সরকার। ১৯১১ সালের একুশ ফেব্রুয়ারী যতীন এ মামলা থেকে মুক্তি লাভ করেন।

জেল থেকে মুক্তি লাভের পর যতীন তাঁর দিদি বিনোদবালা, স্ত্রী ইন্দুবালা, কন্যা আশালতা আর দু’বছরের ছেলে তেজেন্দ্রনাথকে নিয়ে যশোরের ঝিনাইদাতে বসবাস শুরু করেন এবং ঠিকাদারী ব্যবসা শুরু করেন। যশোর শহরে আর মাগুরাতে দুটি শাখা অফিস করেন। ব্রিটিশ সরকারের চোখে ধূলো দিতে তিনি পুরোপুরী সংসারী হওয়ার ভান করেন। ব্যবসার আড়ালে গোপনে গোপনে বিপ্লবী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি নরেন সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে পুরো ভারত চষে বেড়ান এবং বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবীদের একত্রিত করবার কাজ চালিয়ে যান।

কলকাতার পুরো দায়িত্ব অতুলকৃষ্ণ ঘোষের হাতে অর্পণ করে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে যতীন উপস্থিত হলেন তাঁর পৈত্রিক ভিটা ঝিনাইদহে। সেখানে ঠিকাদারের ব্যবসা শুরু করলেন তিনি যশোর-ঝিনাইদহ রেলপথ নির্মাণ উপলক্ষে। ব্যবসার সুবাদে তিনি সাইকেলে অথবা ঘোড়ার পিঠে চড়ে জেলায় জেলায় অবিশ্রাম ঘুরে গুপ্তসমিতির শাখাগুলিকে সন্নিহিত করে তুললেন।
১৯১৩ সালে বাংলা এবং বাংলার বাইরের বিভিন্ন শাখার কর্মী ও নেতারা মিলিত হলেন বর্ধমানে বন্যাত্রাণ উপলক্ষে। উত্তর ভারত থেকে রাসবিহারী বসু এসে যতীনের সংগে আলোচনা করে নূতন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হলেন। অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে যতীনের সংগে একাধিক বৈঠকে রাসবিহারী সিদ্ধান্ত নিলেন ফোর্ট উইলিয়ামের সৈন্য-বহরের পরিচালকদের সহযোগিতায় কলকাতা থেকে পেশোয়ার অবধি বিদ্রোহের আগুন জ্বলবে ১৮৫৭ সালের দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে।

১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে সানফ্রান্সিসকো থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন 'গদর'-নেতা সত্যেন সেন; সঙ্গে এলেন বিষ্ণুগণেশ পিংলে, কর্তারসিং সরাংগা ও বিরাট একদল 'গদর'-কর্মী। সত্যেন জানালেন যে, বার্লিনে বীরেন চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত বিপ্লবীরা খোদ কাইজারের সঙ্গে চুক্তি সই করেছেন ভারতে অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ পৌঁছে দেবে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পাঠানো কয়েকটি জাহাজ; এর দায়িত্ব নিয়েছেন ওয়াশিংটনে জার্মান রাষ্ট্রদূত ব্যার্নস্টর্ফ ও তাঁর মিলিটারী আতাশে ফন্‌পাপেন। কাইজারের সনদ নিয়ে একটি বিপ্লবী মিশন রওনা হচ্ছে কাবুল অভিমুখে; পথে তারা জার্মানীর হাতে বন্দী ব্রিটিশ সৈন্যবহরের ভারতীয় জওয়ানদের নিয়ে গড়ে তোলা বাহিনী নিয়ে কাবুল থেকে কুচকাওয়াজ করে হাজির হবে দিল্লীতে, যোগ দেবে সশস্ত্র অভ্যুত্থানে। বার্মা সীমান্তেও সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত থাকছে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে বলে। দূরপ্রাচ্যে বিভিন্ন জার্মান দূতাবাস ও কনস্যুলেট সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।

যতীনের চিঠি নিয়ে পিংলে ও কর্তারসিং গেলেন রাসবিহারী'র সঙ্গে দেখা করতে। টেগার্টের রিপোর্টে দেখা যায়, এই সময়ে সত্যেন সেনকে নিয়ে যতীন কলকাতার বিভিন্ন রেজিমেন্টের অফিসারদের সংগে আলোচনায় ব্যস্ত। ভারতের এই যজ্ঞ-অনলে ইন্ধন দেবার জন্য সাজসাজ পড়ে গেল দূরপ্রাচ্যে আমেরিকায়, ইউরোপে, মধ্যপ্রাচ্যে। ভূপতি মজুমদার স্পষ্ট লিখে গিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক এই সহযোগিতার উদ্ভাবন করেন স্বয়ং যতীন মুখার্জি। ইতিহাসে একে অভিহিত করা হয় "ভারত-জার্মান ষড়যন্ত্র" নামে।

সমাগত 'গদর' কর্মীরা কাজে নামতে চান, জার্মান অস্ত্র আসার জন্য তাদেঁর তর সইছে না। যতীনের সঙ্গে পরামর্শ করে রাসবিহারী দিন ধার্য্য করলেন ২১ ফেব্রুয়ারী অভ্যুত্থানের জন্য। মিঞাসির (মহীসুর), লাহোর, ফিরোজপুর, রাওয়ালপিণ্ডি, জব্বলপুর, বেনারস-সর্বত্র তেরংগা ঝাণ্ডা উড়িয়ে দেওয়া হবে। নীল হবে মুসলমান কর্মীদের প্রতীক; হলদে শিখ; লাল হিন্দু। কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে সমস্ত রেলপথ উড়িয়ে দেওয়া হবে, যাতে করে সরকার পক্ষ প্রত্যুত্তরের জন্য সৈন্যবাহিনী না আনাতে পারে। ইতিমধ্যে ২৬ আগস্ট ১৯১৪ সালে কলকাতার রডা কোম্পানী থেকে বিপ্লবীরা যথেষ্ট শক্তিশালী মাউজার পিস্তল সংগ্রহ করেছেন, প্রয়োজনমতো যা দূরপাল্লার রাইফেলের মতো ব্যবহার করা চলে।

