“দাখিল দরওয়াজা ও গৌড়ের ইতিবৃত্ত” ।। রাণা চক্রবর্তী


● ছবিতে- দাখিল দরওয়াজা, গৌড়, মালদা জেলা। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার জন হেনরি রাভেনশ এর তোলা ছবি।
(ছবি সৌজন্যে- ব্রিটিশ লাইব্রেরী, ইউনাইটেড কিংডোম।)



দাখিল দরওয়াজা অর্থ প্রবেশদ্বার (আরবি-দাখিল, ফারসি-দরওয়াজা)। সুলতানি বাংলার স্থাপত্যের ইতিহাসে এটি এ ধরনের সর্ববৃহৎ নিদর্শন। এটি ছিল মুসলিম শাসকদের কাছে লখনৌতি নামে পরিচিত গৌড়-দুর্গের প্রধান প্রবেশপথ এবং বাংলায় সর্বকালের সবচেয়ে সুদৃঢ় ও সুন্দর প্রবেশ-তোরণ।
 সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৩৫-১৪৫৯) গৌড়ের নগরদুর্গ নির্মাণকালে এটি নির্মাণ করেছিলেন বলে যে মত প্রকাশ করা হয়েছে তা সমর্থনযোগ্য নয়। পরবর্তী ইলিয়াস শাহী শাসকদের রাজধানী শহরের জামে মসজিদ গুণমন্ত মসজিদ এর প্রবেশ-তোরণই যখন দীর্ঘকাল স্থায়ী হওয়ার মতো করে নির্মাণ করা সম্ভব হয় নি, তখন দাখিল দরওয়াজার মতো সুদৃঢ় এবং সুষম একটি স্থাপত্য নিদর্শন নির্মাণের বিষয়টি প্রশ্নসাপেক্ষ। এমনকি নিকটবর্তী পান্ডুয়াতে, যেখানে দ্বিতীয় ইলিয়াসশাহী সুলতান এবং বাংলার স্বাধীন শাসকদের মধ্যে প্রথম সার্থক নির্মাতা সিকান্দর শাহ বাংলার বৃহত্তম জামে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন, সেখানেও আমরা এ ধরনের কোনো উদাহরণ পাই না। এ প্রবেশ-তোরণটির স্থাপত্যশৈলী অত্যন্ত পরিশীলিত এবং এরূপ পরিশীলিত ইমারত কেবল তখনই নির্মিত হতে পারে যখন স্থাপত্যশিল্প পরিপূর্ণতা অর্জন করে। এ কারণে দাখিল দরওয়াজা হোসেনশাহী আমলে নির্মিত বলে ধরে নেয়া যায়। পর্তুগিজ দোভাষি এন্টোরিও ডি ব্রিট্টো (১৫২১) দাখিল দরওয়াজার সামনের এক কোণে একটি মসজিদের অবস্থানের কথা বর্ণনা করেছেন। তাই এমনও হতে পারে যে, বড় সোনা মসজিদের নির্মাতা আলাউদ্দীন হোসেন শাহই এ প্রবেশ-তোরণ নির্মাণ করেছেন। দুটি স্থাপত্য নিদর্শনের রাজকীয় আবহ দেখেও এদেরকে একই সময়ের বলে মনে হয়। সম্ভবত নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ কর্তৃক দুর্গ নির্মাণকালে নির্মিত দুর্বল একটি তোরণের স্থলে পরবর্তীকালে এ মজবুত তোরণটি নির্মিত হয়েছিল। দুর্বল নির্মাণশৈলীর কারণেই দুর্গের ভেতরের একই ধরনের দুটি তোরণ চান্দ দরওয়াজা ও নিম দরওয়াজা ধ্বংস হয়ে গেছে।

ভেতরের প্রবেশপথে মাঝের ভারি স্তম্ভগুলি ছাড়া তোরণটি সম্পূর্ণ ইটনির্মিত। স্তম্ভের খিলানের উত্থানরেখা পর্যন্ত রয়েছে পাথরের আবরণ। ১০২.৫ মিটার দীর্ঘ এবং ২২.৫ মিটার প্রশস্ত এ তোরণের মাঝ বরাবর রয়েছে ৪.৫ মিটার প্রশস্ত একটি গলিপথ। এ গলিপথের দুধারে আছে দুটি প্রহরা-কক্ষ। এগুলির পরিমাপ দৈর্ঘে ২২.৭ মিটার এবং প্রস্থে ২.৯ মিটার। প্রতি দিকে চারটি করে ছোট প্রবেশপথ দিয়ে গলিপথ থেকে এ প্রহরা-কক্ষে প্রবেশ করা যায়। এছাড়া উভয় প্রহরা-কক্ষেই বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উল্টা দিকে রয়েছে আরও দুটি করে দরজা। আলেকজান্ডার কানিংহাম এর দেওয়া পরিমাপে এ তোরণের উচ্চতা ১৪.৯৫ মিটার। প্রবেশপথের খিলানটি ১০.৩৫ মিটার উচুঁ। প্রশস্ততর খিলান পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট খিলান-পথ হয়ে ‘ভল্ট’ আকারের গলিপথটিতে প্রবেশ করতে হয়। প্রবেশপথের প্রশস্ত খিলানটি ঈওয়ান-এর আকারে প্রক্ষিপ্ত। এর দুপাশে রয়েছে বিশাল আকৃতির ১২ ভুজবিশিষ্ট পার্শ্ববুরুজ যা এ ইমারতটির পুরো স্থাপত্যিক নকশার সঙ্গে চমৎকারভাবে মানানসই এক মহান শাসকের সম্মান ও মর্যাদার উপযোগী একটি প্রবেশপথের ধারণা সৃষ্টি করেছে। বড় সোনা মসজিদ ও ছোট সোনা মসজিদ এর প্রবেশ-তোরণগুলির সঙ্গে তুলনা করলে যুক্তিসঙ্গত কারণেই মনে হয় যে, এ তোরণটির কার্নিসও ছিল বক্রাকার।

