বিজ্ঞানের বিশ্বাস এবং ...।। অনাবিল সেনগুপ্ত


"বিজ্ঞান বনাম বিশ্বাস" শিরোনামটির মধ্যেই সুচতুর একটি কৌশল কাজ করে। বিজ্ঞান আর বিশ্বাসের মধ্যে ধন্ধ তৈরি করার কৌশল। যেনতেন প্রকারে ঈশ্বর বিশ্বাসীরা এটাই দাবী করে আসেন ‘বিশ্বাস’-এর উপর একচেটিয়া শুধু তাদেরই অধিকার এবং যুক্তিবাদীরা সব ‘অবিশ্বাসী’।

প্রথমেই বলি ‘বিশ্বাস’ ( Type of Emotion) একটি ‘অনুভূতি’ বা ‘Feeling’ এবং এই অনুভূতি মানুষের মস্তিষ্কের বিশেষ ক্রিয়াকলাপ জনিত ফলাফল। আর এই ‘অনুভূতি’ কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তা বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারার  মাধ্যমে  ব্যাখ্যা করা যায়। তাই যুক্তিবাদীরা মানুষ হওয়ার কারণে তাঁদের মধ্যেও ‘বিশ্বাস’ নামক ‘অনুভূতি’ বিদ্যমান।
এরপরে আসা যাক যুক্তিবাদীদের "বিশ্বাস" প্রসঙ্গে। ইহা কেমন এবং কি প্রকার? আমরা যুক্তিবাদীরা সর্বদাই যুক্তি তথা বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। যুক্তিবাদীরা ‘বিশ্বাস’ করেন পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনাদির পেছোনে নির্দিষ্ট যুক্তি বা বিজ্ঞান আছে এবং  যুক্তিবাদীরা এটাও ‘বিশ্বাস’ করেন কোনও ঘটনার পেছোনে বর্তমানের যুক্তি বা বিজ্ঞান ভবিষ্যৎকালে বদলাতে পারে,তখন সেই যুক্তি বা বিজ্ঞান গ্রহণ বা বর্জন করে চলে বা করে চলেছে। যুক্তিবাদীরা বিশ্বাসী এবং তাদের বিশ্বাস বিজ্ঞানের প্রতি, যুক্তির প্রতি। "সর্বকালের সেরা গুজব ঈশ্বরের(?)"প্রতি নয়। তাই "বিজ্ঞান বনাম ঈশ্বর" সুচতুর কৌশলে হয়ে যায় "বিজ্ঞান বনাম বিশ্বাস"।

আর ঈশ্বর বিশ্বাসীদের ‘বিশ্বাস’ এই পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনার পিছনে রয়েছে 'ঈশ্বর'(?) নামক এক নিয়ন্ত্রক শক্তির হাত! তারা তাদের এই  তাঁদের এই বিশ্বাসে অনড় বা স্থবির। তদের এই বিশ্বাস তাঁরা সমাজের জোরপূর্বক আরোপ করে চলেন! এই বিশ্বাসীদের ‘বিশ্বাস’ থেকে জন্ম নেয় ‘দ্বিচারিতা’ বা বলা ভাল ‘বহুচারিতা’ । এঁদের "বিশ্বাস" আর "কাঁঠালেরআমসত্ত্ব" এর মত এদের জীবনযাপন!  এরাই সেই ঈশ্বর(?)বিশ্বাসের উপর নির্ভর না থেকে,এই পৃথিবীর যাবতীয় বিজ্ঞান বা যুক্তি নির্ভর প্রযুক্তির ফল চেটেপুটে সাবার করে বা করে চলেছে। এঁদের মধ্যে অনেকেই পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ আহরণ করে এই ‘ঈশ্বর’-কে ঢাল করে।

