স্বর্গ-মর্ত্ত্য-পাতাল-নরক ।। কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তী


[ স্বর্গ-মর্ত্ত্য-পাতাল-নরক, দেবতা-ভগবান-ঈশ্বর, মর-মরণ-মরা-মার-মারণ-মারা-মৃত-অমৃত-অমর-অমর্ত্ত্য-অমরাবতী-মৃত্যু-যম-শব; ভূত-প্রেত-আত্মা-প্রেতাত্মা-পরমাত্মা-অধ্যাত্ব-’আত্মানাং-বিদ্ধি’ ইত্যাদি শব্দসমুহের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ একে এক পেশ করা হবে। প্রথমে ‘স্বর্গ’ দিয়ে শুরু হয়েছিল। আজ মর্ত্ত্য মর, মরণ, মরা, মড়া, মার, মারণ, মারা - এই শব্দগুলির অর্থ প্রকাশ করা হল। - সম্পাদক, বঙ্গযান। ]।

মর্ত্ত্য

মর্ত্ত্য=মৃ+ত (তন্‌) - কর্ত্তৃবাচ্যে। মর্ত্ত্য=মর্ত্‌ ( সীমায়িতের রক্ষণের তরণ ) তারিত যাহাতে; অর্থাৎ, যে বা যাহারা মরে। মর্ত্ত্য=মর্ত্ত থাকে যাহাতে। 'মর', মনুষ্য, পৃথিবী, মর্ত্তভব, পৃথিবীস্থ, মরণধর্ম্মবান, মনুষ্য, মনুষ্যলোক, পৃথিবী, শরীর। 

আধুনিক বাংলার পণ্ডিতদের কৃপায় শব্দটি এখন মর্ত হয়ে গেছে। এবং earth বোঝাতে শব্দটির ব্যবহার হয়ে থাকে।

যা কিছু মরণশীল, তাদের 'মর্ত্ত' বলে। সেই 'মর্ত্ত' বা মরণশীলগণ যে স্থানে বা লোকে থাকেন, তাকে 'মর্ত্ত্য' বা 'মর্ত্ত্যলোক' বলে। 'এই মর-জগৎ' বা 'মরণশীল এই বিশ্ব' বোঝাতে সেকেলে বাংলাভাষীরা 'মর্ত্ত্য' শব্দটি এখনও ব্যবহার করে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের গানে ও কবিতায় এই মর্ত্ত্য শব্দটির ব্যবহার যথেষ্ট মাত্রায় আছে, যথা -  'হয় যেন মর্ত্ত্যের বন্ধন ক্ষয় /  বিরাট বিস্ব বাহু মেলি লয় ...', কিংবা 'যখন রব না আমি 'মর্ত্ত্যকায়ায়' ... ইত্যাদি। মধ্যযুগের বাংলায় শব্দটির বিপুল ব্যবহার ছিল। 

মর [ মরণ, মরা - মড়া ]

'মর'=সীমায়িত করে রাখা হয় যাহাতে। 'মরণ'=মর অন (on) যাহাতে। মরা=মর-এর আধার যে। মড়া='ম'-এর বা সীমায়িতের গড়ান রহে যে আধারে। মর=মরণশীল, মর্ত্ত্য, মানব; প্রাণত্যাগ করা, মৃতবৎ বা নির্জ্জীব হওয়া, ব্যথিত হওয়া, কমিয়া যাওয়া …ইত্যাদি। মরণ=মৃত্যু, নাশ, বৎসনাভ বিষ। মরা=মৃত, শুষ্ক, নিপীড়িত…। মড়া=মৃতদেহ, গালি, সপ্রণয় গালি। মড়া=মৃতদেহ, গালি, সপ্রণয় গালি। 

‘মর’ শব্দের অর্থ হল ‘ম (বা সীমায়িত) রহে যাহাতে’। অর্থাৎ সত্তার সীমায়িত রূপটি তার ভিতরে রয়েছে। সেই কারণে মরা ক্রিয়াটির মানে হল ‘সত্তাকে সীমায়িত করে রাখা’। মানুষটা হিল্লী-দিল্লী দৌড়ে বেড়াচ্ছিল, তার মন ঘুঁটের আগুন জ্বালানোর বিদ্যা থেকে পরমানু চুল্লী জ্বালানোর বিদ্যা পর্য্যন্ত অনায়াসে ঘুরে বেড়াচ্ছিল - সেই মানুষটা সঙ্কুচিত হয়ে, সীমায়িত হয়ে ঢুকে রয়েছে সম্মুখের ঐ শবদেহে। এখন তার হিল্লী-দিল্লী যাওয়ার উপায় নেই, মনোলোকের কোন বিদ্যার এলাকাতেই এখন তার ঘুরে বেড়ানোর উপায় নেই।