রাসবিহারী'র অনুরোধে অর্থ সংগ্রহ করতে যতীন নতুন অভিযানের শরণ নিলেন- মোটরচালিত ট্যাক্সির সাহায্যে অভিনব এই ডাকাতির পদ্ধতি অবিলম্বে ফ্রান্সে দেখা যাবে, প্রখ্যাত নৈরাজ্যবাদী সর্দার "বোনো"র পরিচালনায়। পরিশীলিত, শৃংখলাবদ্ধ দুঃসাহসিক এই কীর্তির সামনে মুগ্ধ আতঙ্কে ইংরেজ সরকার হতবুদ্ধি হয়ে রইল। আর পুলকে মুগ্ধ দেশবাসী প্রত্যয় ফিরে পেল বিপ্লবীদের কর্মক্ষমতায়। ১২/২/১৯১৫, ২২/২/১৯১৫ - দুই দু'টো চোখ ধাঁধানো ডাকাতির সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল সারাদেশে। ২৪/২/১৯১৫ যতীন এক গুপ্ত বৈঠকে কর্মসূচী নির্ধারণ করছেন, এমন সময়ে এক সরকারী গোয়েন্দা সেখানে উপস্থিত দেখে নেতার ইঙ্গিতক্রমে চিত্তপ্রিয় তাঁকে গুলি করেন।

থরহরিকম্পা পুলিশ রিপোর্টে অসহায় টেলিগ্রাম দেখা যায়, "চড়া ইনাম ঘোষণা করেও যতীনের হদিশ মিলছে না। এখনো তিনি ছদ্মবেশে কলকাতায় বহাল তবিয়তে যাতায়াত করছেন, কিন্তু তাঁর মতো উগ্র চরিত্রের নাগাল পাবার যোগ্য চর পাওয়া দূর্লভ, বিশেষত সর্বদাই তিনি সশস্ত্র থাকেন"।

যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, "কলকাতায় Flying Squad, Armoured Car-এর সশস্ত্র পাহাড়ার ব্যবস্থা হল। বড় রাস্তাগুলিতে ড্রপ-গেট করা হল - রেললাইন বন্ধ করার যেরূপ লোহার পাল্লা খাড়া রাখা হয়, ঠিক তেমনি। থানায় সাইরেন বসানো হল। কলকাতা থেকে উত্তর ও পূর্বদিকে খাল পার হবার যত পোল আছে - চিৎপুর, টালা, বেলগেছে, মানিকতলা, নারকেলডাঙ্গা ও হাওড়ার পোলে সশস্ত্র প্রহরী দেওয়া হল। যাকে-তাকে এবং যে-কোনও গাড়ীকে ধরে তল্লাশ করা হতে লাগল।"

কোন মহৎ সাধনার পথে যতীন নেমেছেন, তা স্মরণে রেখে পুলিশের দেশী কর্মচারীরা পর্যন্ত মনেপ্রাণে যতীনের অনুরাগী হয়ে উঠলেন। ব্যতিক্রম ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর সুরেশ মুখার্জি। তিনি বিপ্লবীদের জব্দ করতে বদ্ধপরিকর। বারেবারে সুরেশের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে একদিন যতীন বললেন, "যতক্ষণ না সুরেশকে সরানো হচ্ছে, ততক্ষণ আমি জলস্পর্শ করব না"।

২৮/২/১৯১৫ তারিখে ভোরবেলা সুরেশ সদলবলে টহলে বেরিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়লাট যাবেন-তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা পাকা করতে। নিপুণহাতে সুরেশকে নিধন করে যতীনের সহকারীরা গা ঢাকা দিলেন। এদেঁর কর্মতৎপরতায় এমনকি টেগার্টও মুগ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে স্বীকৃতি জানিয়েছেন যে, বাঙ্গালী এই বিপ্লবীদের চরিত্রের সমতুল জগতে আর কোথাও পাওয়া বিরল। এদেঁর আত্মবিশ্বাস ও দেশের কাজের জন্য সর্বস্বত্যাগের ব্রত টেগার্টকে মনে করিয়ে দিয়েছে গাঁন্ধীর কথা।