ঈশ্বর বিশ্বাসীদের এই বহুচারিতা থেকেই জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন ধর্ম যেমন হিন্দু, ইসলাম, ক্রিশ্চিয়ান, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় বিশ্বাসের আকার নিয়েছে! যদিও আদিম মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগকে শয়তান রূপে তুষ্ট করা শুরু করে,তার থেকেই 'নিয়ন্ত্রক ঈশ্বরের'(?) জন্ম হয়! এই শয়তান থেকে ঈশ্বরের উত্তরণের ইতিহাস আজ  বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগের দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে । যে "অনুভূতি" মানুষের বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে, সেই "অনুভূতি" মানুষকে "আগাম বিপদ সংকেত" দেয় বা "সর্তকতা" বা "ভয়" নামক "অনুভূতির" জন্ম দেয় । কয়েক কোটি বছরের মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম (বিভিন্ন ধর্মীয় ঈশ্বর বিশ্বাসীদের )গুলির সামাজিক অবদান শুধুই "আদিম ভয়" তৈরিতে ক্ষান্ত ! এই "আদিম ভয়ের" বিশ্বাস আজ  দূরীভূত হয় বিজ্ঞান বা যুক্তি নির্ভর বিশ্বাসের চর্চার মাধ্যমে।বিজ্ঞান আজ  প্রমাণ করে দিয়েছে কিভাবে "আর্থসামাজিক পরিবেশ" মানুষের "চিন্তা চেতনা" তথা "বিশ্বাসকে" নিয়ন্ত্রণ বা পরিবর্তন করে ।
এখন দেখা যাক এই বিজ্ঞান কী? আপনার কাছে বিজ্ঞানের যথাযথ ব্যাখ্যা নাও থাকতে পারে আবার এমনও হতে পারে আপনাকে জানতে দেওয়া হয়নি।
বিজ্ঞান (ইংরেজি ভাষায়: Science) হচ্ছে বিশ্বের যাবতীয় ভৌত বিষয়াবলী পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, যাচাই, নিয়মসিদ্ধ, বিধিবদ্ধ ও গবেষণালদ্ধ পদ্ধতি যা জ্ঞানকে তৈরিপূর্বক সুসংগঠিত করার কেন্দ্রস্থল। ল্যাটিন শব্দ সায়েনটিয়া থেকে ইংরেজি সায়েন্স শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শব্দটির অর্থ বিশেষ জ্ঞান। ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফলে কোনও বিষয়ে প্রাপ্ত ব্যাপক ও বিশেষ জ্ঞানের সাথে জড়িত ব্যক্তি বিজ্ঞানী,বিজ্ঞানবিদ কিংবা বৈজ্ঞানিক নামে পরিচিত হয়ে থাকেন।
বিজ্ঞানীরা বিশেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে জ্ঞান অর্জন করেন এবং প্রকৃতি ও সমাজের নানা মৌলিক বিধি ও সাধারণ সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। বর্তমান বিশ্ব এবং এর প্রগতি নিয়ন্ত্রিত হয় বিজ্ঞানের মাধ্যমে। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যাপক অর্থে যে কোনও জ্ঞানের পদ্ধতিগত বিশ্লেষণকে বিজ্ঞান বলা হলেও এখানে এটি সূক্ষ্ম অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হবে।
বিজ্ঞানের ক্ষেত্র মূলত দুটি: সামাজিক বিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান। জীববিজ্ঞান,পদার্থবিজ্ঞান,রসায়ন-সহ এ ধরনের সকল বিজ্ঞান প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে মানুষের আচার-ব্যবহার এবং সমাজ নিয়ে যে বিজ্ঞান তা সমাজ বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। তবে যে ধরনেরই হোক বিজ্ঞানের আওতায় পড়তে হলে উক্ত জ্ঞানটিকে সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণিত হতে হবে। আর একই শর্তের অধীনে যে গবেষকই পরীক্ষণটি করুন না কেন ফলাফল একই হতে হবে। অর্থাৎ ব্যক্তি চেতনা অনুযায়ী বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষণের ফলাফল কখনও পরিবর্তিত হতে পারে না।
গণিতকে অনেকেই তৃতীয় একটি শ্রেণী হিসেবে দেখেন। অর্থাৎ তাদের মতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান,সামাজিক বিজ্ঞান আর গণিত এই তিনটি শ্রেণী মিলে বিজ্ঞান। ঐ দৃষ্টিকোণে গণিত হল আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞান, আর প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞান হল পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞান। প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের সাথে গণিতের মিল-অমিল উভয়ই রয়েছে। গণিত একদিক থেকে পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে,উভয়ই একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পদ্ধতিগত অধ্যয়ন করে। আর পার্থক্য হচ্ছে,পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানে পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করা হলেও গণিতে কোনও কিছু প্রতিপাদন করা হয় আগের একটি সূত্রের (Primarily) উপর নির্ভর করে। এই আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞান,যার মধ্যে পরিসংখ্যান এবং যুক্তিবিদ্যাও পড়ে,অনেক সময়ই পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানে উন্নতি করতে হলে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞানের প্রসার আবশ্যক। কিভাবে কোনও কিছু কাজ করে (প্রাকৃতিক বিজ্ঞান) বা কিভাবে মানুষ চিন্তা করে (সামাজিক বিজ্ঞান) তা বুঝতে হলে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞানের কাছে হাত পাতা ছাড়া উপায় নেই।"  (সূত্র: উইকিপিডিয়া)

উক্ত ‘বিজ্ঞানের’ গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাথমিক ধাপ হল "অনুকল্প (hypothesis)"।  এই ধাপটি ‘বিজ্ঞানের’ ‘বিশ্বাস’ বলা যেতে পারে। এখন দেখা যাক কিভাবে এই "অনুকল্প (hypothesis)" বা ‘বিশ্বাস’ "বিজ্ঞানে’ পরিণত হয় এবং ‘বিজ্ঞান’ বা ‘যুক্তি’ থেকে বর্জিত হয়।

"A hypothesis (plural hypotheses) is a proposed explanation for a phenomenon. For a hypothesis to be a scientific hypothesis, the scientific method requires that one can test it. Scientists generally base scientific hypotheses on previous observations that cannot satisfactorily be explained with the available scientific theories. Even though the words "hypothesis" and "theory" are often used synonymously, a scientific hypothesis is not the same as a scientific theory. A working hypothesis is a provisionally accepted hypothesis proposed for further research." -- Wikipedia

দেখে নেওয়া যাক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কীভাবে তৈরি হয় ?
সাধারণত প্রাকৃতিক কোনও ঘটনার বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা,বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাহায্যে। একটি প্রাকৃতিক ঘটনা কেন ও কিভাবে ঘটছে তার বিজ্ঞানসম্মত কারণ খুঁজতে চান বিজ্ঞানীরা। এই ঘটনা সম্পর্কে বহুদিন ধরে পর্যবেক্ষণ,পর্যালোচনা ও গবেষণা করে তথ্য,উপাদান সংগ্রহ করা হয়। তারপর বিভিন্ন তথ্য ও পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে একটি সাময়িক বা অস্থায়ী অনুকল্প (hypothesis) প্রস্তুত করা হয় যা ব্যাখ্যা করতে পারবে ঘটনাটিকে। একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কখনোই কোন বিজ্ঞানীর মনগড়া কথা নয়। বহু তথ্য ও পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করেই গঠিত হয় প্রত্যেকটি তত্ত্ব।

অনুকল্প তৈরি হয়ে যাবার পর রয়েছে তার সত্যায়ন। বহু তথ্যের সমন্বয়ে একটি অনুকল্প তৈরি করা হলেই এটিকে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের মর্যাদা দেয়া হয় না। একটি তত্ত্বকে বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে তাকে প্রাথমিকভাবে কমপক্ষে তিনটি শর্তের ভিত্তিতে তার যোগ্যতা যাচাই করতে হয়।