'মরণ' তাই কার্য্যত দুটো ক্রিয়াকে বোঝায় - ‘সত্তার সীয়ায়িত করণ’ ও ‘সীমায়িত করে রাখন’। বাংলাভাষী মায়েরা যখন বলেন, ‘ওরে নমিতা, দুধটা এখনও উনুন থেকে নামাসনি। যাঃ দুধ তো এতক্ষণে মরে মরে ক্ষীর হয়ে গেল’। তখন আমরা অনায়াসে বুঝতে পারি, দুধ গরম হয়ে ফুটতে ফুটতে সঙ্কুচিত হতে হতে, সীমায়িত হতে হতে বা মরতে মরতে ক্ষীর হয়ে যায়। এই মরা অতএব সঙ্কুচিত হওয়া, সীমায়িত হওয়া, 'ম'-এ পৌঁছোনো। স্বভাবতই এই মরা শব্দ দিয়ে বাংলাভাষী অজস্র শব্দ বানিয়েছেন। যথা মরা-কটাল, মরা-কান্না, মরা-গাঙ, মরা-চামড়া, মরা-জরা, মরা-টাকা, মরা-দুধ, মরা-ধারা, মরা-পথ, মরা-পেট, মরা-বান, মরা-মাটি, মরা-মানুষ, মরা-মাস, মরা-সোনা …ইত্যাদি। এই সকল সত্তাগুলিই সঙ্কুচিত, সীমায়িত, মরা। পার্থক্য এই যে বাস্তবের মরা-গাঙে বান আসে; এলেই সেই গাঙ্‌ পুনরায় জীবিত গাঙের মত আচরণ করে থাকে। কিন্তু জীবের বেলায় তার মরা-দেহে প্রাণ আসে কদাচিৎ। মরা-জীব তার তদ্রূপ সীমায়িত রূপ থেকে আরও সীমায়িত হতে হতে একদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়। 

তবে কিনা মধ্যযুগে পৌঁছে বাংলাভাষী তাঁর পূর্ব্বসূরীদের বানানো ‘মরা’-কে আস্ত রাখেননি, বানিয়ে দিয়েছেন ‘মড়া’। কারণ মরাটা তো নড়াচড়া করতে পারে না, মাটিতে গড়িয়ে পড়ে থাকে। যে সীমায়িত সত্তা বা ‘ম’ ভূঁইয়ে গড়ায় তাকে তো ‘মড়া’ বলাই ঠিক। কেবল তাই নয়, বঙ্গে স্বভাবগুণে বাংলাভাষী মেয়েরা তাঁদের জীবনে কথাবার্ত্তায় এই মরণ ও মড়া প্রভৃতি না-সূচক শব্দকে হাঁ-এর সমতুল্য করে এমনভাবে প্রয়োগ করে থাকেন যে, আপনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারবেন না, ‘মরণ’ বা ‘মড়া’ শব্দ প্রয়োগ করে তাঁরা আসলে জীবন ও প্রাণবন্ত বোঝাতে চাইছেন কি না! যেমন, চল্লিশোর্দ্ধ প্রেমিকের আদরে ‘বাঁদর’ হয়ে তার প্রেমিকা বলতেই পারেন - ‘ওরে আমার ঘাটের মড়া রে! …আ মরণ! ছাড়্‌ ছাড়্‌!’ কোন বাংলাভাষী যে এই প্রযুক্ত ‘মড়া’ ও ‘মরণ’ শব্দটি শুনে তার অর্থ যথাক্রমে dead-body বা death বুঝবেন না, সেকথা অনায়াসে বলে দেওয়া যায়। ল্যাটিন mori ক্রিয়ামূল (=মরে যাওয়া), তথা ল্যাটিন সূত্রে পাওয়া ইংরেজী শব্দ mortal (মরণশীল), immortal প্রভৃতি।
  