জটিল এই পরিস্থিতিতে যতীনের আর কলকাতা থাকা সমীচীন নয়, বিবেচনা করে তাঁর শিষ্য ও সহকারীরা খুঁজে পেলেন বালেশ্বর (বালাসোর)-এর আশ্রয়। ওখানকার উপকূলেই জার্মান অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রধান জাহাজটি আসার কথা। তার প্রতীক্ষায় যতীন ওখানে চার-পাঁচজন কর্মীকে নিয়ে আস্তানা গাড়লেন। স্থানীয় অভিভাবকরূপে রইলেন মনীন্দ্র চক্রবর্তী। দীর্ঘ ছ'মাস তিনি বুকের পাঁজরের মতো আগলে থেকেছেন মহানায়কের এই অজ্ঞাতবাসের আস্তানা। যতীনকে বালেশ্বরে নিরাপদ দেখে নরেন ভট্টাচার্য (এম.এন. রায়) রওনা হলেন বাটাভিয়া অভিমুখে, বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশমাফিক; সেখানে হেলফেরিষ্ ভ্রাতাদের কাছে বিশদ অবগত হলেন জার্মান অস্ত্র নিয়ে জাহাজ আসার পাকা খবর; ফিরে এসে গুরুর চরণে একথলে মোহর ঢেলে দিয়ে প্রণাম করে জানালেন, জার্মান সহযোগিতার দরুণ প্রাপ্য অর্থের এটি প্রথম কিস্তি। মনীন্দ্র সবই দেখেছেন। সবই জানতেন। বিশাল ঝুঁকি নিয়ে তবু তিনি এঁদের আশ্রয় দিয়েছেন। মুগ্ধ হয়ে এঁদের সান্নিধ্য উপভোগ করেছেন। ইতিমধ্যে রাসবিহারী'র প্রচেষ্টা যেমন উত্তরাঞ্চলে ভেস্তে যায় কৃপাল সিং নামে বিশ্বাসঘাতক 'গদর' কর্মীর জন্য, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চেকোস্লোভাকিয়া থেকে সমাগত বিপ্লবীরা ইন্দো-জার্মান সহযোগিতার সংবাদ ফাঁস করে দেয় মার্কিন ও ব্রিটিশ সরকারের দপ্তরে-প্রতিদানে নিজেদের সংগ্রামের অনুকূল সহানুভূতি পাবার প্রত্যাশায়। মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের উদ্যোগে জার্মান সরকারের সঙ্গে জার্মান বিভিন্ন দূতাবাসের পত্র ও তারবার্তা হস্তগত করে ব্যাপক এই আন্তর্জাতিক সংগঠনের মূল উপড়ে ফেলতে উদ্যত হল সমবেত ব্রিটিশ ও মার্কিন সুরক্ষা বিভাগ। পেনাং'এর একটি সংবাদপত্রের কাটিং থেকে যতীন খবর পেলেন যে, অস্ত্রশস্ত্রসমেত জাহাজ ধরা পড়ে গিয়েছে। মারাত্মক এই নিরাশায় তিনি ভেঙে পড়বেন ভয় ছিল সহকারীদের। পরিবর্তে তিনি হেসে উঠলেন, যেন কিছুই তেমন ঘটেনি, বললেন, "দেশের সুরাহা বাইরে থেকে নয়, তা আসবে অভ্যন্তর থেকে!"

রোজ বিকেলে বনভূমির নীরব আশ্রয়ে যতীন গীতার ক্লাস নিতেন। শিষ্য নলিনীকান্ত কর তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, "মনে হত যেন গৌতম মুনির কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে বেদমন্ত্র"। ক্লাসের শেষে অস্তসূর্যের আলোকে একাকী যতীন কিছুক্ষণ ধ্যান করতেন। একদিন মনীন্দ্রও বসে রইলেন। হঠাৎ যতীন অদূরবর্তী মনীন্দ্রের হাত ছুঁয়ে বলে উঠলেন: "ওই দ্যাখ! কৃষ্ণ আমাদের দিকে হাসিমুখে চেয়ে আছেন!" মনীন্দ্র সেই দৃষ্টির অভাবে প্রত্যক্ষ করলেন-যতীনের স্পর্শে এক তীব্র পুলকের স্রোত।

ইতিমধ্যে কলকাতা থেকে খবর এল, একের পর এক বিপ্লবীদের কেন্দ্রগুলিতে তল্লাস চালাচ্ছে পুলিশ। বালেশ্বরের সন্ধান পেতে দেরী নেই। দুর্গম ডুভিগর পর্বতশ্রেণী দিয়ে গা ঢাকা দেবার উপযোগিতা নিয়ে কেউ কেউ যখন জল্পনা-কল্পনা করছেন, যতীন দৃঢ়স্বরে জানালেন, "আর পালানো নয়। যুদ্ধ করে আমরা মরব। তাতেই দেশ জাগবে।"

উড়িষ্যার মহাফেজখানায় রক্ষিত নথিপত্র থেকে পুংখানুপুংখ উদ্ধার করা গিয়েছে চারজন অনুচরসমেত কী অসমসাহসিক যুদ্ধ করেছিলেন যতীন, বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশের মুখোমুখি।

৫-৯-১৯১৫ এ বালেশ্বরের ইউনিভার্সাল এম্পোরিয়াম পুলিশ তছনছ করেও কিছু পেলো না। জনা চারেক গ্রেপ্তার হলেন। চললো নির্মম অত্যাচার। মারের মুখে সবাই একই রকম শক্ত থাকেন না। মুখফস্কে কিছু তথ্য দিয়ে দেন। তাঁদের বেইমান বলা যায় না। নরেন গোঁসাই এর মত বিদেশে চাকরীর লোভে যারা রাজ সাক্ষী হতে চায়, তাঁদের বেতন মৃত্যু।

ত্রিশ মাইল দুরে কাপ্তিপদার জঙ্গল। এবার একদিকে পাচজন বাঙালী যুবক। অস্ত্র বলতে মাউজার পিস্তল। আর অন্যদিকে বালেশ্বর সশস্ত্র পুলিশ, নীলগিরি রাজ্য সশস্ত্র পুলিশ, ময়ুরভন্জ সশস্ত্র পুলিশ। এনফিল্ড রাইফেল ও মেশিনগান। মোটরগাড়ী, হাতি, সবই আছে। রাতে সাহেবপুঙ্গবেরা জঙ্গলে ঢুকতে সাহস পেলো না। সঙ্গীরা যতীনকে জঙ্গলের পথ ধরে পালাতে বলেছিলেন। কিন্তু ভয় জিনিষটাকে পাচ বছর বয়সেই বাংলা মায়ের এই সেরা সন্তান জয় করেছিলেন।