১. তত্ত্বের মূল নিয়মগুলো অবাধ (arbitrary),সরল ও কম পরিমাণে আনুষাঙ্গিক বিষয়ের উপর নির্ভরশীল হতে হবে।
২. তত্ত্বের সাহায্যে পর্যবেক্ষণকৃত ঘটনার বিশাল একটি অংশকে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে।
৩. তত্ত্বের সাহায্যে বহুবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্ত ভবিষ্যৎবাণী করা যাবে যা হুবহু মিলে যাবে।
এই তিনটি শর্ত পূরণ করার পরই একটি অনুকল্প মর্যাদা পেতে পারে একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্বের। আর এই তিনটি শর্ত পূরণের জন্য অনেক অনেকবার ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করা হয়-ব্যাখ্যা করা হয়, তত্ত্বের সাহায্যে ভবিষ্যৎবাণী করা হয় অনেক ঘটনার এবং ঘটে যাবার পর মেলানো হয় ভবিষ্যৎবাণীর সাথে। এরকম বার বার পরীক্ষার পর পরীক্ষা দিয়েই টিকে থাকে এক একটি তত্ত্ব, যে পরীক্ষাগুলো করাই হয়ে থাকে তত্ত্বটিকে ভুল প্রমাণিত করার জন্য।

হাইপোথিসিস থেকে তত্ত্বে পরিণত হবার ৪টি ধাপ। একটি হাইপোথিসিস তৈরি হবার পর তাকে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব এবং বৈজ্ঞানিক সূত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশের জন্য বেশ কয়েকটি ধাপে বারবার পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়।

১. প্রথমেই তাকে বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে আঘাত করা হয়। সেই আঘাতে ভেঙ্গে না পড়লে সেটি নির্বাচিত হয় পরবর্তী ধাপের পরীক্ষার জন্য।
২. হাইপোথিসিস থেকে প্রাপ্ত ভবিষ্যদ্বাণী যাচাই করার জন্য কৃত্রিম পরিবেশ তৈরী করা হয় বা প্রাকৃতিক পরিবেশের ঘটনা থেকে তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়।
৩. সেটার সাথে অনুকল্প থেকে প্রাপ্ত পূর্বনির্ধারিত ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে দেখা হয় তা সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা। যদি সেটা সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় যদি বৈপরীত্য অথবা বড় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় তবে পূর্বের অনুকল্পের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনপূর্বক নতুন অনুকল্প নিয়ে আসা হয় যা আবার পরিচালিত হয় প্রথম ধাপ থেকে। যদি পরীক্ষার ফলাফল ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে কৃত্রিম পরিবেশের পরীক্ষা অথবা প্রাকৃতিক পরিবেশের পর্যবেক্ষণের পুনরাবৃত্তি করা হয়। একাধিকবার পুনরাবৃত্তির ফলাফল না মিললে বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে অনুকল্প বাতিল করা হয় এবং নতুন অনুকল্পের সন্ধান করা হয়। বারবার পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ সঠিক ফলাফল পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রেই অনুকল্পটিকে ‘বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব’ হিসাবে গ্রহণ করা হয়।
৪. একটি অনুকল্প বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই তত্ত্ব থেকে আরো কিছু অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। এসকল অনুসিদ্ধান্ত দ্বারা সেই প্রাকৃতিক ঘটনা ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নতুন ঘটনাকে বারবার যথাযথ ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলে তত্ত্বটিকে বৈজ্ঞানিক সূত্র বা Scientific Law-এর মর্যাদা প্রদান করা হয়।

একটি সঠিক ও প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব এরকম হাজারো পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎবাণীর সাহায্যে প্রমাণিত হয়। একটি ভুল ভবিষ্যৎবাণী বা একটি প্রধান বিষয়ের ব্যাখ্যাহীনতা বা ভুলব্যাখ্যা কেড়ে নিতে পারে একটি তত্ত্বের বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবার মর্যাদা। আর তার এই ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে তার স্থান নেয় আরেকটি হাইপোথিসিস, যেটি জন্ম দিতে পারে সঠিক তত্ত্বটিকে, যা হতে পারে একটি প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান। সূতরাং একটি প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকে কোনোভাবেই প্রমাণিত বিজ্ঞানের চেয়ে কোনও অংশে ছোট করে দেখার উপায় নেই। হতেও পারে এই তত্ত্বটিই অদূর ভবিষ্যতে নিউটনের গতি সূত্রের মতই কোনও বাস্তব,দৈনন্দিন ব্যবহার্য বিজ্ঞানের শিশুকাল।

স্টিফেন হকিং তার বিখ্যাত “A Brief History of Time” গ্রন্থে খুব সুন্দরভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে। তার সংজ্ঞাটি ছিল,
“A theory is a good theory if it satisfies two requirements. It must accurately describe a large class of observations on the basis of a model that contains only a few arbitrary elements, and it must make definite predictions about the results of future observations”
অর্থাৎ –
“একটা তত্ত্বকে ভাল তত্ত্ব বলা যেতে পারে যদি সে তত্ত্ব দুটি প্রয়োজন সিদ্ধ করে। অল্প কিছু স্বীকৃত নিয়মের ভিত্তিতে দাঁড় করানো কোনো মডেল যদি পর্যবেক্ষণের একটা বিরাট অংশকে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা যায়; এবং যদি সেখান থেকে ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণ সম্পর্কেও নিশ্চিত ও নির্ভুল ভবিষ্যৎবাণী করা যায়। "(সূত্র :- "তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা |Theoretical Physics")

 ঈশ্বর বিশ্বাসীরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখতে ভিড় জমায় সেই বিজ্ঞানের কাছে!
এখন দেখা যাক "সর্বকালের সেরা গুজব,ঈশ্বর (?)বিশ্বাস"-এর বিজ্ঞানের আশ্রিত হয়ে টিকে থাকার লড়াই!