মার [ মারণ, মারা ]

মার

মার=মর ( সীমায়িত করে রাখা হয় যাহাতে ) হইতে জাত। বিরহীকে মারে যে ( ‘বিরহীমারক’ )। মারক, বিনাশক, ঘাতক, মারণ, তাড়ন, কাম, মৃত্যু …ইত্যাদি; প্রহার, আঘাত, বিনাশ শাসন …ইত্যাদি; বিনাশ করা, বধ করা, প্রহার করা, লক্ষ্যে আঘাতার্থে নিক্ষেপ করা …ইত্যাদি। 

মারণ=মার অন (on ) থাকে যাহাতে। যাহার দ্বারা বিনাশ সাধিত হয়। হনন, বধ, ভস্মীকরণ, অভিচার কর্ম্মবিশেষ, বিষবিশেষ, প্রহার...। [ দ্রষ্টব্য - কাছ, কাছা, গাঁটকাটা, গাঁটছড়া, চুরমার ]। 

যতক্ষণ ‘মর; শব্দে আমরা ছিলাম, সীমায়িতকরণ ক্রিয়াটি সত্তা নিজে করছিল নিজের উপর …দুধ মরে বা নিজের মধ্যে সীমায়িত হয়ে যাচ্ছিল, নদী নিজের মধ্যে নিজে সীমায়িত হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছিল বা মরে যাচ্ছিল …ইত্যাদি। এখন যখন সেই মর হইতে জাত মার ক্রিয়ায় এলাম, দেখা যাচ্ছে সত্তা নিজে নিজের ভিতরে আত্মসঙ্কোচন করছে না, নিজেকে নিজে সীমায়িত করছে না, সে অন্যকে সঙুকুচিত হতে বাধ্য করছে, সীমায়িত হতে বাধ্য করছে।

তার মানে, মার শব্দের অর্থ হল অন্যকে তার নিজের কেন্দ্রে ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়া লাগানো; তাকে তার কেন্দ্রে সীমায়িত হতে বাধ্য করা। অর্থাৎ মার ক্রিয়াটি করা বা মারা মানে ‘পেটাই করা’ নয়, মারা মানে অন্য কোন সত্তাকে তার কেন্দ্রে সঙুকচিত হওয়ার জন্য যা কিছু করা দরকার হয়, তার সবকিছু করাই মারা; তা সে ‘পেটাই করা’ হতে পারে …এবং এ’রকম অনেক কিছুই হতে পারে। যে কারণে ‘ঢিল মারা’, ‘তীর মারা’, ‘বাণ মারা’, ‘কামানের গোলা মারা’, ‘বোমা মারা’ …প্রভৃতি ক্রিয়াগুলি সবই অন্যকে তার আবাসকেন্দ্রে ফিরে যেতে বাধ্য করে; তা সে তার রাজধানী হোক, তার আবাসস্থল হোক, তার শয়নকক্ষ হোক, কিংবা তার দেহের ভিতরেই হোক। মনপ্রাণ দেহের ভিতরে যায় তখনই যখন প্রচণ্ড মার-এর ফলে দেহে এত ক্ষত হয় এবং তার এত যন্ত্রণা হয় যে, তার মনের ফাঁকগুলি দুঃখবোধে ভরে যায়। অন্য কথা শুনবার বুঝবার অবকাশ থাকে না তার। তার পর আরও সীমায়িত হয়ে সে মরে যায়, মড়া হয়ে যায়, এবং ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যায়। 

ইংরেজী-শিক্ষিত কোন কোন বুদ্ধিমান আমাদের বলেন -- তোমাদের ভাষার এ কী পাগলামি? তোমরা ‘ভাত খাও’, ‘ডাল খাও’, এমনকি ‘জল খাও’, ‘বিড়ি-ও খাও’। আমাদের দেখ কত স্পষ্ট - আমরা ভাত-ডাল eat করি, জল drink করি, সিগারেট smoke করি। তাকে তখন বলা দরকার যে, আমাদের গালিভার-শব্দের সঙ্গে তোমাদের লিলিপুট-শব্দের তুলনা করা উচিত নয়। আমরা বাংলাভাষীরা কেবল জলই খাই না, আরও অজস্র জিনিস খাই। আমাদের খাদ্য তালিকা দেখলে তোমরা লিলিপুট- শব্দবিলাসীরা ‘ভিরমী খাবে’। এমনকি আমরা মারও খাই। যতরকম মার আছে, তার সবই আমরা দিই এবং খাই - বকুনি, গালি, কানমলা, কিল, চড়, লাথি, ঘুষি, জুতো, গুঁতো, বেত, বাড়ি, তাড়া, চাবুক …এসবই মার-এর রকমফের এবং এই সব মারই আমরা দিই এবং খাই। আর, মার খেলেই খাদক আত্মকেন্দ্রে সীমায়িত হয়।

