পুরানো সেই দিনের কথা: কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর - এক নিঃসঙ্গ জীবনের অজানা গল্প ।। রানা চক্রবর্তী



জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সকলের যা-ইচ্ছে-তাই লেখার একটা খাতা ছিল। ‘পারিবারিক খাতা’।

১৮৮৮-র নভেম্বরে হিতেন্দ্রনাথ সেখানে লিখলেন, তাঁর রবিকাকার মেয়ে হবে না। হবে মান্যবান, সৌভাগ্যবান, রবীন্দ্রনাথের চেয়েও গম্ভীর একটি ছেলে। সে-মাসেরই ২৭ নভেম্বর, মৃণালিনী আর রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে এলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গায়ের রং সেই তখন থেকেই চাপা। পেরিয়ে যাই বছর কয়েক।

সাত-আট বছর বয়সে একবার শিলাইদহ থেকে রথী ফিরে এলেন রোদে জলে পুড়ে। যেন আরও একটু ‘কালো’ হয়ে। পাশেই গগনেন্দ্রনাথদের বাড়িতে জ্যাঠাইমাকে প্রণাম করতে গেলেন। তিনি বললেন, ‘‘ছিঃ, রবি তাঁর ছেলেকে একেবারে চাষা বানিয়ে নিয়ে এল।’’

কথাটা সে দিন খুব মনে লেগেছিল রথীন্দ্রনাথের। এতটাই যে, তার পর থেকে ওই বাড়ি যাওয়াই ছেড়ে দিলেন তিনি। আর এমনই কাণ্ড, বাংলার পল্লিমঙ্গলের স্বপ্ন দেখে, সেই ‘চাষা’ হয়ে ওঠার পাঠ নিতেই, ছেলেকে তার পর একদিন সত্যি-সত্যি বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ! 


● আশ্রম থেকে আমেরিকায় ~

১৯০৬। স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউ তখন তুঙ্গে। রথীন্দ্রনাথ আর আশ্রমে তাঁর সহপাঠী সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ পাঠিয়ে দিলেন ছাত্রদের এক দলের সঙ্গে জাপানে। কিছু দিন পর দু’জনে পৌঁছলেন আমেরিকার আর্বানায়, ইলিনয়ের স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই হয়েছিলেন কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক।

১৯০৭-এ আমেরিকা থেকে রথী বাবাকে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে লিখছেন একবার ফসল দিয়ে ঝিমিয়ে-পড়া মাটি। জানাচ্ছেন, বিদেশে তিনি যে কেবল মাটিই ‘বিশ্লেষ’ করছেন তা নয়, পরীক্ষা চলছে শস্য এবং পশুখাদ্য নিয়েও।

২১ জুন ১৯০৮। ছেলেকে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে লিখলেন, ‘‘...আমাদের দেশের হাওয়ায় কী চাষা কী ভদ্রলোক কোনও মতে সমবেত হতে জানে না। তোরা ফিরে এসে চাষাদের মধ্যে থেকে তাদের মতিগতি যদি ফেরাতে পারিস তো দেখা যাবে।’’ 


● ফিরেই হলেন ‘চাষা’ ~

বাবাকে নিরাশ করলেন না রথী। রবীন্দ্রনাথের ডাকে জমিদারি দেখাশোনার কাজে ১৯০৯-এ ফিরে এলেন শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে।

রবীন্দ্রনাথ যেন এই সময় একেবারে আঁকড়ে ধরলেন রথীকে। তাঁকে চেনালেন বাংলার পল্লিসমাজ।

ছেলের মুখে কৃষিবিদ্যা, প্রজননশাস্ত্র, অভিব্যক্তিবাদের কথা শুনতেন খুব মন দিয়ে।

রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘১৯১০ সালের সেই সময়টাতে আমরা পিতাপুত্র পরস্পরের যত কাছাকাছি এসেছিলাম তেমন আর কখনো ঘটেনি।’’

শিলাইদহে রথীন্দ্রনাথ গড়ে তুললেন প্রশস্ত খেত। মাটি পরীক্ষার গবেষণাগার। বিদেশ থেকে আমদানি করলেন ভুট্টার এবং গৃহপালিত পশুর খাওয়ার মতো ঘাসের বীজ। তৈরি করালেন দেশের উপযোগী লাঙল, ফলা, আর নানা যন্ত্রপাতি।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কাছ থেকে পাতিসরের জন্য চেয়ে আনলেন একটা ট্রাক্টর। চালাতেন নিজেই।

বাংলার কৃষি আর কৃষকের হাল ফেরাতে যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন রথী, তখন আবার এল রবীন্দ্রনাথের ডাক। এ বার নাকি তাঁর বিয়ে!