 সব ধর্মের অনুসারীরাই দাবি করেন তাদের ধর্ম গ্রন্থটি বিজ্ঞানসম্মত! অনেকে এমনও দাবী করেন বিজ্ঞানের সকল আবিষ্কার নাকি অনেক আগে থেকেই তাদের ধর্মগ্রন্থে বলে দেওয়া আছে। বিজ্ঞানের কোনও নতুন আবিষ্কারের পরেই তারা দাবী করে বসেন এটার কথা নাকি তাদের ধর্মগ্রন্থে অনেক আগে থেকেই আছে। এই দাবী প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা নানা রকম প্রতারণার আশ্রয় নেয়। সেগুলো সম্পর্কে একটু আলোকপাত করতেই এই লেখার অবতারণা। বিজ্ঞানের কোনও  আবিষ্কারের পরে সেগুলো আগে থেকেই ধর্মগ্রন্থে আছে বলেন দাবীদাররা। কিন্তু আবিষ্কারের আগে ধর্মগ্রন্থ খুঁজে সেগুলো বের করতে পারেননা । তারা যদি এই কাজটি করতে পারতেন তাহলেই বিজ্ঞানীদের শ্রম,সময় আর অর্থ বেঁচে যেত! কিন্তু হায়,তা আর হচ্ছে কই! দেখা যাক কী ধরণের কৌশল তারা অবলম্বন করেন -

ধর্মীয় গ্রন্থকে বৈজ্ঞানিক দর্শন সাব্যস্তের চেষ্টা :

যেহেতু ধর্মগ্রন্থগুলো আমাদের অধিকাংশ মাতৃভাষায় রচিত নয় অথবা দুর্বোধ্য তাই বিপুল সংখ্যক পাঠককে ধর্মগ্রন্থ বুঝতে নির্ভর করতে হয় অনুবাদের উপর। আর এই অনুবাদের সময়ই সব থেকে বড় চাতুরিটি করে থাকেন ধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাপ্রদানকারীরা। ইচ্ছাকৃত ভাবে তারা এমন কিছু শব্দ ঢুকিয়ে দেন যা সংশ্লিষ্ট আবিষ্কারের কোনও বৈজ্ঞানিক পরিভাষার সাথে মিলে যায়। কয়েকটি  উদাহরণ দেখা যাক :---
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদের বৈজ্ঞানিক ভুলঃ-
বেদ হিন্দুদের প্রাচীনতম ও পবিত্র ধর্মগ্রন্থের নাম। বেদ (সংস্কৃত véda वेद " জ্ঞান ") প্রাচীন ভারতে লেখা হয়েছে। এটি প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ হিন্দুদের। এর চারটি মূল অংশ রয়েছে - ঋগ্বেদ,যজুর্বেদ,সাম বেদ এবং অথর্ব বেদ। অথর্ববেদ ৬/৪৪/১ এ বলা হয়েছে,"পৃথিবী স্থির ও নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে।"
Atharva Veda 6.44.1 Firm stood the heaven,firm stood the earth, firm stood this universal world. Firm stood the treesthat sleep erect: let this thy malady be still...
এবার দেখা যাক অথর্ববেদ ৬/৭৭/১। এখানেও বলা হয়েছে পৃথিবী স্থির।
Atharva Veda 6.77.1 Firm stands the heaven,firm standsthe earth, firm stands this universal world…
পৃথিবী স্থির এটা বেদাংগেও রয়েছে। বেদাংগ (নিরুক্ত ১০/৩২) বলা হয়েছে,"সবিতা পৃথিবীকে স্থির করে রেখেছেন খুটি দ্বারা।"
Rig Veda 10/149 Savitar has fixed the earth with supports; Savitar has fastened heaven in unsupported space…
Rig Veda 18/89, Sam Veda 4/1/5 Indra hath fixed [Stopped] the earth and heaven as with an axle… (দেব ইন্দ্র পৃথিবী কে স্থির রেখেছেন)।

অথচ বিজ্ঞান বলে পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহগুলো গতিশীল। আমরা লক্ষ করেছি যে, প্রতিদিন সূর্য পূর্বদিকে উঠে এবং পশ্চিমে অস্ত যায় (আপাতদৃষ্টিতে)।  এর কারণ পৃথিবী গতিশীল। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে সূর্যকে সম্মুখে রেখে পৃথিবী নিজ অক্ষে আবর্তন ও নির্দিষ্ট কক্ষপথে সূর্যের চারদিকে পরিক্রমণ করছে। এটিই পৃথিবীর গতি। পৃথিবীর গতি দুই প্রকার- আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতি। স্থির নক্ষত্রের সাপেক্ষে নিজের অক্ষের চারিদিকে পৃথিবীর একবার পূর্ণ ঘূর্ণনের সময়কালকে স্থির নক্ষত্র দিবস বলা হয়। এর মান ৮৬,১৬৪.০৯৮৯০৩৬৯১ গড় সৌর সেকেন্ড বা ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট ৪.০৯৮৯০৩৬৯১ গড় সৌর দিন। (পৃথিবীর ঘূর্ণনতল ও অক্ষের সঙ্গে অক্ষীয় নতির সম্পর্ক)। (সূত্র : বিসর্গ : অনলাইন পত্রিকা।)