কিন্তু এখানেই গালিভার-শব্দবিলাসী বাংলাভাষী স্বভাবতই দাঁড়িয়ে থাকেননি। ‘হ্যাঁ-না’এর যৌথ-কারবারী এই বঙ্গভাষীগণ 'মারা'কে এত বিচিত্রভাবে সর্ব্বলোকে প্রয়োগ করে থাকেন যে তার তল খুঁজে পাওয়া যায় না। দৃশ্য ‘মার’ যত রকমের আছে, হাতে-মারা, প্রাণে-মারা, কিল মারা, চড়-মারা, লাথি-মারা, ঘুষি=মারা, জুতো-মারা, গুঁতো-মারা, কোদাল-মারা, চাকু-মারা, ঢিল-মারা, তীর-মারা, বাণ-মারা …ইত্যাদি পেরিয়ে পরমাণুবোমা -মারা পর্য্যন্ত সর্ব্বপ্রকারের দৃশ্য - তারা তো আছেই, তার চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণে আছে অদৃশ্য মার মারা। যথা - ভাতে-মারা, পাতে-মারা, পকেট-মারা, টাকা-মারা, বুকনি-মারা, বক্তৃতা-মারা, ডুব-মারা, তেল-মারা, গেঁড়া-মারা, চালাকি-মারা, পেঁচ-মারা, রোয়াব-মারা, গরম-মারা, জাত-মারা, পোঁদ-মারা, গুদ-মারা, সুদ-মারা …ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মধ্যে দৃশ্য মারাকে দেখিয়ে অদৃশ্য মারাকে বোঝানোর কারবার তো আছেই। 

তার মধ্যে আবার এমন অনেক মারা আছে, তাতে যে মার খায়, সে আদৌ সঙ্কুচিত বা সীমায়িত হয় বলে মনেই হয় না, বরং প্রসারিত হতে চায়। যেমন - আড্ডা-মারা, ইয়ার্কী-মারা, দম-মারা, মটকা-মারা, কাছা-মারা,মালকোঁচা-মারা, দৌড়-মারা, ছুট-মারা, উঁকি-মারা, কাঁকন-মারা, গুঁড়ি-মারা, চুপ-মারা, মেদা-মারা, চোখ-মারা, ধুলা-মারা [ ‘এমনি সব গাধা, ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা’, [ -’জুতা আবিষ্কার’/রবীন্দ্রনাথ ], চুলে কলপ-মারা, মুখে পাউডার-মারা…ইত্যাদি ইত্যাদি। একটি শব্দের এ’রকম অজস্র প্রায়োগিক রূপ থাকলে, ভাষায় অজস্র শব্দ থাকার কী দরকার। লিলিপুট লাখ লাখ হলেই ভাল, কিন্তু গালিভার হাজার দুয়েক হলেই তো কোটি কোটি লিলিপুটের সমান হয়েও অনেক বেশী হয়ে যাবে। যাঁরা বাংলাভাষায় শব্দসংখ্যা কম বলে দুঃখবোধ করেন, কথাটি যত শীঘ্র তাঁদের মাথায় ঢোকে ততই মঙ্গল। অবশ্য প্রয়োগকৌশল ভুলে গিয়ে থাকলে আলাদা কথা। গ্রামবাংলা কিন্তু বাংলাশব্দের ঐরকম প্রয়োগকৌশল মোটেই ভোলেনি।… 

স্বভাবত ‘মার’ শব্দ থেকে বাংলাভাষী অজস্র শব্দ সৃজন করে নিয়েছেন। আরও মার-যুক্ত অজস্র শব্দ আছে।

কৃতজ্ঞতা: নারায়ণ চন্দ্র দাস...!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