● এলেন প্রতিমা ~

মৃণালিনী রথীর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের ভাগ্নী প্রতিমার সঙ্গে। ছেলের বিয়ে দিতে তখনই রাজি হননি রবীন্দ্রনাথ।

১৯১০-এ তত দিনে বাল্যবিধবা সেই প্রতিমাকেই ঘরে আনা ঠিক করে, রথীকে খবর পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ।

পাঁচ বছরের ছোট প্রতিমার গুণে যে তিনি পাগল, সে-কথা  জানিয়ে ভগ্নিপতি নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘প্রতিমা এখন আমার... সে কী চমৎকার মেয়ে তোমাকে কী করে লিখি।’’

আর একবার খোদ প্রতিমাকেই লিখেছিলেন, ‘‘আমি কখনই একজন কুশ্রী মেয়েকে সম্পূর্ণ ভালবাসতে পারতুম না— আমার সে দুর্ব্বলতা আমি স্বীকার করছি।’’

২৭ জানুয়ারি ১৯১০। হল বিয়ে। নিজের বিয়ে নিয়ে স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, ‘‘আমাদের পরিবারে এই প্রথম বিধবা বিবাহ।’’

বিয়ের কয়েক মাস পর প্রতিমাকে শিলাইদহে নিয়ে এলেন রথী। এর পর হঠাৎ একদিন আবার ডাক রবীন্দ্রনাথের!

শান্তিনিকেতনে আশ্রমবিদ্যালয়ে এ বার তাঁর দরকার রথীকে!
কুঠিবাড়ির চার দিকের গোলাপ বাগিচা, একটু দূরে সুদূরবিস্তারী খেত, সেই পদ্মা নদী, সেই কত সুখদুঃখের কাহিনি মোড়া বজরা... বাবার এক ডাকে সব ছেড়ে এলেন রথীন্দ্রনাথ। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘এই-সব যা কিছু আমার ভাল লাগত— সেই সব ছেড়ে আমায় চলে যেতে হল বীরভূমের ঊষর কঠিন লাল মাটির প্রান্তরে।’’


● জাগিয়ে তোলার ভার ~

২ মে ১৯১০-এ লেখা এক চিঠিতে অনভিজ্ঞ, ‘ছেলেমানুষ’ প্রতিমার প্রতি রথীন্দ্রনাথের কর্তব্য তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন, ‘‘... তার চিত্তকে জাগিয়ে তোলবার ভার তোকেই নিতে হবে— তার জীবনের বিচিত্র খাদ্য তোকে জোগাতে হবে। তার মধ্যে যে শক্তি আছে তার কোনোটা যাতে মুষড়ে না যায় সে দায়িত্ব তোর।’’ কিন্তু ভিতরে-ভিতরে কোথাও মুষড়ে পড়েছিলেন যেমন রথী, তেমনই প্রতিমা। এতটাই যে, এক চিঠিতে স্ত্রীকে রথীন্দ্রনাথ জানালেন, ‘‘কতদিন বোলপুরের মাঠে একলা পড়ে যে কেঁদেছি তা কেউ জানে না। তুমিও না।’’

চাইলেও নিজেকে মেলে ধরতে না পারার অক্ষমতার কথা জানিয়ে লিখলেন, ‘‘ভগবান আমাকে বোবা করে জন্ম দিয়েছেন।’’


● লজ্জা ভাঙানোর ডাক ~

প্রতিমাকে লেখা রথীন্দ্রনাথের তারিখবিহীন কয়েকটা চিঠিতে বোঝা যায়, দু’জনের বোঝাপড়ার এক সময় কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছিল।