ইসলাম ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআনে অসঙ্গতি ও বৈজ্ঞানিক ভ্রম :
কোরানের আকাশ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ভুল :-
৬৭) সুরা আল মূলক : আয়াত - ০৩ :
"যিনি সাত আকাশ সৃষ্টি করেছেন সুবিন্যস্তভাবে l তুমি পরম করুণাময়ের সৃষ্টিতে কোন অসামঞ্জস্য দেখতে পাবে না l তারপর তুমি দৃষ্টি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নাও, তুমি কি কোন ফাটল দেখতে পাচ্ছ ?" (অনুবাদ- ড :জহুরুল হক )
এই আয়াত অনুযায়ী, "আল্লাহ সাত আকাশ সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে অথবা সুবিন্যস্তভাবে। মানুষ বা মুহাম্মদ আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন খুত বা ত্রুটি অথবা অসামঞ্জস্যতা দেখতে পাবে না।  যদি মানুষ অথবা মুহাম্মদ দৃষ্টি ফিরিয়ে ভালো করে দেখে তবুও আকাশের কোন ফাটল বা ত্রুটি দেখতে পাবে না। অর্থাৎ আল্লাহ আকাশ সুবিন্যস্তভাবে ও স্তরে স্তরে সাত আকাশ তৈরী করেছেন।  আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন ত্রুটি নেই বা অসামঞ্জস্যতা নেই।  অনেক ভালো করে তাকিয়ে দেখলেও তাতে কোন ত্রুটি বা ফাটল দেখতে পাওয়া যাবে না। তাহলে এই আয়াত অনুযায়ী বোঝা  যাচ্ছে যে, আকাশের সংখ্যা সাতটা এবং এই আকাশ তৈরিতে কোন ত্রুটি বা ফাটল নেই। আর মানুষ যদি ভালো করে দেখে তবুও আকাশের কোন ফাটল সে দেখতে পাবে না।  অর্থাৎ আকাশ একটি শক্ত কঠিন পদার্থ আর আকাশের কোন ফাটল নেই।  আর আকাশ তৈরী করা হয়েছে একটার উপর আরেকটা এভাবে সাতটা। আল্লাহর ভাষ্য মতে আকাশ সাতটা এবং আকাশ তৈরী করা হয়েছে শক্ত কঠিন পদার্থ দিয়ে অতি সুনিপুনভাবে।  এত ভালো করে তৈরী করা হয়েছে যে এতে কোন ফাটল নেই।  আর ফাটল থাকা সম্ভব শুধু শক্ত কঠিন বস্তুর ক্ষেত্রে। অর্থাৎ আল্লাহর কথা মত আকাশ শক্ত কঠিন পদার্থের তৈরী।"
কিন্তু বাস্তব আকাশ সাতটা নয় বরং একটা। অর্থাৎ আমাদের আকাশ একটা এবং এটি গ্যাসীয় পদার্থ দিয়ে তৈরী।  কোন কঠিন পদার্থ দিয়ে তৈরী নয়।  এটি তৈরী হয়েছে গ্যাসীয় পদার্থ দিয়ে।  আর তাই গ্যাসীয় পদার্থের (বিভিন্ন স্তরে সজ্জিত) তৈরী আকাশের কোন ফাটল থাকা 'আপাতদৃষ্টিতে সম্ভব নয়', কিন্তু বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞান প্রমানকরে দেখিয়ে দিয়েছে প্রতিটি পদার্থের মধ্যে ফাঁক যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় "আন্ত:আণবিক ফাঁক" বলে।  এবং বর্তমানে গ্লোবাল ওয়ার্মিং (পরিবেশ দূষণের) কারণে আল্লাহ এর ভাষ্যকে ভূল প্রমাণ করে পৃথিবীর আকাশে বা পৃথিবীকে ঘরে থাকা এবং পৃথিবীকে মহাজাগতিক বিভিন্ন ক্ষতিকর রশ্মিকে প্রতিহতকারী 'ওজন স্তরে' ফাটল দেখা দিয়েছে!
অনুবাদকের ইচ্ছাকৃত ভুল :-
সূরা সারিয়ার ৪৭,৪৮ নং আয়াতের মূল অনুবাদ-
“আর আসমান কে আমি আপন হাতে সৃজন করিয়াছি এবং আমি অবশ্যই সব ক্ষমতাই রাখি। আর পৃথিবীকে আমি প্রসারিত করিয়াছি,আমিই চমৎকার বিছাইতে পারি। ”
সাম্প্রতিককালে বিগ-ব্যাং তত্ত্বের সাথে মিলানোর জন্য পরিবর্তিত অনুবাদ-
“আকাশমন্ডলী, আমি উহাকে সৃষ্টি করিয়াছি ক্ষমতার বলে। নিশ্চয়ই আমি উহাকে সম্প্রসারিত করেতেছি”। (এই আয়াত দিয়ে মহাবিশ্ব যে সম্প্রসারণশিল এটা যে কুরানে বলে দেওয়া হয়েছে আগে থেকে এই দাবী করা হয়! যদিও এখনও সর্বাধুনিক তত্ত্ব স্ট্রিং থিউরি নিয়ে কোন আয়াত হাজির করেনি ধর্মীয় মৌলবাদীরা!)
এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। একদিকে যেমন অনুবাদে ইচ্ছাকৃত ভাবে পরিবর্তন আনা হয়, অন্যদিকে আয়াতগুলোও ভাসাভাসা,সেখানে অনেক খুঁজে পেতে ‘বিজ্ঞান’ বের করতে হয়! আধুনিক কালের জাকির নায়েক মূলত এই চাতুরিটি সব থেকে বেশি ব্যবহার করে থাকেন। আসলে এই ধর্মীয় ব্যাখ্যাকাররা ধর্মকে যৌক্তিক বলে বিশ্বাস করেনা,বিশ্বাস কে পাকা করার জন্য যুক্তি তৈরি করে!

