এক রসিক বুড়োর গল্প || সুমিত্রা পদ্মনাভন


আমরা রবীন্দ্রনাথের সবটা বুঝিইনি, জানি না। জানতে চাইওনি। সেই যে উনি ১৯১৩-তে নোবেল প্রাইজ পেলেন, কয়েকটা কবিতা, গানের জন্যে, ব্যাস আমাদের জানা বোঝা সেখানেই শেষ। আর গুরুবন্দনার শুরু। সেই 'বছরে তিরিশবার, চিত্রাঙ্গদা আর শ্যাম-শাপমোচনের অশ্রুমোচন...' শুরু হয়ে গেল। আমরাই জানি না, তো পাশ্চাত্যের মানুষ আর কী করে জানবে? আশ্চর্য হই না যখন শুনি বার্টান্ড রাসেল আমাদের রবি ঠাকুরের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। কারণ আমরা রবি ঠাকুরের চিন্তা-ভাবনা, আধুনিকতা, প্রাসঙ্গিকতা ওঁর ক্রমশ সত্তর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও নিরলস চিন্তার পথ চলা, আঁকা, চিঠি লেখায় তার প্রতিফলন - এসব সম্বন্ধেও ওয়াকিবহাল নই। ইউরোপে যে হাওয়া উঠেছিল নোবেল পাওয়ার পর, গীতাঞ্জলি-র ইংরেজি অনুবাদ ১০ বার রিপ্রিন্ট হয়েছিল ৭-৮ মাসের মধ্যে, সেই জনপ্রিয়তা স্তিমিত হয়ে এসেছিল ১৯৩০ এর আগেই। আর কে না জানে ইংরেজিতে অনুবাদ না হলে সারা পৃথিবী কেন, সারা ভারতের লোকও জানতে পারে না কিচ্ছুটি।
জীবনের শেষ দশকে আশ্চর্য্য রকম নির্মোহ আর যুক্তিনিষ্ঠ ছিলেন এই রসিক বুড়ো।
তখন গান কবিতা কমে এসেছে, ছবি আঁকা ধরেছেন। কে কী বলবে পাত্তা লাগান না। অর্ডারী লেখার চাপকে অগ্রাহ্য করে অজস্র চিঠিতে ঢেলে দিয়েছেন মনের কথা।
এই সব আশ্চর্য চিঠিগুলো এক ভাববাদী, ধর্মপ্রাণ, আচারনিষ্ঠ মহিলা হেমন্তবালা দেবীকে লেখা। তিনি কবির কবিতার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়েও কবির ধর্মীয় মতামত বুঝতে অপারগ। তাই এই চিঠিগুলো খুব মজার। প্রায় ভাববাদ বনাম যুক্তিবাদ বিতর্কের মতো।
কিন্তু কোনও রাগ বিদ্বেষ নেই। সস্নেহে নিজের মতে স্থির থেকে অনর্গল লিখে গেছেন। কবির স্বাভাবিক রসবোধ আর শালীনতা এই একতরফা চিঠিপত্র গুলিকে খুবই আকর্ষণীয় রূপ দিয়েছে।
তাই ১৯৩০ এর পরের চিঠিপত্র থেকে একটা চিঠি তুলে দেওয়ার লোভ হল।


