অক্টোবর বিপ্লব: শতবর্ষ পরেও প্রাসঙ্গিক।। দারা চৌধুরী


মানব সভ্যতার যতটুকু ইতিহাস জানা যায় তাতে দেখা যায় মানব সমাজ তার সভ্যতার উন্মেষ লগ্ন থেকেই শ্রেণিবিভক্ত। একদল অল্পকিছু মানুষ বাকি বেশিরভাগ মানুষকে অত্যাচার করে (দাসপ্রথা যুগে), শোষণ করে (সামন্ত ও পুঁজিবাদের যুগে), ফুলেফেঁপে নিরাশ্রম জীবনযাপন করেছে। শোষণের ও শ্রেণীবিভক্তের এই প্রথাকে টিকিয়ে রাখতে এরা এটিকে ঈশ্বর বা দেবতার আদেশ বা অমোঘ নিয়ম বলে প্রচার করেছে। বিষয়টিকে আরো পাকাপোক্ত করার জন্য নানা দৈববাণী ও গ্রন্থ প্রেরণের নাটক সাজিয়েছে। নিরীহ মানুষগুলি তা নির্দ্বিধায় মেনেও নিয়েছে। সব সময় যে মেনে নিয়েছে তাও নয়। যুগে যুগে কিছু মহাপ্রাণ মানুষ এর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে (স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ, ভূমি অধিকার আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ ইত্যাদি)। কিন্তু সে আন্দোলন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিফল হয়েছে, আর সফল হলেও তার স্থায়িত্ব ছিল খুবই অল্প। ফরাসি বিপ্লবসহ অন্যান্য বিপ্লবগুলো এক ধরনের শোষণের উচ্ছেদ ঘটিয়ে আর এক ধরনের শোষণ, এক ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে আর এক ধরনের বৈষম্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। কারণ তখনো মানুষের জানা ছিলনা শোষণ কিভাবে হয়, শোষয়ণের উৎস কোথায়, সমাজ কিভাবে শ্রেণিতে বিভক্ত হয়।

এই যুগসন্ধিক্ষনে ১৮১৮ সালের ৫ই মে ( প্রুশিয়ার রাইন অঞ্চলের ) ত্রিয়ের শহরে কার্ল মার্কস নামক এক ব্যক্তির জন্ম হয়। তাঁর পিতা ছিলেন আইনজীবী, ইহুদী, ১৮২৪ সালে তিনি প্রটেস্টান্ট খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। মাধ্যমিক স্কুল শেষ করে তিনি প্রথমে বন-এ এবং পরে বার্লিনে, আইনশাস্ত্র পড়েছিলেন, বিশেষ করে অধ্যায়ন করেছিলেন ইতিহাস ও দর্শন। এপিকিউরাসের দর্শনের উপর ডক্টর অব ল থিসিস জমা দিয়ে ১৮৪১ সালে তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত করেন। ঐ সময় স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে তিনি ছিলেন হেগেলীয় ভাববাদী । বার্লিনে তিনি “বাম হেগেলীয় পন্থী” ( ব্রুনো বাউয়ের ও অন্যান্যরা ) গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাঁরা হেগেলের দর্শন থেকে নিরীশ্বরবাদী ও বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তসমূহ টানার চেষ্টা করতেন। ১৮৪৭ সালের বসন্তকালে কমিউনিস্টলীগ নামে অভিহিত এক গুপ্ত প্রচার সমিতিতে মার্কস ও তার বনধু এঙ্গেলস যোগ দেন। লীগের দ্বিতীয় কংগ্রেসে (লন্ডন, নভেম্বর ১৮৪৭) তাঁরা বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। ঐ কংগ্রেসের অনুরোধেই তাঁরা রচনা করেন সুবিখ্যাত ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’, ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে যা প্রকাশিত হয় । প্রতিভা সঞ্জাত স্পষ্টতা ও চমৎকারিত্ব সহকারে এই রচনাটিতে উপস্থাপিত হয় এক নতুন বিশ্ববীক্ষা। 