৬-৯-১৯১৫, ভাদ্র মাস, গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ওড়িশার ঐ অঞ্চল যথেষ্ঠ বৃষ্টিপ্রবন। যতীন তালডিহার আস্তানায় এলেন। সেখানেও একই অনুরোধ, যতীন জঙ্গলের পথে চলে যান। কিন্তু তিনি রাজী নন। তাঁর একটাই কথা, 'জাতি জাগবে'। এবার পাচজন যতীন, জ্যোতিষ পাল, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, নীরেন্দ্রচন্দ্র দাশগুপ্ত, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত জঙ্গলের পথে এগোলেন। টাকা কড়ি, আগ্নেয়াস্ত্র পুরু চামড়ার থলি ও বাক্সে।

৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯১৫। তখনো ভোর হয়নি। ত্রিশ কোটি ভারতবাসী, কাবুল থেকে রেঙ্গুন, শ্রীনগর থেকে কন্যাকুমারী, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পাচজন বঙ্গসন্তানকে ঘিরে প্রায় পাচ শতাধিক নেকড়ে, কিন্তু এগোতে ভয় পাচ্ছে। ওদিকে ঝিনাইদহে, দিদি বিনোদ বালা, স্ত্রী ইন্দুবালা নিদ্রাহীন রাত কাটিয়ে অভ্যস্ত। দিদির এক কথা, 'যেন শুনতে না হয়, সিংহ পিঞ্জরাবদ্ধ'। তিন শিশুপুত্র আশালতা, তেজেন্দ্র নাথ, বীরেন্দ্র নাথ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বিনোদবালা কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে দিলে, ইন্দুবালা জেরা করেন নি, তাঁর মনে পড়েছিল, স্বামীর পত্রাংশ "ক্ষনিকের দুর্বলতা সকলেরই আসতে পারে, সে সময় ধৈর্য্য সহকারে দিদিকে সাহায্য করিও"। বহু জন্ম তপস্যা করলে, বাঙালীর ঘরে এত পৌরষত্ব নিয়ে এসব মহামানবরা জন্মগ্রহন করে। আশ্চর্যকথা এটাই, এদিকে যখন বুড়ীবালামের তীরে উপরওলা বাঙালীজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষকারের পরীক্ষা নিচ্ছেন, সেই সময়ে বিনোদবালার ডায়রীতে, ঐ একই দিনে একটা কবিতা লেখা হয় (পরে উদ্ধার হয়) যাতে ঈশ্বরের কাছে মনোবলের প্রার্থনা স্পষ্ট। এটাকে কি বলা যায়, ঘটনার সমাপতন?

গোবিন্দপুর গ্রামের কাছে, ভাদ্রের ভরা বুড়ীবালাম, সরকারি আদেশে সব নৌকা বাজেয়াপ্ত। নদী পার হয়ে বাবুরা দক্ষিণমুখো ভগুয়া গ্রামের কাছে গভীর জঙ্গলের দিকে চললেন। এ অঞ্চলের মানুষ, এতটাই পিছিয়ে যে সরকারী ঢ্যারা বিশ্বাস করলো। সাব ইন্সপেকটর চিন্তামনি সাহু সাদা পোষাকে হাজির ছিলেন, হঠাৎ যতীনকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। দেশবাসীর জন্য যতীন গুলি ভরা পিস্তল রাখেননি। একটা ঝটকা দিলেন। গুলতিতে ভরা পাথরের মত চিন্তামনি সাহু ছিটকে গেলেন। বাধা দুর হলো। সামনেই "অমৃত" নদী। মাথায় পুটলী বেধে, ভরা বর্ষার নদী সাতরে পার হলেন পাঁচ বিপ্লবী।

চাষাখন্ড গ্রামের টিলায়, মজে যাওয়া, "দেশোয়া গরিয়া" জলার ধারে বসলেন পাঁচ বিপ্লবী। তিনদিন, পেটে দানা পড়েনি। নীরেনের একটা পা ক্ষতিগ্রস্ত। তিনি চিত্ত, মনোরঞ্জনকে অনুরোধ করলেন, তোরা দাদাকে বুঝিয়ে বল, আমার জন্য সবাই ধরা পড়ার মানে হয় না। রুখে দাড়ালেন দলনেতা, "কি এক যাত্রায় পৃথক ফল? আমরা মরলে, দেশবাসী জাগবে, এই যে গ্রামবাসী, যারা আমাদের ডাকাত ভাবছিল, হয়তো এতক্ষণে থানায় খবর পৌছে গিয়েছে (যতীনের অনুমান সঠিক ছিল), তাঁরা অন্তত জানবে আমাদের পরিচয়। তাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, দেশটাকে স্বাধীন করতে এগিয়ে আসবে।"