একিভাবে বাইবেলেও বহু বৈজ্ঞানিকী ভুল ধরা পড়ে :

আধুনিক বিজ্ঞান বলে পৃথিবী সূর্যের অংশ। কিন্তু বাইবেল বলছে সূর্য সৃষ্টির আগেই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে এবং সম্পূর্ন পৃথিবী প্রথমে জলেতে নিমজ্জিত ছিল। এমন কি এখানে সূর্য ছাড়া দিন এবং রাত্রি সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। যা কিনা বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভব। উৎস (সূর্য) ছাড়া পৃথিবী তে আলো আসে কিভাবে?
"Then God said, “Let there be an expanse between the waters, separating water from water!” So God made the expanse, separating the water beneath the expanse from the water above it. And so it was. God called the expanse “sky.” The twilight and the dawn were the second day. [Book of Genesis, ch:1; Vers:6-8]"

আর এই ধর্মীয় গ্রন্থের অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নির্ভুল এবং অক্ষয় রাখতে রাষ্ট্রীয় শাষকদের বা তদের তল্পিতল্পা বাহকদের জুরি মেলা ভার! মৃণাল দাসগুপ্ত ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান আকাদেমীর বিখ্যাত বিজ্ঞানী। উনি দাবি করেন,আজ আধুনিক বিজ্ঞান যে সমস্ত নতুন তত্ত্ব ও তথ্য প্রতিদিনই আবিষ্কার করছে,তার সবকিছুই নাকি প্রাচীনকালের মুনি-ঋষিরা বের করে গেছেন,বেদ-এ নাকি সে সমস্ত আবিষ্কার ‘খুবই পরিষ্কারভাবে’ লিপিবদ্ধ আছে। মি. দাসগুপ্তের ভাষায়,রবার্ট ওপেনহেইমারের মতো বিজ্ঞানীও নাকি ‘গীতা’র বিশ্বরূপ দর্শনে এতই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে,ল্যাবরেটরিতে আণবিক শক্তির তেজ দেখে ‘গীতা’ থেকে আবৃত্তি করেছিলেন–

"দিবি সূর্য্যসহস্রস্য ভবেদ যুগপদুত্থিতা।
যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ ভাসন্তস মহাত্মনঃ"

বিজ্ঞান-জানা কিছু শিক্ষিত হিন্দু বুদ্ধিজীবী আছেন যারা ভাবেন,আধুনিক বিজ্ঞান আজ যা আবিষ্কার করছে,তা সবই হিন্দু পুরাণগুলোতে লিপিবদ্ধ জ্ঞানের পুনরাবৃত্তি। হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাসীদের প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশন তাদের মুখপত্র ‘উদ্বোধন’-এ বলা শুরু করেছে যে,‘কৃষ্ণ গহ্বর’ কিংবা ‘সময় ধারণা’ নাকি মোটেই নতুন কিছু নয়। হিন্দুধর্ম নাকি অনেক আগেই এগুলো জানতে পেরেছিল। কীভাবে? ওই যে বহুল প্রচারিত সেই আপ্তবাক্যে,‘ব্রহ্মার এক মুহূর্ত পৃথিবীর সহস্র বছরের সমান’।
কিছু ধর্মবাদীর দৃষ্টিতে,মহাভারতের কাল্পনিক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ছিল আসলে এক ‘পারমাণবিক যুদ্ধ’ (Atomic War)। প্রশান্ত প্রামাণিক নামে ভারতের এক ‘জনপ্রিয়’ বিজ্ঞান লেখক ‘ভারতীয় দর্শনে আধুনিক বিজ্ঞান’ বইয়ে তার কল্পনার ফানুস মহেঞ্জোদারো পর্যন্ত টেনে নিয়ে বলেছেন– ‘সম্ভবত দুর্যোধনেরই কোনও মিত্রশক্তি পারমাণবিক যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে থাকবে মহেঞ্জোদারোতে’।

‘সবই ব্যাদে আছে’ মার্কা এইসব বকচ্ছপ ভাববাদীরা অবলীলায় দাবি করে ফেলেন যে,নলজাতক শিশু (Test Tube Baby) আর বিকল্প মা (Surrogate Mother) আধুনিক বিজ্ঞানের দান মনে করা হলেও তা হিন্দু সভ্যতার কাছে নাকি নতুন কিছু নয়। দ্রোণ-দ্রোণী,কৃপ-কৃপীর জন্মের পৌরাণিক কাহিনিগুলো তারই প্রমাণ। এমনকি কিছুদিন আগে উপসাগরীয় যুদ্ধে ব্যবহৃত স্কাড আর প্যাট্রিয়ট মিসাইল নাকি হিন্দু পুরাণে বর্ণিত ‘বরুণ বাণ’ আর ‘অগ্নিবাণ’ বই কিছু নয়। তারা সবকিছুতেই এমনতর মিল পেয়ে যান।

