সব ঘটনাই বাংলায় ।। পঙ্কজ



#১
পাড়ায় আমার বাড়ির পাশে একটা মুদিখানা আছে। সাহু শপ। বাবা এবং ছেলে মিলে দোকানটি চালায়। দুজনের সঙ্গেই আমার ভালো আলাপ আছে। ছেলেটির নাম পবন। ওরা বিহার থেকে কলকাতায় এসেছে ব্যবসা করতে। প্রায় ৯-১০ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছে।  বাবা ছেলে দুজনেই প্রচন্ড পরিশ্রমী। ওর বাবা খুব ভালো খিচুড়ি বানাতে পারেন। পাড়ার বিভিন্ন পুজোতে খিচুড়ি বানানোর দায়িত্ব ওর বাবার ওপরেই পরে। পবনের যখন বিয়ে হল, খাবারের মেনুর মধ্যে বেশিরভাগ বাঙালি খাবার ছিল। পবনের সঙ্গে আমার যখন কথা হয়, বাংলাতেই হয়। ও খুব ভালো বাংলা বলতে পারে। 'কেন কি' বলে না। 'কারণ' বলে। সঠিক বাংলাই বলে। ওর যখন কোনো শব্দ বাংলায় বলতে অসুবিধা হয় বা বুঝতে অসুবিধা হয়, ও আমাকে হিন্দিতে বলে বা আমি ওই শব্দটার মানে ওকে হিন্দিতে বুঝিয়ে দিই। যারাই ওর কাছে জিনিসপত্র কিনতে আসে প্রায় বেশিরভাগ মানুষই বাংলায় কথা বলে। ওর বাবাও বাংলাতে কথা বলে।

আগে ও আমাকে মাঝেমধ্যে বলতো, 'একটু হিন্দিতে কথা বলবি।' হয়তো ওর 'নিজের ভাষায়' মাঝে মধ্যে কথা বলতে ইচ্ছে করে। ওর মাতৃভাষাকে মিস করে। আমি ওকে একদিন বুঝিয়ে বলি যে ওদের মাতৃভাষা হিন্দি নয়। ও বলে যে ওরা মৈথিলিতে কথা বলতো। তারপর কেমনভাবে যেন হিন্দি ঢুকে গেছে।

এখন ও খুব কম হিন্দি বলে। মৈথিলিতে কথা বলে মাঝে মধ্যে। আমি বাংলাভাষায় বলি।

আমাদের পাড়ায় আবার কিছু ব্যক্তি আছেন যারা বাঙালি, কিন্তু পবনের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলে। আমি অনেক সময় দেখেছি পবন হিন্দির প্রত্যুত্তরে বাংলাতে কখনো মৈথিলিতে এবং অনেকসময় যখন দোকানে ভিড় থাকে তখন বাঙালি হিন্দিভাষীদের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলে।


#২
এখন প্রায় সর্বত্রই বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করে দেন যাতে সন্তান ভালো ইংরেজি বলতে পারে। আশায় থাকেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়লে ছেলে-মেয়েরা 'মডার্ন' হবে, 'ওয়েল এডুকেটেড' হবে।

আমাদের পাড়াতেও একই অবস্থা। যাদের একটু টাকা-পয়সা হচ্ছে বা আছে, এরকম ঘরের বাবা-মায়েরা তাদের ছেলে-মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন। এদের অনেকের প্রাইভেট টিউটরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব থাকার সুবাদে আমি জেনেছি যে সেইসব ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনার মান খুব একটা ভালো নয়। খুব হড়বড় করে সিলেবাস শেষ করে দেয়। শিক্ষার্থী কিছু বুঝলো কি বুঝলো না তাতে স্কুলের শিক্ষকদের কিছু যায় আসে না। তারা একইদিনে একটি বিষয়ের দুটো চ্যাপ্টার পড়ান। এরপর রয়েছে বাড়ির প্রাইভেট টিউটরের পড়া। এইসব মিলে নাজেহাল অবস্থা। যারা নীচু কক্ষে পড়ে, কেজি ওয়ান বা টু-থ্রি-ফোর, তাদের অবস্থা আরও খারাপ। প্রতি মুহূর্তে ধমক, মার খেতে হয় তাদের।

আমার এক প্রতিবেশীর ঘরেও একই ব্যাপার। সেখানেও জোর করে শিক্ষা গেলানোর যুদ্ধ প্রতিনিয়ত চলে। ওদের মতে, সেন্ট্রাল বোর্ডের যত স্কুল আছে সব স্কুলই ভালো। বাংলা বোর্ডের স্কুলগুলো জঘন্য।

আমি একবার হাদা-ভোদা কমিকসের একটা সেট উপহার দিয়েছিলাম আয়ুশকে; প্রতিবেশীর ছেলে। আয়ুশ ক্লাস টুয়ে পড়ে।

একদিন ওর বাবা আমাকে এসে সরাসরি বললেন, ছেলেকে হাদা-ভোদা বই দিয়েছো গিফট হিসেবে! ও তো পড়াশোনা এমনিই করে না, তার ওপর আবার ওই বাংলা বইটা ওর মাথা খেয়ে নিচ্ছে। জানো, বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে আর মাঝে মধ্যে হাসে। পড়তে পারে না কিন্তু হাসে কেন বুঝি না!