এদিকে পাঁচজন পিস্তল ধারী আর অন্যদিকে বিপুল সেনা সমাবেশ, স্থানীয় শাসক কিলবি, রাদারফোর্ড একদিক দিয়ে আর কলকাতা থেকে আসা সাহেবরা বিপুল সশস্ত্র সেনা, পুলিশ নিয়ে আরেক দিক থেকে। দুরপাল্লার রাইফেল। মেশিনগান। ওদিকে, চিত্তপ্রিয় দূরবীন দিয়ে দেখলেন, কিলবির নেতৃত্বে সশস্ত্র রাইফেলধারী পুলিশ এগিয়ে আসছে। অন্যদিকে রাদারফোর্ডের নেতৃত্বে আরেকদল। কিলবি দুরপাল্লার রাইফেল চালিয়ে বুঝিয়ে দিলো, "আমাদের ক্ষমতা"। সামনে দেশী সেনাদের রেখে সাদারা পিছনে। ভাঙ্গা মন নিয়ে সব্যসাচী যতীন দুহাতে মাউজার নিয়ে প্রস্তুত হলেন, দেশীয় মানুষ মারতে তাঁর যে প্রান কাঁদে।

হঠাৎ নিখুঁত নিশানায় যতীন মাউজার চালালেন দুহাতে, পর পর। জনাদশেক ধানক্ষেতে চিতপাৎ। রাদারফোর্ড বাহিনী পিছু হটে গেলো। সেটা কিলবি বাহিনী দেখে ধানক্ষেতে শুয়ে পড়লো। ভাদ্রের ধানক্ষেত। পাচশো সেনার অবস্থা শোচনীয়। আসলে প্রখর বুদ্ধিমান যতীনের রনক্ষেত্র নির্বাচনটা সঠিক ছিল। একাধিক উইঢিপি, টিলা ও প্রাকৃতিক পরিখা। যুদ্ধ শুরু হয় দুপুরে। সন্ধ্যা হয় হয়। জন প্রতি একশো সেনা দুরপাল্লার রাইফেল নিয়ে এক পাও এগোতে পারেনি। এদিকে বাঁ হাতে যতীন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সেটা তুচ্ছ। ঐ হাতেই উনি একদা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের গলা চেপে ধরেছিলেন।

যতীন তখন দেশীয় সেনাদের এড়িয়ে, সাদাদের টার্গেট করছেন। ফলে যেটা হল, সেটাকে ঠিক যুদ্ধ বলা যায় না। রাদারফোর্ড সেটা বুঝে দেশীয় সেনাদের এগিয়ে দিচ্ছেন। এই সময়ে চিত্তপ্রিয় ও যতীন, দুজনেই গুলিবিদ্ধ হলেন। চিত্তপ্রিয়, দাদা, বলে শেষ কথা বলে, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। যতীন, নিজের বাঁ হাতে ও পেটে গুলি বিদ্ধ, চিত্তপ্রিয়র মাথাটা কোলে, ডান হাতে পিস্তল চালিয়ে যাচ্ছেন। পঞ্চপাণ্ডবের একজন চলে গেলো। প্রতিশোধ নিতেই হবে।

যতীনের দ্বিতীয় হৃদপিন্ড চিত্তপ্রিয় যদি অন্য কোথাও এভাবে চলে যেতেন, যতীন হয়তো চোখের জল রাখতে পারতেন না। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে দুর্বলতার কোন স্থান নেই। প্রকৃত বিপ্লবীর শিক্ষা। এমন সময় জ্যোতিষ পাল আরো গুরুতর খবর দিলেন, দাদা টোটা তো প্রায় শেষ। যতীন চামড়ার থলিটা এগিয়ে দিলেন, আরো দুদিন যুদ্ধ চালানোর রসদ। এদিকে আলো প্রায় স্তিমিত। যতীন বললেন, এ যাত্রা বোধহয়, আমাদের ঠেকাতে পারলো না। অন্ধকার নামলেই ঐ জঙ্গলে গিয়ে ঢুকবো।

কিন্তু এ কি অবস্থা! চামড়ার ব্যাগের চাবী কৈ। ব্যাগটা প্রচন্ড পুরু ও ভারী। যতীন ব্যাগটা খোলার চেষ্টা করছেন,এমন সময়ে আরেকটা গুলি এসে বা হাতের আঙুলে লাগলো। রক্তে সারা গা ভেসে যাচ্ছে। ডান হাত এখনো সক্রিয়। মুস্কিল হলো, দেশীয় সেনাগুলো, পাল্লার মধ্যে আর শেতাঙ্গ শয়তান, সব রেঞ্জের বাইরে। অগত্যা। যতীন ডান হাতে নিখুঁত লক্ষে পিস্তল চালাচ্ছেন। প্রায় প্রতিগুলিতেই একজন না একজন আহত হচ্ছেন। কিন্তু ওনার লক্ষ হাত পা। মাথা, বুক কখনোই নয়। কারন ওরা যে এই দেশেই জন্মগ্রহন করেছে।

এদিকে জ্যোতিষের বুকের ডানদিকে একটা গুলি ফুড়ে বেরিয়ে গেলো। সারা গায়ে ক্ষত নিয়ে যতীন গুলি চালিয়ে যাচ্ছেন। নীরেন, মনোরঞ্জন সামনের ডোবা থেকে জল এনে সঙ্গীদের সেবা করে যাচ্ছেন। অন্ধকার দ্রুত নেমে আসছে।

যতীন ক্ষীনকন্ঠে জানালেন, নীরেন, মনোরঞ্জন, তোরা রইলি, মরার আগে দেশবাসীকে জানিয়ে যাস, আমরা ডাকাত নই, দেশবাসীকে আমাদের মহান ব্রতের কথা জানিয়ে যাস। দেশ জাগবে, আমাদের পথে।

আর কার্তুজ নেই! চামড়ার ব্যাগ ভর্তি কার্তুজ। খোলা যাচ্ছে না। প্রায় তিন দিকেই প্রায় সাতশো সেনা, পুলিশ, হাতি, ঘোড়া, দুরে মোটরগাড়ী। মাঝখানে পাঁচজন বঙ্গসন্তান। দুজন নিহত, তিনজন গুরুতর আহত। বিপ্লবীরা আত্মসমর্পনের ইঙ্গিত দিলেন। আর কার্তুজ নেই।