তোরণটির অংলকরণে প্রাচুর্য নেই। সমকালীন অন্যান্য ইমারতের মতোই এখানে সম্পূর্ণ অলংকরণই পোড়ামাটির ফলক (টেরাকোটা) ভিত্তিক। ভিত্তি বরাবর রয়েছে ছাঁচে ঢালা অলংকরণের সারি আর পার্শ্ববুরুজগুলিকে ঘিরে রয়েছে নিচু জালি নকশা, যেগুলিকে বিভক্ত করা হয়েছে উল্লম্বভাবে বিন্যস্ত অপেক্ষাকৃত উঁচু অংশ (অফসেট), আর জানালার আকৃতির খিলানকৃত প্যানেল দিয়ে। এ প্যানেলের ভেতরে রয়েছে ঝুলন্ত নকশা আর খিলানের ‘স্প্যানড্রেল’-এ রয়েছে গোলাপ-নকশা। অভ্যন্তরের খিলানসমূহের ওপরে এবং দুদিকেরই বহিস্থ খিলানসমূহের দুপাশে ব্যবহূত এ খিলানাকৃতি জানালার নকশা সুলতানি বাংলার স্থাপত্যে ব্যবহূত বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকজ অলংকরণের চমৎকার নিদর্শন। দৃষ্টিনন্দন এ অলংকরণের বিকাশ ঘটেছিল পান্ডুয়া-ফিরুজাবাদের  আদিনা মসজিদএ। গৌড়-লখনৌতির ইমারতসমূহের মধ্যে দাখিল দরওয়াজাই সবচেয়ে জাঁকালো ও রাজোচিত ইমারত।

ভারতীয় উপমহাদেশে মধ্যযুগীয় অন্যতম বৃহৎ নগরী। আনুমানিক ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এটি বাংলার রাজধানী ছিল। নগরটি বর্তমান মালদা শহরের দক্ষিণে গঙ্গা ও মহানন্দা নদীর মধ্যবর্তী ভূখন্ডের পূর্বাংশে ২৪°৫২র্ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৮°১০´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩২.১৮ কিমি এবং প্রস্থে প্রায় ৬.৪৪ কিমি জুড়ে ছড়িয়ে আছে।

প্রাচীন নগরী লক্ষ্মণাবতী (পরবর্তী সময়ে ইসলামি নামকরণ হয় লখনৌতি) একই স্থানে অবস্থিত ছিল বলে অনুমান করা হয়। তবে আলেকজান্ডার কানিংহাম লক্ষ্মণাবতীকে গৌড়ের ধ্বংসাবশেষের উত্তর দিকে অবস্থিত বলে উল্লেখ করেছেন। স্থানিক সনাতন নাম এবং প্রচলিত লোককাহিনীতে বল্লাল সেনের সঙ্গে যুক্ত একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষের অস্তিত্বকে ভিত্তি করে তিনি এ মত প্রকাশ করেন। এটাও বলা হয়ে থাকে যে, লক্ষ্মণ সেন জীবনের শেষ দিনগুলি গঙ্গা নদীর তীরে কাটানোর জন্য তাঁর রাজধানী নদীয়াতে স্থানান্তর করেছিলেন। ধারণাটি গ্রহণ করা শক্ত এ কারণে যে, গঙ্গা লক্ষ্মণাবতীর পাশ দিয়েও প্রবাহিত ছিল। এম.এম চক্রবর্তী মনে করেন যে, প্রাচীন কোনো এক সময়ে গঙ্গা নদী মহানন্দার উপর দিয়ে প্রবাহিত ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি মহানন্দা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চিম দিকে সরে যায়। জৈমস রেনেল আঠারো শতকের শেষের দিকে গঙ্গা নদীর পশ্চিমমুখী প্রবাহের কথা লিপিবদ্ধ করেন। কারণ, তিনি গৌড়ের ধ্বংসাবশেষের প্রায় দশ মাইল পশ্চিম দিকে এটিকে প্রবহমান দেখেন। পুরানো খাতসমূহের অস্তিত্ব এধরনের গতি পরিবর্তনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। সেক্ষেত্রে বলা যায় যে, গঙ্গা-মহানন্দা প্রবাহের পশ্চিম পার্শ্বে লক্ষ্মণাবতী অবস্থিত ছিল। এর স্মৃতি সম্ভবত লোপো হোম্স (১৫১৯) এবং গ্যাস্টন্ডি’র (১৫৪৮) স্কেচে মূর্ত হয়ে রয়েছে। তাঁদের নকশায় নদীটির পশ্চিমে গৌড়ের অবস্থান দেখা যায়। গঙ্গা নদীর গতি পশ্চিমদিকে সরে যাওয়ায় রাজধানী বিলীন হয়ে যেতে পারে ভেবে সেন রাজা লক্ষ্মণাবতী পরিত্যাগ করেছিলেন বলে কেউ কেউ অনুমান করেন। দীর্ঘ এলাকা জুড়ে পুরনো খাতসমূহে পরিত্যক্ত বালুময় মাটি এখনও দেখা যায়। প্রাক-মুসলিম হাতিয়ারসমূহ, (বৌদ্ধ ও হিন্দু উভয়েরই) মধ্যযুগীয় দুর্গ গৌড়ের দক্ষিণে অবস্থিত উঁচু ভূমিতেই শুধু দেখা যায়।

সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের (প্রথম) শাসনামলে (১৪৩৬-১৪৫৯) ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ গৌড়ের প্রথম শিলালিপিটি দক্ষিণে কোতোয়ালী ফটক হতে নগরীর উত্তর দিকের রাস্তায় নির্মিত সেতুর উপর দেখা যায়। এ শিলালিপির বক্তব্যে পান্ডুয়া থেকে রাজধানী স্থানান্তরের তারিখ সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়। সুতরাং পনেরো শতকের প্রথমার্ধে সুলতান জালালউদ্দীনের আমলে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছিল বলে এ.বি.এম হাবিবুল্লাহ যে মত প্রকাশ করেছেন তা হয়ত কেউ ইচ্ছা করলে গ্রহণ নাও করতে পারেন। তাঁর শাসনামলে সফররত চীনা প্রতিনিধিগণ সে সময়ের বাংলার রাজধানী পান্ডুয়াতে যাওয়ার কথা সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন।

সুলতান সুলায়মান কররানী ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমে তান্ডায় রাজধানী স্থানান্তর করার পূর্ব পর্যন্ত গৌড় বাংলার রাজধানী ছিল। মুগল সেনাপতি মুনিম খান ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী পুনরায় গৌড়ে স্থাপন করেন এবং দুর্গের পূর্ব দিকে লুকোচুরি দরওয়াজা নির্মাণের ক্ষেত্রে সম্ভবত তিনি সক্রিয় ছিলেন। সতেরো শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সুবাহদার শাহ সুজা এটি নির্মাণ করেছিলেন বলে সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু শাহ সুজা কখনও গৌড়ে বাস করেন নি। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার কারণে গৌড় চূড়ান্তভাবে পরিত্যক্ত হয়।

১২০৫ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজী কর্তৃক নগরটি বিজয়ের পঁয়তাল্লিশ বছর পর মিনহাজ-ই-সিরাজ পুনঃনামকরণকৃত রাজধানী পরিদর্শন করেন এবং বখতিয়ার খলজী কর্তৃক নির্মিত মসজিদ ও মাদ্রাসা দেখতে পান। বর্তমানে এগুলির অস্তিত্ব নেই। ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে যেহেতু নগরটির রক্ষা-বাঁধ নির্মিত হয়েছিল সেহেতু নদী কর্তৃক এসব ভবন বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা নয়।

নকশার ভিত্তিতে বর্ণিত চৌদ্দ শতকের কোতোয়ালী ফটক ব্যতীত তেরো-চৌদ্দ শতকে নির্মিত স্থাপত্যশিল্পের অন্য কোনো নিদর্শন বর্তমানে আর নেই। বিশ শতকের প্রথম দিকে আবিদ আলী দূরভাষিনী ও ফুলওয়ারি ফটকের (বর্তমানে নেই) মধ্যবর্তী প্রকান্ড ‘সাগর দিঘি’র উত্তর-পশ্চিম এলাকাটিকে পুরনো লক্ষ্মণাবতীর বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গৌড় বন্দরের সঙ্গে শনাক্ত করেন। একটি খালের সাহায্যে এটিকে বন্দর উপযোগী করা হয়েছিল। প্রাক-মুসলিম স্থাপত্যিক নিদর্শনের অস্তিত্ব না থাকায় এধারণা অবাস্তব বলে মনে হয়। চৌদ্দ শতকের জিয়াউদ্দীন বরনী একটি দীর্ঘ বাজারের বর্ণনা দিয়েছেন যার উভয় পার্শ্বে ছিল দোকানের সারি। এ সারি প্রায় দুমাইলব্যাপী সেন রাজাদের পুরনো প্রাসাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ‘ফুলওয়ারি’ দুর্গ বর্তমান গৌড় দুর্গের ধ্বংসাবশেষের দুমাইল উত্তরে অবস্থিত যা কানিংহামের মতে একটি হিন্দু দুর্গ ছিল। এটি বরনীর মতে, বলবনের পুত্র কর্তৃক ব্যবহূত হতো। যাহোক, কিছু কালো কষ্টিপাথরের প্রস্তর খন্ড ছাড়া ওই স্থানে অন্য কোনো প্রাক-মুসলিম আমলের নিদর্শন পাওযা যায় নি। অন্যদিকে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী দুর্গটি শাহ সুজা কর্তৃক ব্যবহূত হয়। চক চকে ইট, কাদা-মাটির তৈরী পাইপের ভাঙ্গা অংশ, খোদিত চীনামাটির বাসনের টুকরা এবং অমসৃণ মৃৎপাত্রসমূহ দেওয়ালবেষ্টিত দুর্গের ভেতরে (সেখানে একটি পরিখা আছে) পাওয়া যায়। এর থেকে বোঝা যায় যে, দুর্গটি পনেরো ও ষোল শতকে ব্যবহূত হতো।

পনেরো শতকের শুরু থেকে গৌড় ও পান্ডুয়া জনবহুল নগরে পরিণত হয়। সম্ভবত জনসংখ্যার চাপে সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ রাজধানী গৌড় থেকে পান্ডুয়াতে স্থানান্তরিত করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। একই সময়ে সমুদ্র বন্দর হিসেবে সপ্তগ্রাম/সাতগাঁও-এর উত্থান আমরা লক্ষ করি যা স্পষ্টত চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিরাজমান নৈরাজ্যের কারণে ঘটেছিল। এরপর থেকে গৌড় নগরে অভিবাসন দ্রুতগতিতে চলতে থাকে। অন্যদিকে ভাগীরথীর তীরে অন্যান্য শহরগুলিও বিকশিত হচ্ছিল। এ শহরগুলি সপ্তগ্রাম এবং গৌড়ে বস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে, গৌড় নগরী দেওয়ালের পেছনে দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করছিল। সম্প্রতি এর ধ্বংসাবশেষ বাংলাদেশী একটি প্রত্নতাত্ত্বিক দল কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছে।