মন খুলে দু’জনে আসতে পারছেন না কাছাকাছি। রথী লিখছেন প্রতিমাকে, তাঁর শুষ্ক, শূন্য সত্তার ভিতরেও আছে, ‘‘আর একটাকেও যে খুব ভালোবাসতে চায়, যে খুব সুন্দর হতে চায়... কিন্তু তার একটি দোষ আছে সে ভারী লাজুক।’’

তার পর প্রতিমাকেই রথী দিচ্ছেন সেই লাজুক মানুষটার আড়াল থেকে তাঁর প্রকৃতিকে টেনে বের করে আনার ভার। মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘আর তা যদি না পারো তো চিরকাল তোমাকে কষ্ট পেতে হবে— তার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করো।’’

আর একবার লিখলেন, ‘‘তোর মনটা সম্পূর্ণ পাবার জন্যে আমি কিরকম ব্যাকুল হয়ে থাকি তা তুই জানিস না।’’

১৯২২-এ দু’জনের সংসারে এলেন নন্দিনী, তাঁদের পালিতা কন্যা হয়ে। ‘দাদামশায়’ রবীন্দ্রনাথের রাখা আদরের নাতনি নন্দিনীর অনেক নামের মধ্যে একটা ছিল ‘পুপে’। সম্ভাব্য নাতির জন্যও একটা নাম আগলে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তেইশ বসন্ত অপেক্ষার পর ‘রাসভেন্দ্র’ নামটা কবি দিয়ে দিলেন প্রিয়ভাজন সুরেন্দ্রনাথ করকে।


● উপাচার্য হয়েই জড়ালেন বিতর্কে ~

ইলিনয়ে ছাত্রজীবনে রথীর সঙ্গে পরিচয় হওয়া ভাষার অধ্যাপক আর্থার সেমুর-এর স্ত্রী মেস সেমুরকে রথীন্দ্রনাথ আগেই লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার পর তাঁর মূল কাজ ছিল, বিশ্বভারতীর ভাঙন ঠেকিয়ে রাখা।

এক সময় তিনি চাইলেন, বাবার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানকে একটা স্থায়িত্ব দিয়ে যেতে। ১ নভেম্বর, ১৯৪৮। ইংরেজি এক চিঠিতে মেস সেমুরকে লিখলেন, বিশ্বভারতীর কাজ তাঁকে আর আনন্দ দেয় না, নৈতিক কর্তব্য পালনের তাগিদেই সে কাজ করে থাকেন শুধু। বহু বছর ছিলেন কর্মসচিব।

১৯৫১-য় বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলে, রথীন্দ্রনাথ হলেন তার প্রথম উপাচার্য।

তার পরই বুঝলেন, কবির আশ্রম থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে বদলে যাওয়াটা আসলে এক বিপর্যয়! ক্ষমতার রাজনীতি ছিলই, তার সঙ্গেই এ বার বিশ্বভারতীতে জুড়ে গেল নিয়মের ঘেরাটোপ!

তার মধ্যেই ব্যক্তিগত আক্রমণ আর কুৎসায় নাজেহাল হয়ে গেলেন রথীন্দ্রনাথ। আর্থিক অনিয়মের মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসানোর চেষ্টাও হল তাঁকে। বাঁচাল আদালত।

● কাল হল সাহসী বন্ধুত্ব ~

সব গুঞ্জনকে ছাপিয়ে গেল আশ্রমের অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর তাঁর স্ত্রী মীরার সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের প্রথাভাঙা অন্তরঙ্গতা।

ও দিকে নির্মলচন্দ্র আর মীরাকে শান্তিনিকেতন থেকে সরিয়ে দেওয়ার মৌখিক পরামর্শ দিয়ে, উপাচার্য রথীন্দ্রনাথের কাছে খবর পাঠালেন আচার্য জওহরলাল নেহরু।

এতেই যেন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল অপমানিত রথীন্দ্রনাথের। পদত্যাগ করলেন তাঁর কাছেই।