সেনারা এগিয়ে এলো। রাদারফোর্ড অবাক হয়ে দেখলেন, এইসব পিস্তল দিয়ে পাঁচশো, হাজার গজ দূরে এরা কি ভাবে নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করছিল। এবার কুলি সংগ্রহ করে নীরেন ও মনোরঞ্জনের হাত বাধা হয়নি। এনারা আহতদের দেখাশোনা করছিলেন। যতীনের কথায় রাদারফোর্ড নীরেন ও মনোরঞ্জনকে যতীনের পাশে বসবার অনুমতি দেয়। মনোরঞ্জন সাগ্রহে যতীনের মাথা কোলে নিয়ে বসলেন। আর নীরেন নিলেন জ্যোতিষ পালের ভার। এবার খাটিয়া এনে দুজন গুরুতর আহত ও একজন নিহতকে খাটিয়ায় শোয়ানো হল।

রনক্ষেত্রে রাদারফোর্ডের সৌজন্যের বিনিময়ে, যতীনও সৌজন্য দেখিয়েছিলেন। রাদারফোর্ড টুপিতে করে ডোবা থেকে রনক্ষেত্রে যতীনের জন্য জল নিয়ে এলে, যতীন তা গ্রহন করেন।

এদিকে তুমুল বৃষ্টি নামলো। বালেশ্বর হাসপাতালে অশ্বারোহী দূত মারফৎ খবর গেলো। কিলবিকে যতীন, ঐ অবস্থাতেও জানিয়েছিলেন, "আমার ছেলেদের প্রতি যেন অবিচার না হয়, যা কিছু হয়েছে আমার নির্দেশে। সব কিছুর জন্য, আমি দায়ী।"

রাত এগারোটা। বিশাল মিছিল বালেশ্বর সরকারি হাসপাতালের দিকে এগিয়ে চলেছে। এদিকে গ্রামবাসীরা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু বহু দেরী হয়ে গেছে। তাঁরা অনুতাপ করতে শুরু করেছে। বিক্ষোভের ভয়ে, হাসপাতালে সেনা মোতায়েন হলো।

সশস্ত্র প্রহরী নিয়ে হাসপাতালে ঢুকলেন সার্জন খান বাহাদুর রহমান, সহকারী সার্জন গাঙ্গুলি। একজন লেডী ডাক্তার, দুজন কম্পাউন্ডার, চারজন নার্স, তিনজন কুলি, দুজন মেথর। যতীনের উর্ধাঙ্গ অবারিত। বা হাতের আঙ্গুল, দুটি মেটাকার্পাল অস্থি গ্রন্থি বুলেটের আঘাতে গুঁড়ো হয়ে গেছে। তলপেট ও নাভির দুদিকেই রাইফেলের বুলেট। ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ডাক্তার লিখলেন, যবনিকা পতনের আর দেরী নেই।

মহান শহীদ চিত্তপ্রিয়ের মৃতদেহ চলে গেলো মর্গে। নীরেন ও মনোরঞ্জনের প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাজতে নিয়ে যাওয়া হলো।

যতীনকে অপারেশান রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। তখন তাঁর রক্তবমি হচ্ছে। কিলবি নিজের হাতে লেমনেড খাইয়ে দিলেন, কোলকাতা থেকে নির্দেশ এসেছে, বাঁচিয়ে রাখতেই হবে, বহু আন্তর্জাতিক যোগায়োগের মূলসুত্র বাংলা মায়ের এই সন্তান, বিশ্বের একমাত্র মানুষ যে শৈশবে পাগলা ঘোড়া থামিয়ে দেয়, কৈশোরে খালি হাতে রয়্যাল বেঙ্গল হত্যা করে, হাজার গজ দুর থেকে পিস্তল দিয়ে নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করে, এর কাছে না জানি কত খবর থাকবে।

এমন নজির ইতিপূর্বে দেখেননি বলে মেনে নিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ কুশীলবেরা। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ সালে সূর্যাস্তের সঙ্গে অবসান হল এই যুদ্ধের। পরদিন বালেশ্বর সরকারী হাসপাতালে যতীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

উল্লেখ্য, তিনিই প্রথম ভারতীয় বিপ্লবী যিনি ট্রেঞ্চ খুঁড়ে যুদ্ধ করেছিলেন।

এক তরুণের অদম্য সাহসে বাঘা যতীন ইংরেজদের সঙ্গে জোর লড়াই করতে পেরেছিলেন বুড়িবালামের তীরে। আর এক নাম না জানা বিশ্বাসঘাতক মাড়োয়ারি যুবক যার জন্য বুড়িবালামের যুদ্ধটা জিতে ফেরা হয়নি বিপ্লবী যতীন মুখার্জির।

দিনে-দুপুরে মেসরস আর.বি.রডা অ্যান্ড কোম্পানির ৫০টি মৌজার পিস্তল এবং ৯টি বাক্স টোটা গায়েব হয়ে যায়। চুরির দিন তিনেক পর ঘটনা টের পেয়েছিলেন কোম্পানীর কর্ণধার প্রিক সাহেব। এমনিতেই তখন যুগান্তর দল, অনুশীলন সামিতির বৈপ্লবিক কার্যকলাপে ব্রিটিশ পুলিশ জেরবার। হয়ে গিয়েছে আলিপুর বোমা কাণ্ড, হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলা।