গৌড়ের সন্নিকটে বসবাসকারী নীলচাষী হেনরী ক্রেইটন ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে নগরের মোটামুটি একটি নকশা ও সৌধসমূহের চিত্রাঙ্কনসহ নগরের অঙ্গসংস্থানের একটি বিবরণ দেন। তিনি গঙ্গা ও মহানন্দার মধ্যবর্তী অঞ্চলে দৈর্ঘ্যে দশ মাইল ও প্রস্থে দেড় মাইলব্যাপী নগরের ধ্বংসাবশেষের বিস্তার দেখেন। কাস্তেনহাদা ডি লোপেজের বর্ণনায় দেখা যায় যে, মহানন্দা নদীটি পনেরো শতকের শেষার্ধে অগভীর খাড়িতে পরিণত হয়। আবুল ফজল এটিকে ‘চটিয়া পটিয়া’ নামকরণ করেন। নগরীতে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর নদীর সমান্তরাল দুটি বড় পাকা রাস্তা ছিল যা ছোট ছোট অাঁকাবাঁকা গলি ও খাল দ্বারা যুক্ত ছিল। এগুলির কয়েকটি এখনও বিদ্যমান আছে।

ক্রেইটনের বর্ণনা সংশোধন করেছেন জেমস  রেনেল, আলেকজান্ডার কানিংহাম এবং জে.এইচ র‌্যাভেনশ’। এরা ধ্বংসাবশেষের বিস্তার দৈর্ঘ্যে বিশ মাইল ও প্রস্থে চার মাইল দেখেছেন (পরবর্তীকালে আকাশ থেকে নেয়া জরিপ ও আবিষ্কারের দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে) এবং এভাবে দক্ষিণ দিকে সীমানা দেওয়ালের পেছনে নগর বিস্তার লাভ করে।

উত্তর দিকের প্রধান ফটকসহ দুর্গ ও প্রাসাদের নকশা তৈরি করা ছিল ক্রেইটনের বড় কৃতিত্ব। উত্তর দিকের ফটকটিকে দাখিল দরওয়াজা বলা হতো এবং এটি সম্ভবত পনেরো শতকের প্রথম দিকে নির্মিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ষোল শতকের প্রথম দিকে নুসরত শাহ পর্যন্ত বিভিন্ন শাসক পর্যায়ক্রমে এর পরিবর্ধন করেছেন। এ ফটক থেকে ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে নাম না জানা এক পর্তুগিজ দোভাষী সোজাসুজি নুসরত শাহের দরবার হলে চলে যান। এ সময় সুলতান নিচের সমভূমিতে পোলো খেলা দেখছিলেন। এ দোভাষী মূল্যবান একটি আত্মজীবনীও রেখে গেছেন।

ক্রেইটন ও ফ্রাংকলিনের লেখার ওপর ভিত্তি করে র‌্যাভেনশ’ প্রাসাদটিকে তিনটি অংশে বিভক্ত করেন। প্রাসাদটি একটি উচু দেওয়াল দ্বারা বেষ্টিত ছিল। এটিকে বাইশগজী দেওয়াল বলা হতো। প্রাসাদের তিন দিক একটি পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল এবং গঙ্গা নদীর সঙ্গে এটির সংযোগ ছিল। নদীটি দুর্গের পশ্চিম দিক রক্ষা করত। আমরা যদি সমসাময়িক বৈষ্ণব কবিকে বিশ্বাস করি তাহলে দেখা যায় যে, এখান থেকেই আলাউদ্দীন হোসেন শাহ নদীর অপর তীরে চৈতন্য-এর নেতৃত্বে মিছিলটি দেখেন।

এটি স্পষ্ট যে, উত্তর দিক থেকে প্রথম কামরাটি ছিল দরবার। পর্তুগিজ দোভাষী ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে এর বর্ণনা সুস্পষ্টভাবে দিয়েছেন। দাখিল দরওয়াজা থেকে মাঝপথে একটি ফটক ছিল। এর নিচ দিয়ে ঝর্ণার জন্য পানি সরবরাহের একটি খাল প্রবাহিত ছিল যা সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ-এর (১৪৬৬ খ্রি.) শিলালিপিতে উল্লিখিত আছে। যদি আমরা পর্তুগিজ দোভাষী ও খ্যাতনামা বাঙালি কবি কৃত্তিবাসের বিবরণ বিশ্বাস করি তাহলে দেখা যাবে যে, দাখিল দরওয়াজা থেকে দরবার পর্যন্ত রাস্তায় নয়টি সুরক্ষিত ফটক ছিল। এগুলির মধ্যে কমপক্ষে দুটি অদ্যাবধি চিহ্নিত করা যায়।

উত্তর দিক থেকে দ্বিতীয় কামরাটি সুলতানের বাসকক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হুমায়ুনের সহচর কর্তৃক প্রশংসিত এ কক্ষের বহুবর্ণের টালিখচিত মেঝে আমাদেরকে প্রাক-মুগল সুলতানদের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাত্রার কথা মনে করিয়ে দেয়। তৃতীয় কামরাটিকে হারেম সরা বা জেনানা মহল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে সফররত ফরাসি নাগরিক ভিনসেন্ট ল্য বঁলা জেনানা মহলের বিষয়টি সমর্থন করেছেন। তৃতীয় কামরা হতে উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু পাওয়া যায় নি। কিন্তু অন্য দুটি কামরায় আছে শোভন ও মূল্যবান অনেক নিদর্শন। এগুলির মধ্যে রয়েছে বহু বর্ণের ইট এবং চৈনিক লিপি উৎকীর্ণ চীনামাটির বাসনের টুকরাসমূহ যা সে যুগের বাংলায় প্রথম পাওয়া যায়। প্রথম কামরার উত্তর-পূর্বাংশে একটি ভবনের ধ্বংসাবশেষকে কোষাগার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু এ কথা দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করা যায় না।