১৬ অক্টোবর  ১৯৩৩

কল্যানীয়াসু

       তুমি  নিজেকে অত্যন্ত মিথ্যা পীড়ন  কর। তোমার  প্রতি আমার লেশমাত্র রোষ বা অবজ্ঞার ভাব নেই সে তুমি নিশ্চয় জানো তবু থেকে থেকে নিজের মধ্যে একটা বিপ্লব বাধিয়ে  তোলো। তোমাকে উপলক্ষ করে আমি অনেক কথা বলি কিন্তু তোমাকে বলি নে। দেশের  অসীম দুর্গতির কথায় মন যখন  উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তখন চুপ করে থাকতে পারি নে। ধর্ম্মে ও নিরর্থক আচারে হিন্দুকে শতধা বিভক্ত  করে রেখেচে,বিদেশীর হাতে তাই পরাভবের পর পরাভব ভোগ করে আসচি। অন্তঃশত্রু এবং বহিঃশত্রুর হাতে মার খেয়ে খেয়ে  আমাদের হাড় জীর্ণ । মুসলমান , ধর্ম্মে এক,আচারে এক, বাংলার মুসলমান ,মাদ্রাজের মুসলমান ,পাঞ্জাবের মুসলমান এবং ভারতবর্ষের বাইরের মুসলমান  সমাজে সবাই এক,বিপদে  আপদে সবাই এক হয়ে দাঁড়াতে পারে এদের সঙ্গে ভাঙাচুরো হিন্দুজাত পারবে না। আরো একবার আফগানিস্তানের পাঠানদের হাতে কানমলা খাবার দিন ঘনিয়ে আসচে । পি ,সি , রায় অরণ্যে রোদন করচেন , বলচেন বাঙালির অন্ন পরের হাতে যাচ্চে ।কিন্তু বাংলার মুসলমানরা পিছয় নি - দেশে বিদেশে তাদের দেখেচি জীবিকা উপার্জনে - কেননা বিধিনিষেধের নাগপাশ তাদের হাজার পাকে জড়িয়ে রাখেনি । মজ্জাগত অনৈক্যজনিত দুর্ব্বলতা এবং  সহস্রবিধ বিধিনিষেধের বোঝা ঘাড়ে করে এই জাত বাঁচবে কী করে ? সামজিক অসম্মান থেকে বাঁচবার জন্যে প্রতিদিন নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান এবং খৃস্টান হতে চলচে - কিন্তু   ভাটপাড়ার চৈতন্য নেই । একদা ঐ তর্কবন্ধুদের প্রপৌত্রমন্ডলীকে মুসলমান যখন জোর করে কলমা পড়াবে পরিতাপ করবারও সময় থাকবে না ।
এই সব মনের দুঃখ তোমার কাছে মাঝে মাঝে ভাষায় প্রকাশ করি তাতে হয়েছে কি ? দেশের কথা চিন্তা করে যে কঠিন আঘাত আমাকে বাজচে সেটা তুমি ভেবে দেখ না কেন ? দেশের জন্যে আমি তোমাকেও ভাবাতে চাই - তুমি কি দেশের মেয়ে নও ? বাক্তিগতভাবে তোমাকে বেদনা দিতে আমার একটুও ভাল লাগে না - কিন্তু বিধাতার অভিসম্পাতে যে বেদনা প্রায় বিশ কোটি হিন্দুর প্রাপ্য চোখ বুজে নিজেকে ভুলিয়ে তুমি তার থেকে নিষ্কৃতি পাবে কী করে ?এ সমস্ত ন্যায়শাস্ত্রের তর্ক নয় - এ সমস্ত দুর্ভাবনা চতুর্দিকব্যাপী সুকঠোর বাস্তবতার উপরে প্রতিষ্ঠিত । রাষ্ট্রিক অধিকারের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আলোচনা  চলচে আজকাল-যেন লঙ্কাভাগ করতে বসেচি অথচ সমস্ত লঙ্কায় যাচ্চে তলিয়ে । তুমি তো সন্তানের জননী , হিন্দুসমাজের ভবিষ্যৎ তোমার ছেলেমেয়েদের দুর্ব্বল স্কন্ধে চাপিয়ে দিয়ে একদিন তুমি চলে যাবে। কিন্তু সে কী ভবিষ্যৎ, ভেবে দেখো।
আমার এই সমস্ত কথা শুনে কখনো মনে কোরো না তোমার প্রতি আমি নির্ম্মম। তোমার আচার বিচার যেমনি হোক না কেন তোমাকে আমি স্নেহ করতে পারব না আমার হৃদয় এত কৃপণ নয়। আমার প্রতি বিশ্বাস রেখো এবং ভুল বুঝে নিজেকে পীড়ন কোরো না।

ইতি
দাদা
১৬ অক্টোবর ১৯৩৩

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