এত অস্ত্র চুরির ঘটনা তখনও ঘটেনি। ঘটে গেল ১৯১৪ সালে। চুরি যাওয়া অস্ত্রের বেশ কিছু গিয়ে পৌঁছেছিল বাঘা যতীনের হাতে। অস্ত্র লুঠের মূলে ছিলেন ‘সুবোধ’ বালক হাবু। কিন্তু অন্য যুবকটি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে হয়তো লড়াইটা জিততে পারতেন যতীনরা।
৩৯ নং মলঙ্গা লেনের বাসিন্দা অনুকুল চন্দ্র মুখার্জি ছিলেন আত্মোন্নতি সমিতির একজন একনিষ্ঠ কর্মী। অস্ত্র আর বিপ্লবী সংগ্রহে তাঁর পারদর্শীতার জন্য তাঁকে দলের সবাই ‘গুরুদেব’ বলে ডাকতেন। সেখানকারই ছেলে হাবু ওরফে শ্রীশচন্দ্র মিত্র। ডানপিটে ছেলে নজরে পড়ে যান গুরুদেবের। ছেলেটিকে তিনি গড়ে পিঠে নেন। ট্রেনিংইয়ে বেপরোয়া হাবু হারিয়ে গেল।

বিপ্লবী বিপিন বিহারি গাঙ্গুলীর বন্ধু রডা অ্যান্ড কোম্পানির কর্মী কালিপদ মুখার্জির চেষ্টায় ১৯১৩ সালের অগাষ্ট মাসে অস্ত্র হাবুর চাকরি হয়ে গেল রডা কোম্পানিতে। প্রত্যেকেরই লক্ষ্য ইংরেজদের ডেরা থেকে অস্ত্র লুঠ করা এবং বিপ্লবীদের হাতে তুলে দেওয়া। হাবু’র সূচ হয়ে প্রবেশের শুরু ১৯১৩ সালের আগস্ট মাসে। ফাল হয়ে বেরনো ১৯১৪-র আগস্টে। মাঝের এই একবছরে হাবু কমপক্ষে ৪০ বার দক্ষতার সাথে অস্ত্র খালাসের কাজ করে প্রিক সাহেবের বিশ্বাস অর্জন করে নিয়েছিল।

১৯১৪’র আগস্টে খিদিরপুর ডকে ‘ট্যাক্টিসিয়ান’ নামক জাহাজে করে এলো রডা কোম্পানির ২০২টি দেবদারু কাঠের বাক্স। যার একটিতে ছিল ৫০ টি মৌজার পিস্তল। ১৯১৪ সালের ২৬ আগস্ট প্রিক সাহেব ‘প্রিয়’ হাবুকে কাস্টম হাউসের জেটিতে নিয়ে গিয়ে মাল খালাসের প্রয়োজনীয় চিঠি ও টাকা দিয়ে চলে যান। হাবু সরকারি অফিসার- ইন-চার্জ এর কাছ থেকে মাল বুঝে নেওয়ার অছিলায় প্রতিটি বাক্স খুলে দেখে দশটি বাক্সকে চিহ্নিত করে রাখে। পূর্ব পরিকল্পনা মত অনুকুল চন্দ্র মুখার্জির পাঠানো গাড়ি সমেত সাতখানা মোষের গাড়িকে পোর্টের গুদামে নিয়ে যাওয়া হয়। সাত নম্বর গাড়ির সাথে হরিদাস দত্ত, অতুল নামে এক হিন্দুস্থানী কুলির ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েন। এই হরিদাস ছিলেন ঢাকার বাসিন্দা এবং বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের দলের লোক।
ছ’টি গাড়িতে বাকি মাল তুলে সাত নম্বর গাড়িটিতে হরিদাস হাবুর চিহ্নিত করা দশটি বাক্স তুলে দেন। হাবু ছ’টি গাড়িকে গেট পাস দিয়ে বেড়করে দেওয়ার কিছু পরে যখন ওই গাড়িগুলি খানিক দূরে চলে যায় তখন সাত নম্বর গাড়িটিকে গেট পাস দিয়ে বের করেন হাবু আর চালককে নির্দেশ দেন অতুলের নির্দেশ মত গাড়ি নিয়ে যেতে।

হাবু ছ’টি গাড়ি নিয়ে ভ্যান্সিটার্ট রো’এর রডা কোম্পানীর গুদামে হাজির হয়। কিন্তু সাত নম্বর গাড়ি আসেনি। উদ্বিগ্ন হওয়ার ভান করে সাত নম্বর গাড়ির খোঁজে সে বেড়িয়ে পরে। প্রিক সাহেবেরও কোন সন্দেহই হয় না।
এদিকে চালককে মদ্যপ করিয়ে হরিদাস অস্ত্র ভরতি গাড়ি নিয়ে চম্পট দেয়। পরের দিন হাজির হয় শিক্ষাগুরু অনুকুল চন্দ্র মুখার্জির বাড়ি। হিন্দ আইনক্স সিনেমা হলের উল্টোদিকে অনুকুল চন্দ্র মুখার্জি, বিপিন গাঙ্গুলী, হরিদাস দত্ত ও গিরীন্দ্র নাথ ব্যানার্জির মূর্তি সহ ঘটনাটির সংক্ষেপ বর্ননাও মেলে। ৩২/২ মলঙ্গা লেনে ছিল কান্তি মুখার্জির লোহার গোলা। অনুকুল চন্দ্র সেখানে বাক্সগুলো নামিয়ে রেখে মোষের গাড়িটিকে ছেড়ে দেন। এরপর দুটি গাড়িতে বাক্সগুলি চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় হিদারাম ব্যানার্জি লেনের মধ্যে দিয়ে ৩নং জেলিয়াপাড়া লেনের ভুজঙ্গ ধরের বাড়িতে।
সেখান থেকেই বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সেই রাতেই পিস্তল ও টোটাগুলি বিলি করে দেওয়া হয়। তিন দিন পরও হাবু ফিরে না আসায় ২৯ আগস্ট বিকেলে প্রিক সাহেব ঘটনাটি পুলিশকে জানান।