দুর্গের পূর্ব দিকের দেওয়ালে রয়েছে দুটি ফটক। প্রথমটির নাম গোমতি ফটক যা আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলের বলে নির্ধারিত হয়েছে এবং পরেরটির নাম লুকোচুরি দরওয়াজা। এ ফটকটি সাধারণভাবে শাহ সুজার বলে বর্ণনা করা হলেও সম্ভবত এটি ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে দাউদ খান কররানীর বিরুদ্ধে বিজয়ের পর মুনিম খান নির্মাণ করেছিলেন। এ ফটকের উত্তর দিকে বেশ কিছু ইমারতের মধ্যে প্রথমটি বাংলা নমুনার একটি নিচু ইমারত। লোককাহিনী অনুযায়ী এটি দিলির খানের পুত্র ফতেহ খানের সমাধিসৌধ। ফতেহ খান শাহ সুজার পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে মুত্যুবরণ করেন বলে কথিত আছে। পরবর্তী ভবন কদম রসুলে রক্ষিত আছে মহানবী (স.)এর পদচিহ্ন। পূর্বে এ ইমারতটিকে একটি মসজিদ হিসেবে ধরা হয়েছিল। এ ইমারতটির সন্নিকটে রয়েছে চাতালসহ অনেক ধ্বংসাবশেষ। এটি হলো গৌড়ের সুলতানদের কবরস্থান। হেনরী ক্রেইটন কাল পাথরের তৈরী আলাউদ্দীন হোসেন শাহ এবং নুসরত শাহের সমাধিসৌধ দেখেছিলেন। পরবর্তীসময়ে এটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। বলা হয় যে, ইংরেজগণ পরে এগুলি সরিয়ে নিয়েছিল।

আরও উত্তর দিকে দুর্গের বাইরে রয়েছে একটি উচ্চ ইমারত (টাওয়ার)। সম্ভবত এটি ছিল একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। মালদহের বিপরীতে এ ধরনের আরও একটি টাওয়ার আছে। ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ দোভাষী দাখিল দরওয়াজার দিকের প্রবেশপথ মোটা লোহার শিকল টেনে সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ দেখতে পান। তিনি মোড়ের একটি বড় মসজিদের কথাও উল্লেখ করেছেন। এটি সুস্পষ্টভাবেই ছিল বড় সোনা মসজিদ। শিলালিপির সাক্ষ্যে মসজিদটি শনাক্ত করা হয়েছে। এ শিলালিপি অনুসারে মসজিদটি ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। পর্তুগিজ সূত্রে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, এটি ১৫২১ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে নির্মিত হয়। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ কোতোয়ালী দরওয়াজার পেছনে দক্ষিণ পার্শ্বে একই ধরনের একটি মসজিদ (ছোট সোনা মসজিদ) নির্মাণ করেন। নগরদুর্গের ভেতরে গোমতি ফটকের পশ্চিম দিকে সোজা পথে একটি ইমারত আছে। এটি সাধারণভাবে চিকা ইমারত নামে অভিহিত। এর ভূমিনকশা পান্ডুয়ার একলাখী সমাধিসৌধ-এর মতো হলেও এটি সমাধি ছিল না। কারণ এখানে কোনো কবরের সন্ধান পাওয়া যায় নি। এটি একটি মসজিদও ছিল না। এখানে ইমারতের ভেতরে উত্তোলিত হিন্দু দেবতার মূর্তিসমূহ লিন্টেলের উপরে ব্যবহার করা হয়েছিল। পর্তুগিজ বিবরণী পর্যালোচনা করলে এটিকে দীউয়ান-ই-মজালিম বলে মনে হয় যেখানে পর্তুগিজদেরকে গোয়েন্দা হিসেবে বিচার করা হতো। আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে সনাতন নামে জনৈক বন্দির পালিয়ে যাওয়ার পরে এটি আর কারাগার হিসেবে ব্যবহূত হয় নি। সনাতন প্রহরীদেরকে উৎকোচ প্রদান করে পলায়নের জন্য গঙ্গানদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল। এখান থেকে নদীতে সরাসরি প্রবেশের কোনো পথ ছিল না। নগরদুর্গ চত্বরে কালো কষ্টিপাথরের প্রস্তর খন্ডসমূহ ছড়িয়ে ছিল। দক্ষিণ দিকের ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে এগুলির কিছু এখনও দাঁড়িয়ে আছে যেগুলি অফিস ছিল বলে অনুমিত হয়। দৃঢ়ভাবে স্থাপিত বড় কষ্টিপাথরের প্রস্তর খন্ডগুলি এধারণা দেয় যে, এলাকাটি ছিল প্রাচীন লক্ষ্মণাবতীর অংশ।