সঙ্গতিপূর্ণ বস্তুবাদ, যা সমাজ জীবনের পরিমন্ডলকেও অঙ্গীভূত করে; উপস্থাপিত হয় বিকাশের সর্বাপেক্ষা সহজবোধ্য ও সুগভীর মতবাদ হিসেবে দ্বন্দ্বতত্ত্ব; আর উপস্থাপিত হয় শ্রেণী-সংগ্রামের তত্ত্ব, নতুন কমিউনিস্ট সমাজের স্রষ্টা– সর্বহারা শ্রেণীর বিশ্ব-ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক ভূমিকার তত্ত্ব। প্রধানত রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের অধ্যায়নে গভীরভাবে ব্যাপৃত থেকে, মার্কস বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক রচনায় তাঁর বস্তুবাদী তত্ত্বমতকে আরও বিকশিত করে তোলেন। মার্কস এই রাজনৈতিক অর্থ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করেন। এবং রচনা করেন ‘রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের সমালোচনামূলক নিবন্ধ’ এবং ‘পুঁজি’ গ্রন্থ। এখানেই তিনি কিভাবে উদ্বৃত্ত শ্রমের বিপরীতে কিভাবে উদ্বৃত্ত মূল্য আহরিত হয়ে পুঁজির বিকাশ ঘটায় তা তিনি হাতেকলমে অংকের সাহায্যে দেখিয়ে দেন। প্রথম আন্তর্জাতিক ও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক এর মাধ্যমে তা নিমিষেই পৌঁছে যায় বিশ্বের সকল শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের কাছে। 

আর শ্রমঘন্টা ৮ ঘন্টায় কমিয়ে আনার চলমান সংগ্রাম বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে সবার নিকট গ্রহণযোগ্যতা পায়। তারই ঢেউ এসে লাগে শিকাগোর হে মার্কেটেও। পরের ইতিহাসটুকু অনেকেরই জানা।

কার্ল মার্কস উদ্বৃত্ত মূল্যের পাশাপাশি আরও একটি জিনিস সবাইকে চোখে অঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে শোষণের মূলযন্ত্র হচ্ছে উৎপাদনের উপায়সমূহের ব্যক্তিক মালিকানা। এই মালিকানা বিলুপ্তির মধ্য দিয়েই কেবলমাত্র শোষণমুক্তি তথা শ্রেণিবৈষম্য দূর করা সম্ভব। যখন দাসযুগ শেষ হয়ে পৃথিবী সামন্তযুগে প্রবেশ করে তখনো তখনকার উৎপাদনের উপায় (ভূমি)র মালিকানা ভূমিদাস বা কৃষক লাভ করতে পারেনি। ফলে সামন্তপ্রভূরা ভূমিদাসদের শোষণ করে, সমাজ শ্রেণিবিভক্তই রয়ে যায়, রয়ে যায় শ্রেণিসংগ্রামের বিষয়টাও। ঠিক একইভাবে যখন সামন্ত যুগ শেষ হয়ে পৃথিবী পুঁজিবাদের যুগে প্রবেশ করে তখনো এখনকার উৎপাদনের উপায় (শিল্পকারখানা )র মালিকানা শ্রমিকরা লাভ করতে পারেনি। ফলে পুঁজিবাদীরা শ্রমিকদের শোষণ করে, সমাজ শ্রেণিবিভক্তই রয়ে যায়, রয়ে যায় শ্রেণিসংগ্রামের বিষয়টাও। 

তাই শ্রেণিবৈষম্য এবং শোষণমুক্তির জন্য চাই সম্পদের ও উৎপাদনের উপায়সমূহ হতে ব্যাক্তিমালিকানার অবলোপন, সেখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানার নিশ্চিতকরণ।&nbsp; কিন্তু মার্কসের যুগে তত্বটির সত্যতা সবাই মেনে নিলেও প্রায়োগিক ক্ষত্রে এটি একটি ইউটোপিয় ধারণা হিসাবেই রয়ে গিয়েছিল, এবং রয়েই যেতো, যদিনা ১৯১৭ খিষ্টাব্দে মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হতো। ১৯১৭ খিষ্টাব্দের রুশদেশে নভেম্বর বিপ্লব মানব সমাজের ইতিহাসে সবথেকে বড় সামাজিক বিপ্লব। যদিও এর আগে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে প্যারি কমিউন নামে একটা বিপ্লব হয়েছিল যে বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল মানব জাতির ওপর চেপে বসা সকল নিপীড়ন ও বৈষম্যের অবসান ঘটানো। ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত ছিল এই বিপ্লবের স্থায়িত্বকাল। বিশ্বের প্রথম প্রলেতারীয় (সর্বহারা শ্রেণি) বিপ্লব ও শ্রমিক শ্রেণির সরকারকে শোষক শ্রেণি উচ্ছেদ করেছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে। ফলে একটা ভাবনা প্রায় গেঁথেই গিয়ছিল যে প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে স্থায়ী বিপ্লব অসম্ভব। কিন্তু না; রুশ নভেম্বর বিপ্লবই পাল্টে দিয়েছিল সব ভাবনা। এটা ছিল শোষণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রথম সফল বিপ্লব।<br>