সংখ্যা সংক্রান্ত বিভ্রান্তিঃ

এই প্রতারণাটি খুব মোক্ষমভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে কারণ সাধারণভাবে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে ধারণা রয়েছে যে,যা অংক কষে দেখানো যায় তা একেবারেই নির্ভুল! অংকে বা গণিতেও যে গোজামিল বা ফাঁক থাকতে পারে সেটা তারা ভেবে দেখেনা। যেমন বলা হয়ে থাকে কোরানে সূরা সংখ্যা ১১৪,আয়াত সংখ্যা শব্দ সংখ্যা অক্ষর সংখ্যা প্রতিটি ১৯ দ্বারা বিভাজ্য। এরকম গানিতিক ভাবে সাজানো একটি গ্রন্থ ঐশ্বরিক না হয়ে যায়না! আসলেই কি তাই?
পদ্য আকারের বা ছন্দোবদ্ধ রচনাগুলোর অক্ষর,শব্দ ইত্যাদির সংখ্যা নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যা দিয়ে বিভাজ্য হতে পারে ছন্দোবদ্ধতার কারণেই। ছন্দ মেলালে অসচেতন ভাবেও এই মিল চলে আসতে পারে। যেমন পয়ার ছন্দোবদ্ধ রচনাগুলোর অক্ষর প্রায়ই ১৪, ৭ ও ২ দিয়ে বিভাজ্য। মহাভারত সহ অনেক বিশাল কাব্যগ্রন্থ পুঁথি এই ছন্দে লেখা। মূল আরবি কোরানও একটি ছন্দোবদ্ধ রচনা। সেখানেও এই ধরণের ঘটনা থাকাটা আলৌকিক কোন ব্যাপার নয়।
অনেক সময় অনেক চতুর ব্যাখ্যাকাররা এরকম কিছু সংখ্যার প্রমাণ হাজির করেন। সেগুলো মূলত অনুবাদের চাতুরী ব্যতিত কিছু নয়।
প্রচলিত ধর্মীয় আচারগুলোকে বিজ্ঞানসম্মত বলে প্রচারঃ
রোযার সময় দেখা যায় পত্র-পত্রিকা গুলোতে রোযা কিভাবে শরীরের উপকারি এই শিরোনামে বিশাল ফিরিস্তি ছাপা হয়। এসময় চিকিৎসকরাও রোযার স্বপক্ষে বলতে বাধ্য হন! রোযাকে  স্বাস্থ্যপ্রদ বলা মোটেও ঠিক নয়। এমন কেউ নেই যে রোযার প্রথমদিকে গ্যাস্ট্রিক বা পেটের সমস্যায় আক্রান্ত হননা। তবে আমাদের বায়োলজিকাল সিস্টেমের কারণে খুব দ্রুতই তা খাপ খাইয়ে নেয়। হিন্দু ধর্ম সহ অনেক ধর্মেই উপবাস প্রথা প্রচলিত আছে এবং সকলেই এর পক্ষে ‘বৈজ্ঞানিক’ ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকেন!
হিন্দুদের বিশ্বাস তুলসী গাছে তেত্রিশ কোটি দেবতা থাকে। এরফলে গাছটি পবিত্র এবং রোগ বালাই থেকে রক্ষা করে। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি ভেষজগুণ সম্পন্ন গাছ,রোগ বালাই দূর করতে এই ভেষজগুণই যথেষ্ট। তেত্রিশ কোটি কেন, একজন দেবতারও প্রয়োজন নেই!  এখন "গোমাতার" শরীরেও তেত্রিশ কোটি দেবতা বাস করছে! গোমূত্র এবং গোবর এখন প্রধান প্রসাদ রূপে স্থান পেয়েছে!  সেই উৎসাহে ধার্মিক বিজ্ঞানীগণ ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে গোমূত্র থেকে সোনা আবিষ্কার করবে বলে চর্চা করছেন !!!

জনপ্রিয় বিজ্ঞানের (Pop-Science)নামে ভাঁওতাবাজি :
 বিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা বাড়ার সংঙ্গে সংঙ্গে একদল স্বঘোষিত বিজ্ঞানী বুজরুকি চালিয়ে যাচ্ছে।  এই ক্ষেত্রে  প্রথমেই মনে আসে "অ্যালকেমি" দের কথা,  একদল স্বঘোষিত রসায়ন বৈজ্ঞানিকী যার সহজলভ্য ধাতু (লেড) থেকে সোনা বা কৃত্রিম উপায় সোনা তৈরির জন্য বিভিন্ন রকমারি গবেষণা করেন,  যার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই এবং যার বেশীরভাগইধর্মীয় রীতিকে (ভারতীয় তন্ত্রসাধকদের মত) সমর্থন করে! পরবর্তী কালে এই চর্চা ( সমাজে হানিকারক) কিছু দেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। এখনো  ভন্ড ধর্মীয় প্রতারকগণ  বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারকে অবলম্বন করে প্রতারণার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে! বর্তমানে বিজ্ঞানের কঠিন কঠিন শব্দ যেমন স্টিং থিয়োরি,  ন্যানো পার্টিকেল,  ইলেকট্রন,  বোসন কণা, বিগ-ব্যাং ইত্যাদি সাধারণ মানুষ নাম শুনেছে মাত্র কখনো কিন্তু খায় না মাথায় দেয় জানেনা।  তাই এইসব জটিল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নামকে কাজে লাগিয়ে কিছু বিখ্যাত ভন্ড বাবাজি, মাতাজির ব্যবসা চলছে রমরমিয়ে!!!  আর সমাজেরই কিছু মিডিয়া এই ভন্ডদের ভুলচর্চাকে উৎসাহিত করতে কিছু  বিজ্ঞানীর ভুলচর্চাকেই প্রকাশ করে চলেছে। এই প্রসঙ্গে মনি ভৌমিক এবং তার বই “বিজ্ঞানে ঈশ্বরের সংকেত” নামটি বলতেই হয়  আর একে তোল্লাই দিয়ে চলেছে বাংলার স্বঘোষিত সবথেকে জনপ্রিয় সংবাদপত্র!