কারণ হিসেবে লিখলেন, তাঁর শরীর খারাপ। ঠিক করলেন, বিশ্বভারতীর কলুষিত পরিবেশ ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবেন।

সেই স্বেচ্ছা-নির্বাসনে তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য নির্মলচন্দ্রের কাছে তার পর তিনি করে বসলেন এক ‘অসম্ভব দাবী’। নির্মলের কাছে এক রকম সোজাসাপটা চেয়েই বসলেন বয়সে একত্রিশ বছরের ছোট মীরাকে। এই চাওয়ার কথা প্রথম স্বীকার করে চিঠি লিখেছিলেন নির্মলচন্দ্রকে। তারিখ ছিল ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩।

১৯১৮-য় নির্মলচন্দ্র ছিলেন আশ্রমের ছাত্র, এর পর রবীন্দ্রনাথের ডাকে ১৯৩৮-এ সেখানেই ফিরে আসেন ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে।

কোলের ছেলে জয়ব্রতকে নিয়ে মীরাকে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেহরাদুনে গিয়ে বসবাসের সম্মতিও দিয়ে দিলেন তাঁর উদার-হৃদয় স্বামী। নিজে রইলেন মেয়েকে নিয়ে। যাওয়ার আগে প্রতিমাকে রথীন্দ্রনাথ লিখে গেলেন, ‘‘আমি লুকিয়ে চুরিয়ে যাচ্ছি না, এখানে সবাইকে জানিয়েই যাচ্ছি মীরা আমার সঙ্গে যাচ্ছে।’’

রথীন্দ্রনাথের নিজের কথায়, বিশ্বভারতী থেকে তাঁর ‘মুক্তি’ পাওয়ার দিন ২২ অগস্ট ১৯৫৩। আর আশ্রম ছেড়েছিলেন তার দু’-একদিন পর।


● জগৎ যখন ‘মীরু’ ~

১৯৫৩ থেকে ১৯৬১। দেহরাদুনে প্রথমে তিনটে ভাড়াবাড়ি। তার পর ’৮৯-এ রাজপুর রোডে তাঁর নিজের তৈরি বাড়ি ‘মিতালি’তেই মীরাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন রথীন্দ্রনাথ।

দেহরাদুনে স্বামীর বাড়ির সামনে দিয়ে মুসুরি যাওয়ার পথে প্রতিমা একবার শুধু দেখতে পেয়েছিলেন, বারান্দা থেকে ঝুলে থাকা নতুন শাড়ি। রথীন্দ্রনাথের বোন, দাদার সঙ্গিনী মীরা প্রসঙ্গে একবার মেয়েকে লিখেছিলেন, ‘‘...ওনার সমস্ত ব্যক্তিত্ব ঐ মেয়ে গ্রাস করে নেবে।’’

এক সাময়িক বিচ্ছেদের সময় দেহরাদুনে বসে, তাঁর বেলাশেষের আলো মীরা চট্টোপাধ্যায়কে তারিখবিহীন এক চিঠিতে রথীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘‘আমার কেবল মীরু আছে— সে-ই আমার সমস্ত জগৎ ব্রহ্মাণ্ড। তাকে ছাড়া আমি কিছুই নই— আমার কোনও অস্তিত্ব নেই। তাকে আমার সবকিছু দিয়েছি— নিজেকেও সপেঁ দিয়েছি।’’

অন্য এক চিঠিতে মীরার সঙ্গে দেখা হওয়ার অপেক্ষায় আকুল রথীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখছেন, ‘‘সময় যত কাছে আসছে মন আরও অস্থির হয়ে উঠছে। কী করে শান্ত করি বল তো?... তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার পর থেকে এতদিনের ছাড়াছাড়ি এই প্রথম। বাপরে আর যেন এরকম না ঘটে।’’

চিঠি লিখতেন মীরাও, তাঁর ‘রথীদা’-কে। যদিও এযাবৎ খোঁজ নেই রথীন্দ্রনাথকে লেখা মীরা চট্টোপাধ্যায়ের কোনও চিঠির। দেহরাদুনে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে মীরা ও তাঁর শিশুপুত্র ছাড়াও থাকতেন মীরার মা। ছুটিছাটায় মেয়েকে নিয়ে নির্মলচন্দ্র এসে ঘুরে যেতেন কখনও।