স্থানীয় লোককাহিনী গৌড়ের বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে দুর্গের দক্ষিণাংশের উঁচু ভূমিকে শনাক্ত করে। এখানে বৌদ্ধ ও হিন্দু মূর্তি পাওয়া গেছে। ঐতিহ্যগতভাবে এটিকে ‘লাল বাজার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং এর একটি অংশকে ‘মহাজন টোলা’ বলা হয়। দুর্গ সংলগ্ন এবং এক বর্গমাইল এলাকায় প্রচুর পরিমাণে কড়ি ও অমসৃণ মৃৎপাত্রসমূহ পাওয়া যায়। ধ্বংসাবশেষসমূহ বেশ কিছু ‘মহল্লা’ নির্দেশ করে যেগুলির অস্তিত্ব প্রাক-ইসলামি যুগ থেকে ছিল। পর্তুগিজরা রাস্তাসমূহ সুপরিকল্পিত ও বিন্যস্ত অবস্থায় দেখেন। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য বড় শহরের ন্যায় এখানেও বিশেষ ধরনের দ্রব্যাদি যেমন, অস্ত্রাদি অথবা মিষ্টি বা খাদ্যদ্রব্য বিভিন্ন রাস্তায় বিক্রি করা হতো। পর্তুগিজরা লিসবনের সঙ্গে এ শহরের তুলনা করেন।

নগরটি ঘনবসতিপূর্ণ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ দোভাষী জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্বের কথা বলেছেন। জনাকীর্ণ রাস্তাসমূহে চলাফেরার অসুবিধা তিনি লক্ষ করেন। এ অবস্থায় অভিজাতবর্গ তাদের চলার পথ সহজ করে দেওয়ার জন্য বেশ কিছু লোক নিয়োগ করতেন। ফারিয়া ওয়াই সোসা এবং তার পরবর্তী অন্যান্যদের মতে, নগরে জনসংখ্যা ছিল বারো লক্ষ। কিন্তু সফররত ফরাসি নাগরিক গৌড়ে চল্লিশ হাজার পরিবার ছিল বলে মত প্রকাশ করেন। প্রতি পরিবারে পাঁচজন সদস্য ধরে হিসাব করলে মোট জনসংখ্যা দাঁড়ায় দুলক্ষ, যা সমসাময়িক ফতেহপুর সিক্রির জনসংখ্যা ২ লক্ষ চল্লিশ হাজারের কাছাকাছি। তবে ৮০ বর্গ মাইল আয়তনের গৌড়ে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গমাইলে দুহাজার জন। আগের তথ্যাবলির ওপর ভিত্তি করে ১৫৯৫-৯৬ খ্রিস্টাব্দে আবুল ফজল রাজস্ববিষয়ক যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে গৌড় অঞ্চলের প্রতি আকর্ষণ ও জনসংখ্যার ঘনত্বের কথা প্রকাশ পায়।

কাস্তেনহাদা ডি লোপেজ নগরীর ভবনসমূহের একটি বিবরণ দিয়েছেন। প্রাঙ্গণ ও বাগান সংলগ্ন ভবনসমূহ ছিল নিচু আকৃতির এবং সোনালি ও নীলাভ টালিসজ্জিত। প্রতিটি ঘরের মেঝে সৌন্দর্যবর্ধক টালি দ্বারা আবৃত ছিল। হুমায়ুনের সহচর ওয়াকিয়াত-ই-মুস্তাকীর লেখক উল্লেখ করেন যে, সম্রাট হুমায়ুন চীনা টালি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। টালিগুলি কক্ষের মেঝে ও দেওয়ালেও ব্যবহূত হয়েছিল। গৌড়ে দ্বি-তল ভবনের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না, যদিও পর্তুগিজ দোভাষী ‘দরবার’ হলের ভূ-গর্ভস্থ কক্ষের কথা বর্ণনা করেছেন।

দুর্গ এবং পূর্বদিকের বাঁধের মাঝামাঝিতে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত কাঠামো দেখা যায় যা কিংবদন্তির ব্যবসায়ী চাঁদ সওদাগরের বাড়ি বলে চিহ্নিত। এটি ‘বেলবারি মাদ্রাসা’ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে এবং এটি ছিল দেওয়াল বেষ্টিত নগরীর ভেতরে এ পর্যন্ত পাওয়া একমাত্র মাদ্রাসা। বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ দক্ষিণ দেওয়ালের পেছনে খননের মাধ্যমে ‘দরসবারি মাদ্রাসা’ বের করেছে। বেলবারি মাদ্রাসার পূর্ব দিকে ‘ছোট সাগর দিঘি’ নামে একটি বড় পুকুর রয়েছে। এটি নগরের বিভিন্ন এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অাঁকাবাঁকা খালের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। যে কেউ এখনও গঙ্গার দিকে দুটি খালের সমান্তরাল প্রবাহ দেখতে পাবেন। এগুলির একটি আবর্জনা বহন করত। ১৮৪৯-৫২ খ্রিস্টাব্দের জরিপ মানচিত্রে দেখা যায় যে, এ খালটি নওয়াবগঞ্জ-পান্ডুয়া সড়ককে দুবার বিচ্ছিন্ন করেছে যা সেতুর মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে। বেলবাড়ি মাদ্রাসার পাশ ঘেঁসে প্রবাহিত খালের উপর তিন-খিলানের সেতু অদ্যাবধি অক্ষত রয়েছে। নগর থেকে পূর্বাংশের ভূমি উঁচু হওয়ায় অগভীর জলাশয়ের পানি দুটি বাঁধের ছিদ্র দিয়ে নগরীতে পানি সরবরাহের জন্য প্রবাহিত হতো। ছোট সাগর দিঘি জলাধারের কাজ করত। চামকাঠি মসজিদের সামনে দিয়ে প্রধান খালটি প্রবাহিত ছিল। এক খিলান থেকে সাত খিলান বিশিষ্ট সেতুসমূহ দেখে বোঝা যায় যে, সেগুলির নিচ দিয়ে কি পরিমাণ পানি প্রবাহিত হতো। মাটির নিচ দিয়ে কাদা মাটির তৈরী পাইপের সাহায্যে ময়লা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা যে ছিল তা দেখা যায় বড় সোনা মসজিদ ও গঙ্গা নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় আবিষ্কৃত ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরবাড়িগুলির একটিতে। বেলবাড়ি মাদ্রাসা হতে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত খালের উভয় তীরের উঁচু ভূমি নির্দেশ করে যে, এ এলাকাটি ছিল উচ্চ শ্রেণির লোকদের বাসস্থান। কারণ এখানে চীনামাটির সুন্দর সুন্দর বাসন-কোসন পাওয়া গেছে। এ এলাকার সম্মুখভাগ খালের দিকে ক্রমাগতভাবে ঢালু হয়ে গেছে। ছোট সাগর দিঘি হতে পূর্বদিকে বাঁধ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় স্বল্পবিত্ত লোকদের বাস ছিল বলে মনে হয়। কারণ এখানে কোনো ধ্বংসাবশেষ বা নিদর্শন পাওয়া যায় নি।