৩১ আগস্ট গিরীন্দ্রানাথ, অনুকূল চন্দ্র, নরেন্দ্রনাথ ভট্যাচার্য, কালিদাস বোস ও ভুজঙ্গ ধরকে গ্রেফতার করা হয়। বিপিন গাঙ্গুলি গা ঢাকা দেওয়ায় তাঁকে ধরা যায়নি। ২৭ সেপ্টেম্বর বিলি না হওয়া ২১২০০ টোটাসহ হরিদাস দত্তকে পুলিশ বড়বাজার এক গুদাম থেকে গ্রেফতার করে। মূল কর্তা হাবু তখন রংপুরে। পরে হাবু আশ্রয় নেয় অসমের গোয়ালপাড়াত। সেখান থেকে হাবু মণিপুরে চলে যায়। এরপর হাবুর আর কোন খোঁজ মেলেনি।

১৯১৫ সালের ৮ মার্চ ‘বেনিফিট অফ ডাউটে’ গিরীন্দ্রনাথ ও অনুকূল চন্দ্র ছাড়া পান। কারাদন্ড হয় ভুজঙ্গ ধর হরিদাস দত্ত, কালিদাস বসুদের। ততদিনে চুরি যাওয়া পিস্তল ও টোটা বাংলার বিপ্লবীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন। বাঘা যতীন এই পিস্তল আর টোটা নিয়ে বুড়িবালামের তীরে যুদ্ধ করলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কারণ যুদ্ধের জন্য যথেষ্ট অস্ত্র তাঁদের কাছে ছিল না।
বাঘা যতীনদের কাছে পৌঁছানোর কথা ছিল আটক হওয়া ২১২০০ টোটা। যা পৌঁছায়নি অজানা মাড়োয়ারি ছেলের বিশ্বাসঘাতকতায়। সেই টোটাগুলির সন্ধান পুলিশকে বলে দেয়। ধরা পরা টোটাগুলি ধরা না পরে যদি বাঘা যতীন পেতেন তাহলে বুড়িবালামের যুদ্ধের ইতিহাস হয়তো বদলাতেও পারত। বুড়িবালামের তীরের শেষ ৭৫ মিনিটের যুদ্ধটায় আর একটু সময় বেশি টিকেও থাকা যেত হয়তো। যদির কথা নদীতে। আর বাকি সবই ইতিহাস।

বিপ্লবী বাঘা যতীনের হলদিঘাট বুড়ি বালামের তীরের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন,

"বাঙালির রণ দেখে যা তোরা
রাজপুত, শিখ, মারাঠী জাত
বালাশোর, বুড়ি বালামের তীর
নবভারতের হলদিঘাট।"

তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনে চিত্তরঞ্জন দাশ বলেছিলেন, ‘‘আমরা মশলা পিষতে শালগ্রাম শিলা ব্যবহার করেছি।’’

মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, "আমার জীবনে একটি মাত্র মানুষকে একপ্রকার অন্ধের মতো অনুসরণ করতাম, সেই মানুষটির আদেশ আমি ভুলতে পারতাম না। তিনি আমাদের দাদা ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি আমাদের সর্বাধিনায়কও ছিলেন।"

আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ, ২৩ ভাদ্র) তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়, "বাঘা যতীনের জীবন বাহিরের কোলাহলের মধ্যে নহে, সংবাদপত্রের ঢক্কানিনাদের মধ্যে নহে, প্রচলিত পলিটিক্যাল হাটের মধ্যে নহে, একান্ত নিভৃত, নীরব সাধনায় নিজেকে বিকশিত করিয়াছিল, সমুদ্রের গভীর তলদেশ-সঞ্চারী বিশালাকায় তিমির মত সমাজের গভীরতম অন্তর আলোড়িত করিয়াছিল, আয়েসী, বিলাসী, অপদার্থ বলিয়া জগতে পরিচিত বাঙালি যুবককে শ্রদ্ধা, ভীতি ও সম্ভ্রমের বস্তু করিয়া তুলিয়াছিল। বিধাতার একই কর্মশালা থেকে বাহির হইয়াছেন বিবেকানন্দ ও যতীন্দ্রনাথ।"

 


(তথ্যসূত্র:
১- Bagha Jatin: Life in Bengal and Death in Orissa by Prithwindra Mukherjee, Manohar (২০১৬)।
২- বাঘা যতীন, মনি বাগচী।
৩- বাংলার পাঁচ স্মরণীয় বিপ্লবী: সম্পাদনা-দেবপ্রসাদ জানা, দীপ প্রকাশন (২০০৮)।
৪- বাঘা যতীন: পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। দে'জ পাবলিকেশন (২০০৩)।
৫- স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, ন্যাশনাল বুকস এজেন্সি (২০০৯)।
৬- বাংলার মুক্তি সন্ধানী: সব্যসাচী চট্টপাধ্যায় ও রাখী চট্টপাধ্যায়, মে ২০০৫ সাল।
৭- Bagha Jatin: An Unsung Hero by Dr. Rup Narayan Das (২০০৭)।
৮- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ই আগস্ট ২০১৯ সাল।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