● চাইলেন ভুলতে অভিমান ~

বিশ্বভারতী ছেড়ে তাঁর দূরে চলে যাওয়ার ইচ্ছের কথা জেনেই প্রতিমা রথীকে লিখেছিলেন, শুধু ‘‘ভাল আছ এই খবর পেলেই খুশী হব।’’ ভাল থাকার খবর দিয়ে দেহরাদুন থেকে প্রতিমাকে নিয়মিত মমতায় মাখা সব চিঠি লিখেছেন রথীন্দ্রনাথ।

ও দিকে অদৃষ্টের হাতে সব ছেড়ে দিয়েও রথীর জন্য উতলা হয়েছেন প্রতিমা।

১৯৬০। বাংলা নববর্ষের আগে প্রতিমাকে রথী লিখলেন, ‘‘আমরা দু’জনেই এখন জীবনের সীমান্তে এসে পড়েছি। এখন আর কারও প্রতি রাগ বা অভিমান পুষে রাখা (শোভনীয়) হয় না। সেইজন্য জেনো আমার মনে কোনও রাগ নেই— আমি সব ঝেড়ে ফেলেছি। আমাদের মধ্যে প্রীতি সম্বন্ধ অক্ষুণ্ণ থাকে এই নতুন বছরে তাই কামনা করি।’’

● ছুঁয়ে গেলেন আশ্রমের মাটি ~

রতনপল্লিতে ‘ছায়ানীড়’-এ মেয়ে নন্দিনীর নিজের বাড়ি শুরু হওয়ার আগে সেখানেই রথীন্দ্রনাথ চাইলেন, নিজের মাথা-গোঁজা আর কাঠের-কাজের জন্য দু’-একটা ঘর।

বললেন, উত্তরায়ণ আর ভাল লাগে না তাঁর। বাবার শততম জন্মবর্ষে একবার এসে ছুঁয়ে গেলেন আশ্রমের মাটি।

৪ মার্চ। মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরে যাওয়ার দিন গাড়িতে তুলে দিতে গিয়ে, তাঁর স্বামী গিরিধারী লালার সঙ্গে নন্দিনী সেই প্রথম দেখলেন, বহু দুর্যোগে এযাবৎ অবিচল বাবার চোখে জল।

৩ মে ১৯৬১। দেহরাদুনের ‘মিতালি’তে, রবীন্দ্রনাথের শতবাৰ্ষিক জন্মদিনের দিনকয়েক আগে, চলে গেলেন প্রতিভাবান পুত্র রথীন্দ্রনাথ। নির্বিবাদী, সিংহরাশি, ‘সেবক রথী’র বিষণ্ণ জন্মপত্রীতে তখন শুধু জেগে:  ‘অমিত নবমী পূর্ব্বফল্গুনী’।


★ অশেষ প্রতিভার রথীঠাকুর ~

এঁকেছিলেন মিশ্রমাধ্যমে বহু উল্লেখযোগ্য ল্যান্ডস্কেপ আর ফুলের ছবি।

চামড়ার উপর কারুকাজ, দারুশিল্পেও ছিল অনায়াস দক্ষতা।

আসবাব, স্থাপত্য, উদ্যান নির্মাণেও ছিলেন অনন্য।

তৈরি করতেন গোলাপ, জুঁই, মগরা সহ রকমারি ফুলের আতর আর সুগন্ধি পাউডার। তাঁর আতরের বাজারি নাম ছিল ‘Arty Perfume’।

রান্নার, জ্যাম, জেলি, আচার আর দই পাতার হাত ছিল চমৎকার।

চাষ করতেন মৌমাছির, নেশা ছিল শিকারেরও।

গান গাইতেন, বাজাতেন এস্রাজ।

চিঠি আর দিনলিপি ছাড়াও লিখেছেন কবিতা, গল্প প্রবন্ধ। ইংরেজিতে প্রকাশিত তাঁর বই “On the Edges of Time”। বাবার নির্দেশে অনুবাদ করেছিলেন অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’। তাঁর লেখা অন্য দুটি বই: ‘প্রাণতত্ত্ব’, এবং ‘অভিব্যক্তি’।

রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক সংবাদ কর্তিকার সংগ্রহে ইচ্ছুক হয়ে সদস্য হন লন্ডনের International Newspaper Clipping Service -এর। ছিলেন রবীন্দ্র-সৃষ্টির সংগ্রাহক।


■ কেমন আছে ‘মিতালি’ ~

দেহরাদুনে রথীন্দ্রনাথের বাড়ি ছুঁয়ে এসেছিলেন বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য শ্রী স্বপনকুমার দত্ত। তাঁর বয়ান অনুসারে:

"দেহরাদুনে গিয়েছিলাম কর্মসূত্রে। এখানেই বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য, রথীন্দ্রনাথের বাড়ি ‘মিতালি’র কথা নানা স্মৃতিচারণে পড়েছিলাম, যেখানে কেটেছিল তাঁর শেষ জীবন। ভাবলাম খুঁজে দেখি। বেরিয়ে পড়লাম ৮৯এ রাজপুর রোডের দিকে।

খুঁজে পেলাম দোতলা একটা বাড়ি, অবশ্য রথীবাবুর বাড়ি কি না, প্রতিবেশীরাও নিশ্চিত নন। প্রকাণ্ড প্রাচীর। দুর্ভেদ্য লোহার গেট। বাড়ির ভিতর প্রাচীন গাছ। দুটো বিলাসবহুল গাড়ি...

কিন্তু না আছে নেমপ্লেট, না সে বাড়ির নম্বর! শান্তিনিকেতনের উদয়নের আদলে গড়া রথীন্দ্রনাথের ‘মিতালি’র দোতলায় ছিল অতিথিদের জন্য সাজানো ঘর। জানালায় মোড়া রথীন্দ্রনাথের ঘর থেকে দেখা যেত পাহাড়ি উপত্যকা। বাগানে ফুলগাছের বাহার, স্ট্রবেরির ছোট খেত। বাগানের চৌবাচ্চায় ফুটত নীল শালুক, ভোরবেলা ভেসে আসত বনমোরগের ডাক। রথীন্দ্রনাথ মেতে থাকতেন শিল্প বা উদ্যান চর্চায়। কখনও বাজাতেন এস্রাজ।

হাত-বদল হওয়া বাড়িটা ভেঙেচুরে বদলানো হয়েছে। ফিরে আসব, এমন সময় চোখ আটকে গেল বুজিয়ে দেওয়া জানালার উপরে সিমেন্টের নকশায়! রথীন্দ্রনাথের সিগনেচার স্টাইল, যা ছড়িয়ে আছে শান্তিনিকেতনের উদয়ন আর গুহাঘরে। দেখলাম, সিমেন্টে খোদাই করা ফুলও। ‘‘এটাই মিতালি,’’ বললাম সঙ্গী উৎসাহীদের। তার পর বিষণ্ণ মনে ফিরে এলাম স্মৃতিভারাতুর বাড়িটির সামনে থেকে।"




(তথ্যসূত্র:
১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ই ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সাল।
২- পিতৃস্মৃতি (রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
৩- চিঠিপত্র: দ্বিতীয় খণ্ড (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
৪- রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর: জন্মশতবর্ষপূর্তি-শ্রদ্ধার্ঘ্য (অনাথনাথ দাস সম্পাদিত)।
৫- আপনি তুমি রইলে দূরে: সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথ (নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়)।
৬- রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন (সমীর সেনগুপ্ত)।
৭- On the Edges of Time (Rathindranath Tagore)।
৮- A Home in Urbana: Correspondences between the Tagores and Seymours (Supriya Roy Ed.) The Diaries of Rathindranath Tagore (Supriya Roy Ed.)।
৯- Rathindranath Tagore: The Unsung Hero (Tapati Mukhopadhyay and Amrit Sen Ed.)।
১০- বিশ্বভারতী রবীন্দ্রভবনের অভিলেখাগার।
১১- বিশেষ কৃতজ্ঞতা: শ্রী জয়ব্রত চট্টোপাধ্যায় ও শ্রী সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