পূর্বদিক থেকে দুর্গের কাছাকাছি এলে যে কেউ সন্নিকটবর্তী একটি মসজিদ দেখতে পাবেন। সবচেয়ে পুরানো চামকাটি মসজিদটি ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। এরপর রয়েছে লট্টন ও তাঁতিপাড়া মসজিদ দুটি। দুটি মসজিদই ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। মসজিদের নামগুলি নির্মাতা শ্রেণির সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ করছে। দুমাইল আয়তনের মধ্যে দুটি মসজিদ নির্মাণের সংক্ষিপ্ত সময় এখানে ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দের পর দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাক্ষ্য প্রদান করে। সুলতান রুকনউদ্দীন বারবক শাহের (১৪৫৯-৬০১৪৭৪) আমল থেকে নগরায়ন দ্রুতগতিতে চলতে থাকে এবং ষোল শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। পর্তুগিজ দোভাষী ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে অভিবাসীদের সমস্যাদি লক্ষ করেন। তিনি শীতের সকালে নগরীর রাস্তাসমূহে লোকদেরকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি কোনো বিশেষ উপলক্ষে সুলতান কর্তৃক নিরামিষ ও আমিষ খাদ্য বিতরণ করতেও দেখেন। এ থেকে গৌড়ে উভয় সম্প্রদায়ের বাস্ত্তহারা ও বেকার লোকদের উপস্থিতি বোঝা যায়।

নগরটি দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করেছিল। গুণমন্ত মসজিদটি সম্ভবত জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ (১৪৮১-১৪৮৭) কর্তৃক নির্মিত। এটির অবস্থান মাহদিপুর গ্রামের নিকটবর্তী নদীর (বর্তমানে এখানে শুধু একটি পুরনো খাল রয়েছে) তীরে নির্দেশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক দলের ব্যপক অনুসন্ধানের দ্বারা আরও কয়েকটি মসজিদ, সুফিদের স্মৃতিসৌধ, তাহখানার অস্তিত্ব পাওয়া যায় যেগুলি সম্ভবত শাহ সুজা নির্মাণ করেছিলেন। এর দ্বারা নগরটির ক্রমবিস্তার সম্পর্কে পর্তুগিজদের ভাষ্য নিশ্চিত করে। উত্তর দিকে বড় সোনা মসজিদের পেছনে কোনো নিদর্শনাদি পাওয়া যায়নি বিধায় নগরটির বিস্তার সম্ভবত দক্ষিণ দিকেই ঘটেছিল। আলাউদ্দীন হোসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯) আমলে ষোল শতকের শুরুতে নগরটির বিস্তার লাভের দ্বিতীয় পর্যায়টি শুরু হয়েছিল। সুলতান কর্তৃক ছোট মসজিদ নির্মাণ এধরনের বিকাশের সাক্ষ্য বহন করে।

দেওয়ালের বাইরে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক দল দুর্গের দক্ষিণ-পশ্চিমে নদীর তীরে জাহাজ ঘাটা শনাক্ত করে। তোমে পিরে গৌড়কে একটি বন্দরনগরী বলে অভিহিত করলেও এলাকাটিকে একটি অভ্যন্তরীণ বন্দরের অংশ মনে করা যায়। পর্তুগিজ একতলা জাহাজের মতো একটি নৌকাসহ এখানে পর্তুগিজ দোভাষী নানা আকারের ১৩০টি নৌকা নোঙ্গর করা অবস্থায় দেখেন।

অধিকাংশ পন্ডিত মনে করেন যে, পশ্চিম দিকে নদীর গতিপথ সরে যাওয়ায় গৌড় নগরীর পতন ঘটে। প্লেগ রোগে মুনিম খানের মৃত্যুর পর ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে গৌড় থেকে রাজধানী চূড়ান্তভাবে তান্ডায় স্থানান্তরিত হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ব্যবসায়ী জমিদার গৌড়ে যান। তখন পর্যন্ত এটি শৈল্পিক দ্রব্যাদি ও আনন্দময় নগর হিসেবে টিকে ছিল। ষোল শতকের শেষে এটি লিখিত হওয়ায় ধারণা করা যায় যে, রাজধানী স্থানান্তর হওয়ার পরও নগরটির অস্তিত্ব বজায় ছিল।