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন ও বাংলা পড়তে পারে না?

আয়ুশের বাবা বললেন, বাংলা আবার পড়ে নাকি কেউ! বাংলা শিখে কি হবে? চাকরি করতে গেলে তো ইংলিশ আর হিন্দিই লাগবে। ওদের স্কুলে বলে দিয়েছে বাংলায় একদম কথা নয়। হয় ইংরেজি অথবা হিন্দি।

আমি একটু আশ্চর্য হলাম। বললাম, কি বলছেন? স্কুলে বাংলা বলতে বারণ করেছে? ও তো বাঙালি। আপনি তো বাঙালি। বাংলাভাষা তো আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের গর্ব।

আমাকে আরো চমকে দিয়ে তিনি বললেন, ধুর মশাই। ওসব ভুলে যান। এখন বাংলা চলে না। কাজ পেতে হলে হিন্দি, ইংরেজি জানতেই হয়। আমাকে একটা দেখাতে পারবেন যে শুধুমাত্র বাংলা জেনে ভালো কাজ পেয়েছে। এখন হিন্দির যুগ। ওর স্কুলে তো ওইজন্যেই বাংলা শেখায় না। ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ইংলিশ। সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দি।

এরপর হিন্দির স্বপক্ষে একরাশ যুক্তিহীন বকবক করে আয়ুশের বাবা সুনির্মলবাবু নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।


#৩
আমার অফিসের সহকর্মী মৃন্ময় থাকে কাঁকিনাড়ায়। ওখান থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে কলকাতায় আসে কাজ করতে। প্রথম যখন ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল, ও প্রথমেই আমাকে কাজের বিষয়ে একটা দীর্ঘ কথা বলেছিল হিন্দিতে।
বেশিরভাগ বাঙালিই প্রথম আলাপে আমার নাম শুনে হিন্দিতে কথা বলা শুরু করে। আমি ওর সঙ্গে যখন পরিষ্কার বাংলাতে কথা বললাম, ও একটু অবাক হয়েছিল। ওর মুখের ভাব দেখে সেরকমই মনে হয়েছিল আমার। হয়তো প্রত্যুত্তর বাংলায় এসেছিল বলে। মৃন্ময় বাঙালি।

তারপর থেকে ও বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে আমার সঙ্গে।


আমি একটি নামকরা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কম্পিউটার শিখতে যেতাম। সেখানে এক হিন্দিভাষী বন্ধুর সঙ্গে আমার ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। ও প্রথম প্রথম আমার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলত। আমি বলতাম বাংলায়। কিছুদিন পরেই ও আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলা শুরু করল। বন্ধুটির নাম রীতেশ। বজবজে থাকে।

ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার তথা হেড ফ্যাকাল্টির সঙ্গে যখনই আমার কথা হত, তিনি হিন্দিতে কথা বলতেন। তিনি প্রায়ই ভুলে যেতেন যে আমি বাঙালি। আমি যখন ওনার সঙ্গে বাংলায় কথা বলতাম, তখন উনি বাংলায় কয়েকটা শব্দ ব্যবহার করে ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করতেন। স্যার বাঙালি ছিলেন।


#৪
আমাদের পাড়ার বিশেদা। শুধু আমাদের পাড়ায় নয়, আশেপাশের সব পাড়ায় বিশেদার নাম শোনেনি এমন একটিও নেই। বিড়াল, কুকুর এমনকি ইঁদুর পর্যন্ত রাস্তায় মরে পড়ে থাকলে বিশেদার ডাক পরত। বিশেদা সেই মৃত পশুদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যেত। আগে মিউনিসিপ্যালিটির নর্দমা ডিপার্টমেন্টে ছিল। নর্দমা পরিষ্কার করত এবং প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে নর্দমায় প্লাস্টিক ফেলা নিয়ে ঝামেলা করত। বিশেদার প্রতিদিনের ঝামেলায় লোকে অতিষ্ঠ হয়ে শেষমেষ প্লাস্টিক ফেলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। এবং পুরস্কার স্বরূপ বিশেদাকে নর্দমা পরিষ্কারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে মৃত পশু তুলে ভাগাড়ে ফেলে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এখন নর্দমায় গাদা গাদা প্লাস্টিক জমে থাকে।