সাম্যভিত্তিক মানবিক সমাজের যে স্বপ্ন মানুষ যুগ যুগ ধরে লালন করে আসছিল তার রূপায়নই ছিল এই বিপ্লবের লক্ষ্য। এবং এ লক্ষ্য। অক্টোবর বিপ্লবের পর রাশিয়া বদলেছিল। রাশিয়া ও জারের গড়ে তোলা বিরাট সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত দেশগুলো একত্রিত হয়ে সমতার ভিত্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়েছিল। অতি অল্প সময়ের মধ্যে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সেই বিশাল ভূখণ্ড থেকে ক্ষুধা তাড়িয়েছিল। সব মানুষের জন্য বাসযোগ্য আবাসন সুযোগ নিশ্চিত করেছিল। সব শিশুর জন্য একই পোশাকে একই মানের শিক্ষা দিয়েছিল। ভেদাভেদ ছিল না মানুষে মানুষে, রুশ আর উজবুকে। নারীকে দিয়েছিল সমমর্যাদা। তখন মজুরের সন্তানও স্বপ্ন দেখতেন, সে দেশের কর্ণধার হবে। অনেকে হয়েও ছিলেন। ক্রীড়াতে তারা অর্জন করেছিল অভূতপূর্ব সাফল্য। সোভিয়েত সিনেমা পশ্চিমা দুনিয়ায় চমক লাগিয়ে দিয়েছিল। দেশটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অসামান্য সাফল্য এনেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের নভোযান সবার আগে চাঁদে পৌঁছেছিল। এসব অর্জনের মূলে ছিল মানুষের শক্তি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করে। আর সোভিয়েত সেসব বিভাজন মুছে দিয়ে মানুষের শক্তিতে বলীয়ান হয়েছিল। যা এনে দিয়েছিল উৎপাদন ও উন্নয়নে গতিময়তা। এসেছিল মানবতাবোধেরও জাগরণ। 

এর প্রভাব থেকে দূরে থাকতে পারেনি পশ্চিমের পুঁজিবাদী দেশগুলো। বিপ্লব-আতঙ্কিত এসব ধনী দেশ তলার মানুষের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা ভাতা ইত্যাদি চালু করে। শ্রমঘন্টা কমানোর সাথে সাথে শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়ণে এরা বাধ্য হয়েছিল বোনাস, পেনশন, প্র্রভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদি চালু করতে। কার্ল মার্কসের শ্রেণি সংগ্রাম ও সামাজিক অস্থিরতা, তার ফলশ্রুতিতে যে সংঘাত অনিবার্য, তা ঠেকাতে পুঁজিবাদ বাধ্য হয়েছিল তার হিংস্ররুপ পরিহার করে কিছুটা মানবিক হতে। তারা বুঝে গিয়েছিল মেহনতি মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি। তাই নিজের পায়ের তলার মাটি রক্ষা করতেই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে সর্বহারাদের আনতে বাধ্য হয়েছিল।

একে বলা যায়, অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পরোক্ষ অবদান। সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমূহের পতনের পরও, মানব জাতির জন্য একটি মানবিক বিশ্ব তৈরীর সূচনা করে গেছে রুশ বিপ্লব, তা আজও প্রাসঙ্গিক। আজও প্রেরণাদয়ী নব নব মানবিক বিপ্লবে সমূহের।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