জেমস রেনেল দেখেন যে, আঠারো শতকের শেষে নদীটি গৌড়ের পশ্চিম দিকে প্রায় দশ মাইল সরে যায়। দুজন ইউরোপীয় পরিব্রাজক সৈবা’’বয়  ম্যানরিক (১৬৪৮) ও রবার্ট হেজেজ (১৬৮৭) নদী সরে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন নি এবং প্রাসাদের সামনে নৌকাসমূহের নোঙ্গরের কথা স্পষ্টভাবেই বর্ণনা করেছেন। এদের মধ্যে শেষোক্ত জন স্থানটিকে কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে বড় বলেছেন। এ ছাড়া এক দশক পর সুলায়মান কররানী অথবা মুগল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পশ্চিমে নদী যে দিকে সরে যাচ্ছিল সে দিকে তান্ডায় রাজধানী স্থানান্তর করার কোনো যুক্তিই ছিল না। ষোল শতকের শেষের দিকে রালফ ফিচ-এর বর্ণনা ধারণা দেয় যে, নদী পশ্চিম দিকে সরে যেতে শুরু করেছিল। সম্ভবত এ কারণে মানসিংহ নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তরিত করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা গৌড় নগরীর অবক্ষয়ের প্রধান কারণ ছিল বলে মনে হয়। যখন চট্টগ্রামকে নিয়ে আরাকান, ত্রিপুরা ও বাংলা এবং পরে পর্তুগিজ ভাগ্যান্বেষীদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়, তখন শেরশাহ কর্তৃক গৌড় বিজয় ও লুণ্ঠনের ফলে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভাগীরথী অঞ্চল বিশেষ করে এর উপরের অংশ স্থিতিহীন হয়ে পড়ে। গৌড়ে তিনমাস স্থায়ী আনন্দময় জীবনযাপন কালে হুমায়ুন এ নগরীকে জান্নাতাবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এসময়ে হোসেনশাহী বংশের বিলুপ্তি ঘটে। অতঃপর উড়িষ্যা থেকে আক্রমণ আসে এবং উড়িষ্যার শাসক সপ্তগ্রাম অবরোধ করে। যখন পর্তুগিজ ব্যবসায়ীগণ প্রথমে সপ্তগ্রামে ও পরে হুগলিতে বসতি স্থাপন করে, তখন তাদের দুঃসাহসী স্বদেশীয়রা উপকূলীয় অঞ্চলে লুঠপাট করছিল। এতে বাণিজ্যপথ বিঘ্নিত হয়। মুগল-পাঠানদের লড়াইয়ের অব্যবহিত পরে আসে চূড়ান্ত আক্রমণ। এতে কার্যত বাংলার উত্তরাংশ বিধ্বস্ত হয়ে যায়।

এধরনের অবিরাম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির ফলে জনবহুল শহরের রক্ষণাবেক্ষণ অবহেলিত হয়। অগভীর খাড়ি ও গঙ্গা নদীর সঙ্গে সংযোগস্থাপনকারী এবং নগরের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত খালসমূহকে যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন ছিল। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে ভিনসেন্ট ল্য বঁলা নগরীর অংশসমূহে জলাবদ্ধতা দেখেছেন। এতে বোঝা যায় যে, খালসমূহ যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় নি। এর ফলে প্লেগ রোগ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিদিন তিনশত লোকের মৃত্যু ঘটে। এ রোগে মুনিম খানও প্রাণ হারান। সম্ভবত মহানন্দা ও গঙ্গার সঙ্গে নগরীর খালসমূহের মাধ্যমে যে সংযোগ ছিল তা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। গঙ্গা নদীর গতিপথ পশ্চিমদিকে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কারণেও তা ঘটতে পারে।

ষোল শতকের শুরুতে পর্তুগিজদের দ্বারা মালাক্কা দখল হওয়ায় গৌড়-সপ্তগ্রাম এবং দক্ষিণ পূর্ব এলাকায় মুসলমান ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহণে সমস্যা সৃষ্টি হয়। এটা ধারণা করা যেতে পারে যে, ভাগীরথী এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে যে বাণিজ্যিক সংযোগ ছিল তা পর্তুগিজদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় বাংলা অঞ্চলে রৌপ্যের প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। যুগপৎ নৈরাজ্য এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে গৌড় নগরীর বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে বিলীন হতে থাকে। মুগল বিজয় এবং নদীর পূর্বতীরে তান্ডা থেকে রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ায় একটি নতুন তাৎপর্যময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যা গৌড় নগরীর পতনকে নিশ্চিত করে।

উনিশ শতকের শেষদিক হতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী লেখাসমূহ স্বাধীন বাংলার প্রতীক হিসেবে গৌড়ের উপর নিবদ্ধ ছিল। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রমাপ্রসাদ চন্দ, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রজনীকান্ত চক্রবর্তী, চারুচন্দ্র মিত্র এবং অন্যান্যরা প্রাক-মুগল রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন। এঁরা আঞ্চলিক ইতিহাসের অংশ হিসেবে নয় বরং বাংলার স্বাধীন সত্তার প্রতীক হিসেবে গৌড়ের উপর তাদের দৃষ্টি নিবন্ধ করেছিলেন। কিন্তু অল্প কয়েকজন ব্যতীত নগরের ধ্বংসাবশেষসমূহ এবং নগরটি ইতিহাসবিদদের দৃষ্টির বাইরেই ছিল। ফলে হুমায়ুনের ‘জান্নাতাবাদ’ একটি হারানো ও বিস্মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে।

 
(তথ্যসূত্র:
১- Henry Creighton, Ruins of Gaur, London, 1817.
২- JH Ravenshaw, Gaur, Its Ruins and Inscriptions, London, 1878.
৩- M Abid Ali Khan, Memoirs of Gaur and Pandua (ed & revised by H Stapleton), Calcutta, 1986 (reprint of 1924 ed).
৪- ‘Archaeological Reconnaissance at the City of Gaur: A Preliminary Report’ by Aniruddha Ray.
৫- উইকিপিডিয়া।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