এহেন বিশেদা তার জীবনে কোনোকালেই বাংলা ছাড়া দ্বিতীয় ভাষা বলেনি। অবাক করা ব্যাপার তাই না! হিন্দি আগ্রাসনের যুগে কি করে যে ও শুধু বাংলাভাষাতেই কাজ চালাত তা ভাবলে আমরা এখনও অবাক হয়ে যাই। ইংরেজির গুটিকয়েক চলতি শব্দ জানতো। হিন্দির কিছু শব্দের মানে জানতো, কিন্তু কস্মিনকালেও হিন্দি বলতে শুনিনি ওকে। ও হিন্দি বলতে পারতো না। কেউ যদি ওকে একটানা হিন্দিতে কিছু বলতো, ও তাকে অনুরোধ জানাত বাংলায় বলার জন্য। কেউ ওকে হিন্দিতে প্রশ্ন করলে যদি তার মানে ও বুঝতে পারত তো তার উত্তর বাংলায় দিত। ইংরেজির ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। কিন্তু এই হিন্দি না জানার জন্য পাড়ার বাঙালি লোকগুলো ওকে খ্যাপাতো। ওর সঙ্গে ইচ্ছে করে হিন্দিতে কথা বলত। বিশেদা যখন বুঝতে পারত যে ওকে নিয়ে মজা করা হচ্ছে, শুরু হত বিশেদার বাংলায় সুমধুর বচন; বাংলার ঐতিহাসিক খিস্তি থেকে শুরু করে নতুন ধরনের সব খিস্তি, যা একমাত্র বাংলার ফুটবল ম্যাচের সময় শুনতে পাওয়া যায়। মজারুর দল কানে হাত চাপা দিয়ে কেটে পড়ত।

বিশেদার এই বাংলা প্রীতি ছাড়াও আরো একটি বিষয় ছিল সেটি হল বাংলা গান। চায়ের দোকানে প্রতি বিকেলে কমপক্ষে তিন-চারটে গান শোনানোর আবদার তাকে মেটাতেই হত। গানের নিয়ম কানুন না জেনেও এত অসাধারণ গান করত যে লোকে মোহিত হয়ে শুনত। কি অসাধারণ গলার ওঠাপড়া, সুর-তাল-লয়ের মিশেল, যেন একদম পেশাদার গায়ক।

বিশেদার মৃত্যুর সময় যখন ওর বাড়িতে গেছিলাম, অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম বিশেদার পুরনো বাংলা গানের টেপ ক্যাসেট কালেকশনের দিকে তাকিয়ে। দেওয়ালে কাঠের তাকে থরে থরে সাজানো পুরনো সব বাংলা সিনেমা, অ্যালবামের টেপ ক্যাসেট। পাশেই রাখা একটা টেপ মেশিন এবং তার পাশে একটা ডিভিডি প্লেয়ার। দেওয়ালের এক কোণে রাখা একটা ব্যাগ জুড়ে কম্প্যাক্ট ডিস্কের বান্ডিল। সব বাংলা গান।

একবার বিশেদা আমাদের কাছে আক্ষেপ করে বলেছিল, 'হিন্দি জানি না বলে লোকে খ্যাপায়। কিন্তু ওরা তো নিজেরাই বাংলাটা ঠিকঠাক জানে না। এরকম সমৃদ্ধ ভাষাকে ভুলে গিয়ে হিন্দি নিয়ে নাচানাচি করছে। আজে বাজে হিন্দি গানে গলা মেলাচ্ছে। এরপর হয়তো একদিন বাংলাভাষা, বাংলা গান আর থাকবে না। লোকে হিন্দি বলবে, ইংরেজি বলবে। আর যারা বলতে পারবে না, তারা বোবা হয়ে থাকবে।'



ক্রমশ শেষ হতে চলেছে বাংলাভাষা। কেউ হিন্দিতে কথা বললে বাঙালিরা বাংলা জেনেও বলছে হিন্দিতে। ফলে অহিন্দিভাষীরা, যারা হয়তো চেষ্টা করলে বাংলাতে কথা বলতে পারত, হিন্দিতে কথা বলছে। এবং এইভাবে যখন হিন্দিভাষার ব্যবহার বেড়ে যাবে আশেপাশে, তখন বাংলার অস্তিত্ব আর থাকবে না। হিন্দিভাষার প্রতি আমার কোনো রাগ বা বিদ্বেষ নেই। আমার আশঙ্কা হিন্দির আগ্রাসনের শিকার হয়ে বাংলাভাষা যেন চিরবিলুপ্তির পথে না চলে যায়।

বিভিন্ন হিন্দিভাষী রাজ্যে প্রচুর বাঙালি থাকে, সেখানে কিন্তু হিন্দিভাষীরা বাংলায় কথা বলে না। বলে হিন্দিতে। এবং বাঙালিরা বাধ্য হয়ে অথবা স্বেচ্ছায় হিন্দি বলে। তাই নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা, বাঙালি জাত্যাভিমান এসব না থাকার জন্যে বাংলাভাষা, বাংলার সংস্কৃতি এসব মুছে যাবে ধীরে ধীরে। এরপর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা নিজের ভাষা ভুলে সুনির্মল অথবা মৃন্ময়ের মতো হয় অন্য ভাষায় আশ্রয় নেবে অথবা বোবা হয়ে যাবে।

বাঙালিই বাংলাভাষার শত্রু। তাই বাঙালিকে আগে নিজের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। 'হিন্দিভাষী তাড়াও' স্লোগান দিয়ে বাংলা ভাষা বাঁচানোর চেষ্টা করলে বিভেদ তৈরি করা ছাড়া আর কিছু হবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

Alice বলেছেন…
Appreciate tthis blog post
X

Never Miss an Update!

Join my newsletter to get the latest posts from littlemag.in directly to your inbox.