ধর্ম ও রাষ্ট্রের মিথোজীবিতা || যাদব কুমার পান্ডে

রাজশক্তি ধর্মকে বার বার ব্যবহার করেছে তার রাজনীতির স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য---ধর্মও নিজেকে বলি দিয়েছে রাজার কাছে। এই পলিটিকো রিলিজিয়াস সিমবাইয়োসিস কোন নতুন ঘটনা নয়,  ইতিহাসের অনুবর্তনে এই মিথোজীবিতার প্রকরণগত বৈচিত্র্য হয়তো পরিলক্ষিত হয়েছে কিন্তু ধর্ম ও রাজনীতির এই রাজযোটক এর ভিত্তিটা আবহমানকাল ধরে অটুট আছে।

ফ্র‍্যাংকদের রাজা শার্লামেনের রাজ্যাভিষেক আদি-মধ্যযুগীয় ইতিহাসের একটা বিশাল ঘটনা। ৮০০ সালের ২৫ ডিসেম্বর রোমান ক্যাথলিক এর প্রধান পোপ_তৃতীয়_লিও রাজমুকুট পরিয়ে দেন শার্লামেন এর মাথায় ------ঐশ্বরিক সত্তা আর রাজকীয় সত্তা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। তিনি পবিত্র_রোমান_সম্রাট (Holy Roman Emperor) ও ইউরোপের_জনক(Father of Europe)  উপাধিতে ভূষিত হন। এভাবেই চার্চ ও স্টেইট -------এক কমন_মিনিমাম_প্রোগ্রাম এ স্বাক্ষর করেছিল ইউরোপে আর সেটা ছিল সাধারন প্রজার উপর শাসন চালানোর মৌরুসিপাট্টা।  আর এ থেকে জনগনের দৃষ্টিও সুকৌশলে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন মনীষার বিস্তার ও পৃষ্ঠপোষকতার মাত্রাটিকে বাড়িয়ে দিয়ে যার নাম ক্যারোলঞ্জিয়ান_রেনেসাঁস।

সময়, স্থান ও প্রেক্ষিত বদলেছে, শুধু বদলায় নি "শাসক ও শাসিত" এর মাঝের পরিসরটুক-------যেখানে বিরাজ করে নিয়ত অসাম্য, অন্যায় ও শোষন  যা নাকি প্র‍্যাক্যটিক্যাল রিয়েল_পলিটিকদের এক মোক্ষম স্ট্র‍্যাটেজি নিজেদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার।

যীশুর ধর্মের প্রসার হত না যদি পোপ তৃতীয় লিও রোমান সম্রাট শার্লামেনের মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে তাকে সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত না করত। শার্লামেন তার রাজত্ব বিস্তারের জন্য খ্রিষ্টান ধর্মকে ব্যবহার করেছে আর পোপ চেয়েছে খ্রীষ্টান ধর্মের আবিশ্ব বিস্তার শার্লামেনের রাজদণ্ড দিয়ে। এটাকে বলে ধর্ম এবং রাষ্ট্রের মিথোজীবীতা বা সিমবাইয়োসিস অফ রিলিজিয়ন অ্যান্ড স্টেইট।
আর বৌদ্ধ ধর্ম হাইজ্যাক করে নিয়েছে সম্রাট অশোক। ধর্ম কখনো রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ছাড়া এবং রাষ্ট্র কখনো ধর্ম ছাড়া টিকে থাকেনি প্রাচীন ও মধ্যযুগে। তবে আধুনিক যুগে বিশেষ করে ফরাসি বিপ্লবের পর সেকুলারিজমের চর্চা এবং ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের বিশ্বব্যাপী তরঙ্গ রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে অনেকটাই আলাদা করেছে। যার প্রমান ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং কমিউনিস্ট রাষ্ট্র গুলি। লেনিন ১৯১৭ সালে অল রাশিয়ান ইউনিয়ন অফ টিচার্স ইন্টারন্যাশনালিস্ট গঠন করে যার মূল কাজ ছিল স্কুলের পাঠক্রম থেকে ধর্ম সংক্রান্ত পাঠ নিষিদ্ধ করা। ১৯১৮ সালে চার্চ ও স্টেটের পৃথকীকরণ নিয়ে ডিক্রি জারি করে যার আওতায় চার্চের কর্তৃত্ব একেবারে হ্রাস করা হয়েছিল।
স্তালিন জমানাতে চার্চের প্রতি মানুষের আনুগত্যহীনতা চরমে পৌঁছেছিল। প্রবীনদের চার্চে যাওয়া দেখে নবীন প্রজন্মের মানুষ উপহাস করত। অনেক চার্চ ভাঙা হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিন জমানায়।চীনা রাষ্ট্র ধর্মকে তোয়াক্কা করে না বলেই রোজা পালন  এবং দাড়ি রাখার উপর নিয়ন্ত্রণ করে সরকার।
২৪০ বছরের হিন্দু ধর্মের উপর ভিত্তিশীল নেপালে হিন্দুরাষ্ট্রের পতন হল।

