কুড়মি বিদ্রোহের মহানায়ক রঘুনাথ মাহাতো

রঘুনাথ মাহাতো

বিপ্লবী রঘুনাথ মাহাতো। তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা।

  • জন্মদিন -- ২১ মার্চ ১৭৩৮ 
  • জন্মস্থান -- ঘুটিয়াডি ঠাকুরবাড়ি, সরাইকেলা খরসাঁওয়া, ছোটনাগপুর অঞ্চল,ব্রিটিশ ভারত (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
  • মৃত্যুদিন -- ৫ এপ্রিল ১৭৭৮ (বয়স ৪০)
  • মৃত্যুস্থান -- দলমা, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)


শৈশব ও কৈশোর (১৭৩৮ - ১৭৬৫)

অনার্য সভ্যতার পালকপিতা দলমা পাহাড়ের পাদমূলে সুবর্ণরেখা এখানে রজতসূত্রের মতো প্রবাহিত। সরাইকেলা খরসাঁওয়া জেলার নিমডি প্রখন্ডের ঘুটিয়াডি গ্রামটি তখনও পল্লবঘন পলাশকানন, রাখালের খেলাগেহ। এই গ্রামের কাশীনাথ মাহাতো ও করমী মাহাতোর মধ্যবিত্ত পরিবারে, ২১ শে মার্চ জন্ম নিলেন রঘুনাথ, সালটা ১৭৩৮। ক্ষণজন্মা শিশুটি সার্থকনামা- আটটা নটার সূর্যের মতো তার তেজ। ডুংরির চূড়ায় চূড়ায় তাঁর নিত্য আনাগোনা- গ্রামবাসীদের চোখে সাক্ষাৎ অরণ্যদেব। 

বাপত্যা জমিতে উৎপাদনশীলতা কম। কাজেই কৃষক ও জমিদারের মধ্যে ভেদ কম, ভালোবাসা বেশি। তবু গাছের ফল, ক্ষেতের ফসল, কিম্বা চাকের মধু সবেরই বাখরা এঁরা পৌঁছে দেন স্থানীয় ভূমিজ সর্দারের বাড়িতে। বাকিটা সময় করম, নাটুয়া নাচ আর আড়বাঁশিতেই মেতে থাকেন রঘুনাথ মাহাতো। অবশেষে লোকমুখে শোনা কথাটাই সত্যি হল! হাতে রসিদ, মুখে ফিরিঙ্গি ভাষা ঝুলিয়ে খাজনার তাগাদা দিতে কাশীনাথের বাড়িতে এল স্থানীয় তহসিলদার। যে জমি তাঁর বাপ ঠাকুর্দার, সেই ধরতি মায়ের জন্য খাজনা দিতে হবে- এটা শুনে আর মাথা ঠিক রাখতে পারেন নি রঘু! সবুজ আদিবাসীর লাল রক্তে তখন ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ উঠেছে। ডান হাতে শান দেওয়া টাঁগি ঘোরাতে ঘোরাতে রঘু তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠেন, "পানি, বন, জমিন হামরাক হেকি, জান দেইলাই পারেঁই মিন্ত্যক খাজনা নি দিবে"! 


যৌবন (১৭৬৫-১৭৭৪)

ক্রমে বক্সার যুদ্ধের আঁচ এসে পড়ল ছোটনাগপুর অঞ্চলে। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি চাপ সৃষ্টি করল আঞ্চলিক জমিদারদের উপর। সেই চাপ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অত্যাচার রূপে চুঁইয়ে পড়ল কৃষকদের উপর। বনাঞ্চলের পোস্টম্যান রঘুনাথ মাহাতো পিঠে বিপ্লববাদের বোঝা নিয়ে ছুটে বেড়ালেন বিস্তৃত অহল্যাভূমি। নতুন যুগের স্বপ্ন দেখা নিয়ে তাঁর অক্লান্ত পদযাত্রার সাক্ষী রইলো নিমডি, পাতকুম, বরাভূম, ধলভূম, মেদিনীপুর, কিংচুগ পরগণা। 

১৭৬৯ সালে ফাগুনি পুর্ণিমার দিন নিমডি গ্রামে প্রকাশ্যে সমাবেশ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে, বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করলেন, "আপনা জমিন আপনা রাজ, দূর ভাগাও ইংরেজ রাজ"। পুলকা মাঝি, ডমন ভূমিজ, শঙ্কর মাঝিদের সহায়তায় সংগঠিত করলেন সাঁওতাল, ভূমিজ প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে। ঝগড়ু মাহাতোর সহযোগীতায় গড়ে তুললেন সশস্ত্র বাহিনী। লাঠি, তীর-ধনুক, ফারসা সজ্জিত পাঁচ সহস্রাধিক বিপ্লবীর আক্রমণে ধূলায় মিশে গেল ইংরেজদের সাধের নিমুধল কেল্লা। সেদিন ইংরেজ সৈন্যরা প্রান বাঁচাতে নরসিংহগড়ে পালিয়ে গা ঢাকা দেয়! এভাবেই একের পর এক ব্রিটিশ ঘাঁটির দখল নেন রঘুনাথ মাহাতোর নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীরা। 

১৭৭৪ সালে বিদ্রোহীরা কিংচুগ পরগণা (অধুনা সরাইকেলা খরসাঁওয়া) পুলিশ হেড কোয়ার্টার আক্রমন করে অত্যাচারী গোরাদের হত্যা করেন। তখন রঘুনাথাইটদের পরাক্রমে সমগ্র এলাকাটি কার্যত বিদ্রোহীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়। 


শেষ জীবন (১৭৭৪-১৭৭৮)

অতঃপর প্রমাদ গোণে ব্রিটিশরাজ। তড়িঘড়ি ছোটনাগপুরকে পাটনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীনে আনা হয়। কতিপয় স্বার্থলোভী জমিদার ও আভিজাত্যগর্বী বাঙালীবাবুরা রঘুনাথাইটদের "চুয়াড়" বলে দাগিয়ে দেয়! বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রধান সিডনি স্মিথ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের সিদ্ধান্ত নিলে গেরিলা যুদ্ধের মাস্টার মাইন্ড আন্দোলনের তরঙ্গশীর্ষটিকে রাঁচী জেলার সিল্লীতে সরিয়ে আনেন! ফলে গামারিয়া, সোনাহাতু, বুন্ডু, তামাড় প্রভৃতি স্থানে বিপ্লবের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। সিল্লীর লোটাকিতা গ্রামের বৈঠকে রচিত হয়, রামগড় পুলিশ ছাউনি আক্রমনের নীল নক্সা! 

সেদিনই ৫ই এপ্রিল, ১৭৭৮ ইংরেজ পুলিশের অতর্কিত আক্রমনের সামনে তীরধনুক হাতে রুখে দাঁড়ান বীর রঘুনাথ। গুলিবিদ্ধ ক্রান্তিবীর শেষবারের মতো সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করেন, 'হামর মরেক পরেও লঢ়াই চালাই যাবে হে, মনে রাখিস- শিখ শিখর নাগপুর, আধাআধি খড়গপুর, ইটাই হামর ছোটনাগপুর, ইটাই হামর মাঈভূঁই'। কথাগুলি শেষ করেই, অস্তমিত সূর্যের মতো দলমার কোলে ঢলে পড়লেন কুড়মি বিদ্রোহের মহানায়ক রঘুনাথ মাহাতো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

X

Never Miss an Update!

Join my newsletter to get the latest posts from littlemag.in directly to your inbox.