ধার্মিক বিজ্ঞানীদের উদাহরণ প্রদানঃ
ধার্মিকদের আরও একটি প্রিয় ব্যাপার হল যেসকল প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরা ধর্ম পালন করেন তাদের উদাহরণ টানা, যেন বিজ্ঞানীরা বলেছেন বলেই সেটা সঠিক! নিউটন কিংবা আইনস্টাইন কিছু বললেই কিন্তু সেটাকে সবাই মেনে নেয়নি, তাদেরকে সেটা প্রমাণ করে দেখাতে হয়েছে। কাজেই কোনও বিজ্ঞানী বললেই সেটা সঠিক ব্যাপার এমন নয়, তাকে সেটা প্রমাণ করে দেখাতে হবে। অনেক বিজ্ঞানী আছেন যারা নিজ ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাজ করলেও অন্য ক্ষেত্রে আজন্ম লালিত সংস্কারের দ্বারাই চালিত হন। এটা কখনই ধর্মের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নয়! আবার অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা ঈশ্বর বলতে প্রকৃতিকে বুঝিয়ে থাকেন, এই ঈশ্বর প্রচলিত ধর্মের ঈশ্বর নন। যেমন,আইনস্টাইন। তিনি ঈশ্বর বলতে প্রকৃতির মহাশক্তিকে বুঝিয়েছেন, কোনও প্রচলিত ধর্মের ঈশ্বরকে না।

বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কে ভুল প্রমাণের চেষ্টাঃ

যে তত্ত্বগুলোকে কোনও ভাবেই ধর্মের সাথে খাপ খাওয়ানো যায়না সেই তত্ত্বগুলোকে তখন বাতিল করে দেয় ধর্মীয় চেতনাধারীরা। যেমন,ডারউইনের বিবর্তনবাদ। বিবর্তনবাদের মত একটি প্রতিষ্ঠিত প্রমাণিত তত্ত্ব ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক বলে একে অস্বীকার করে ধর্মান্ধরা। অবশ্য যতই দিন যাচ্ছে, বিবর্তনের পক্ষে ততই প্রমাণ জোড়দার হচ্ছে।
বিজ্ঞানের একটি বৈশিষ্ট্য হল এটি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। হাজার বছরের স্বীকৃত কোন তত্ত্ব মুহুর্তেই বাতিল হয়ে যেতে পারে। আর এটাই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য। বিজ্ঞানীরা এই পরিবর্তন কে সাদরে গ্রহণ করেন। কাজেই এখন কোনও কিছুর ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারছেনা মানে এই না যে ভবিষ্যতে পারবেনা। কাজেই কোনও কিছুর ব্যাখ্যা না পাওয়া গেলেই সেটাকে বিজ্ঞানের ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত করে রহস্যময় আখ্যা দেয়াটা এক প্রকার চাতুরী,যা ধর্ম অনুসারীরা করে থাকে। তাদের ভাষায়- ‘কোনও এক জায়গায় এসে বিজ্ঞান থেমে যায়,সেটাই স্রষ্টার জগত’। ‘বিজ্ঞান’ থেমে যায় মানে এই না যে সে আর এগোবে না। যতই দিন যাবে ততই বিজ্ঞানের অতিক্রান্ত পথ বাড়বে এবং তথাকথিত স্রষ্টার জগৎ সংকুচিত হবে।
যৌক্তিক কষাঘাত থেকে ধর্মকে বাচাতে ধার্মিকরা অত্যন্ত সংগঠিত ভাবে কাজ করে চলছে। এজন্য তারা অর্থ খরচ করতেও কার্পণ্য করছেনা। বাজারে সহজলভ্য (এমনকি বিনামূল্যে বিতরণ)  করেছে এদের তৈরি অসংখ্য বই, সিডি, ভিডিও, পত্রিকা ইত্যাদি দ্বারা। মরিস বুকাইলি নামক এক লেখকের ‘বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’ বইটি একটি উদাহরণ। সেখানে কুরানকে বিজ্ঞান সম্মত করার এমন অনেক অপচেষ্টা লক্ষনীয়। যদিও বুকাইলি সাহেব নিজে কেনও মুসলমান হলেন না সেই প্রশ্ন থেকেই যায়! আধুনিক কালে ইন্টারনেট ব্যবহার করেও তারা এই কাজটি করছে। লেখাপড়া জানা অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও এর প্রভাব পড়ছে। এদেরকে প্রতিহত করতে আমাদের বিজ্ঞান জানতে হবে, বুঝতে হবে, বৈজ্ঞানিক চেতনায় নিজেদেরকে গঠন করতে হবে এবং এদের সমস্ত অপপ্রচার কে নস্যাৎ করে দিতে হবে।
ধর্মীয় মৌলবাদীরা বুঝেছে যে বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু উভয়ের পথ ও পদ্ধতির মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। অতএব গোজামিল ছাড়া উপায় কি? একমাত্র সঠিক শিক্ষা আর বিজ্ঞানসম্মত বা যুক্তিবাদী চিন্তা ভাবনাই এদের প্রতিরোধ করতে পারে। পথটা সহজ নয়,কখনও সহজ ছিলনা। ধর্মীয় মৌলবাদীর দল সক্রেটিসকে হেমলক(বিষ) খাইয়ে মেড়েছে, ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়েছে, গ্যালিলিও কে অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রেখেছিল (অন্ধ হয়ে যান)  তবুও থেমে থাকেনি ধর্মীয় অন্ধকার সরিয়ে বিজ্ঞান তথা যুক্তিবাদের চর্চা এবং তাতেই সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়েছে, সেই থেকেই বিজ্ঞান তথা যুক্তিবাদের নির্মাণ শুরু। নিরুপায় সর্বশক্তিমানঈশ্বর(?)বিজ্ঞান তথা যুক্তিবাদের জয়যাত্রা রুখতে, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ যুক্তিবাদী হত্যাই তার প্রমাণ।
(সহায়ক গ্রন্থাবলি-
১। মনের নিয়ন্ত্রণ যোগ-মেডিটেশন : --- প্রবীর ঘোষ
২। আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না:---- প্রবীর ঘোষ
৩। উইকিপিডিয়া এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা |Theoretical Physics
৪। www.bigganjatra.org
৫। বিজ্ঞানের চেতনা- জে ব্রনোওস্কি
৬। বাইবেল, কুরান, বিজ্ঞান- মরিস বুকাইলি
৭। বিসর্গ : অনলাইন পত্রিকা
৮। কোরান শরিফ- ইসলামি ফাউন্ডেশন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