বর্তমানে ভারতের বিজেপি নামক রাজনৈতিক দলটি আবার ধর্ম ও রাজনীতির ককটেল বানাতে চায়। বিজেপি তার সংবিধানে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে না, ধর্ম নিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে আর পাঁচটি রাজনৈতিক দলের মতোই। কিন্তু তারা হিন্দুত্ববাদী কিছু সংগঠনের আদর্শ দ্বারা চালিত। অর্থাৎ তারা তাদের সংবিধান কফিনবন্দি করে আর এস এস, ভি এইচ পি দের সংবিধানকে নিজের সংবিধান করে নিয়েছে অলিখিত ভাবে৷ আবার আর এস এস, ভি এইচ পি ইত্যাদি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মুখোশ পরে কার্যত একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। তারা বিজেপির জন্য ভোট জোগাড় করে দিচ্ছে এবং বিজেপিও তাদের দাবীকে রাজনৈতিক ইস্তাহারে জায়গা দিচ্ছে। এদের মিলিত মোডাস অপারেন্ডি হল হিন্দুত্ব প্রসার। ধর্মভীরু ও ধার্মিক মানুষের সহজ সরল বিশ্বাসকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে টিকে থাকতে চাইছে। এই বিভ্রান্তি দূর করা অত্যন্ত আবশ্যিক।
মানুষের নিত্যদিনের আবশ্যিক চাহিদার কথা এরা কখনো বলেছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে এই সংগঠন গুলির একটাও আন্দোলন আছে কি? স্বাধীনতা সংগ্রামে এরা নিস্ক্রিয় থাকলেও কিছু বলার ছিল না, কিন্তু সরাসরি ব্রিটিশ দের সাহায্য করেছে৷ গোলওয়ারকর তার উই_দ্য_নেশনহুড বইতে হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অযথা শক্তিক্ষয় না করে সেই শক্তি যেন কমিউনিস্ট এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে। ১৯২৫ সালে জন্মলাভ করলেও আর এস এস স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন তো করেই নি বরং পালটা ব্রিটিশদের হাত শক্ত করেছিল। কেউ একজন আর এস এস নেতার নাম করবেন যারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল?

হিন্দুরাষ্ট্র গঠন করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে ভারতের যুব সম্প্রদায়কে। কিন্তু হিন্দুরাষ্ট্র হলে দলিত, শ্রমজীবি, তথাকথিত শূদ্র ও নারীদের অবস্থান কি হবে তা কেউ ভেবে দেখছে কি?
হিন্দু কোন ধর্ম নয় ;---হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বলে স্বীকৃত হয় বেদ। আর সেই বেদেই হিন্দু শব্দটির উল্লেখ নেই। ভারতের প্রাচীন গ্রন্থ, শিলালিপি, স্তম্ভ ও মন্দিরগাত্রে হিন্দু বা সনাতন কথাটির উল্লেখ নেই কেন? অথচ ম্লেচ্ছ, আজীবক, শূদ্র শব্দগুলি আছে!  তাহলে কারা আদি?
তাই হিন্দু কোন ধর্ম নয়।  আসলে সমাজে ব্রাহ্মণবাদ, মনুবাদ, বর্ণাশ্রম ও পুরুষ আধিপত্যবাদ টিকিয়ে রাখার একটা রাজনীতিই করে গেছে হিন্দুরা। সংখ্যালঘুর  সংস্কৃতি সংখ্যাগুরুর উপর চাপিয়ে দেওয়ার হেজিমনিই হল হিন্দুত্ব। হিন্দুত্ব সমাজ বিভাজন করে, সমাজ ঐক্যের কথা শুনিয়ে। এইসব বিষয় জানাটা আজ খুব জরুরি।

ভারতে এইসব হিন্দু মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে একমাত্র কমিউনিস্টরাই। কিন্ত সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মধ্য শক্তিশালী সি পি আই (এম)  বুর্জোয়া শক্তির সাথে নির্বাচনি আঁতাত করে তাদের জনগনতান্ত্রিক বিপ্লবের নীতিকে দীর্ঘদিন ধরে পরিহার করে আসছে। এমনকি আজ এই চরম সংকটকালেও সি পি আই এম এর একটা বড় অংশ বিজেপির আদর্শ আর সি পি আই (এম) এর পতাকা নিয়ে ঘুরছে। তাদের মননে, চেতনায় ও বিবেকে বিজেপি আর রাজনীতিতে সি পি আই (এম)

যতদিন না বামদলগুলি একত্রিত হবে, যতদিন না বাম সমর্থকরা আচরনে ও চিন্তায় মার্ক্সবাদী হবে ততদিন এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার কেউ থাকবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

X

Never Miss an Update!

Join my newsletter to get the latest posts from littlemag.in directly to your inbox.