ধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ - ২ || দারা চৌধুরী





নৃতাত্ত্বিক মতবাদ অনুযায়ী ধর্মের বিবর্তন বা ক্রমবিকাশ এর সময়কে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আর তা হল-
১) Prehistoric (প্রাগৈতিহাসিক) -
ক) animistic (সর্বপ্রাণবাদ ধর্ম)
খ) totanism (উৎসবস্তুবাদ/প্রকৃতিবাদ ধর্ম)
২) Ancient - polytheistic (প্রাচীন - বহুঈশ্বরবাদ ধর্ম)
৩) Perennial - archetypal (দীর্ঘস্থায়ীকাল- আদিরুপকীয় ধর্ম)
৪) Prolific - alternative (ভিন্নমতাবলম্বী কাল -বিকল্পিত ধর্ম)

সর্বপ্রাণবাদ
-----------------
সর্বপ্রাণবাদ বলতে বোঝায়- আত্মায় বিশ্বাস করাকে। আদিম মানুষেরা বিশ্বাস করত প্রত্যেক বস্তুরই আত্মা আছে। মানুষ,পশুপাখি,গাছ-পালা,নদ-নদী,গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি সকল সৃষ্টির মধ্যে আত্মা বিদ্যমান করে বলে আদিম যুগে যে মতবাদ প্রচলিত ছিল তাই সর্বপ্রাণবাদ। এ সম্পর্কে স্যার জেমস ফ্রেজারের সর্বপ্রাণবাদ হল মানুষের আত্মায় বিশ্বাস এবং মৃত্যুর পর আত্মার শপুনরুজ্জীবনের বিশ্বাস। ইউলরের মতে-সর্ব প্রাণবাদ থেকেই ধর্মের উৎপত্তি। আদিম মানুষেরা বিশ্বাস করত মানুষের আত্মা আছে তাদের শরীরে। আত্মা নিঃশ্বাসের সাথে বের হয় এবং নিদ্রার সময় তা দেহে থাকে না। মানুষের মৃত্যু হলে আত্মা চিরতরে বাইরে গমন করে। কিন্তু মৃত ব্যক্তির সাথে ভাল খাদ্য-পানীয় দিলে তা আবার মানুষের শরীরে ফিরে আসবে,এই ভাবনা তাদের ছিল। এছাড়া অশুভ মৃত আত্মা থেকে জন্মলাভ করে প্রেতাত্মা, এটিও তারা বিশ্বাস করত।

প্রকৃতিবাদ ধর্মবাদ (খ্রীঃপূঃ ৫০০০ সাল পর্যন্ত)
-----------------------------------------------------------------
মানুষ আদিম কাল থেকে নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতো। যেমন: ঝড়, তুফান, খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, ব্জ্রপাত, শিলাবৃষ্টি, ফসলের উপর পঙ্গপালের আক্রমণ এবং নানাবিধ ভয়ানক রোগ ব্যাধি। এসব ছিল মানুষের জন্য অত্যাধিক আতঙ্ক ও জীবন হুমকির ব্যাপার। মানুষ ঐ সমস্ত দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষার জন্য নানাবিধ প্রাকৃতিক শক্তির কাছে প্রকাশ্যে বিনয়ের সাথে আত্মসমর্পন করে কান্নাকাটি করতো এবং খুশি করার জন্য পূজো ও দিতো।
প্রধান প্রধান শক্তিগুলো হলো:
বিক্ষুব্ধ বাতাস,
সাগর, পাহাড়,
চন্দ্র, সূর্য,
অন্ধকারের ভূত প্রেত,
ভয়ঙ্কর বন্যজন্তু ,
আগুন, বৃষ্টি
ও পানি।

একারণে সুদুর অতীত কাল থেকে কোনো কোনো সম্প্রদায় কিংবা কোনো কোনো এলাকায় কল্পিত পানির রাজাকে (বা দেবতাকে) খুশি করার জন্য পানিতে পূজো দেয়ার ব্যবস্থা করে। তাই সাগর, হ্রদ, দীঘি ও নদীর জলের মধ্যে সুগন্ধিযুক্ত ফুল ছড়ানো, মিষ্টি ফল বিতরণ করা ছাড়াও উপঢৌকন হিসেবে নানাবিধ অলঙ্কার ও কাপড় চোপড় ইত্যাদি দেয়া হতো। যা আজো পৃথিবীর বিভিন্ন আদি সমাজ ও বিজ্ঞান শিক্ষায় বঞ্চিত দেশগুলোর আনাচে কানাচে হচ্ছে। এসব ব্যবস্থাপনা শুরু হয় পরিবার ও গোষ্ঠীর ক’জন মিলে, নানাবিধ পরামর্শের পর। এভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বাতাস যখন প্রবল বেগে বইতে শুরু করে তখন আদিম মানুষ বাতাসকে ক্রোধান্বিত না হওয়ার জন্য নানা রকমের ছড়া কাটতে কাটতে বাতাসের মধ্যে ছড়িয়ে দিতো সুগন্ধিফুল, শস্য দানা ইত্যাদি। সূর্য যখন উদয় হয় তখন সমস্ত আঁধার কেটে যায়। অন্তর থেকে দূর হয় বন্যপ্রাণীর আক্রমনের ভয়, ভূত প্রেতের ভয়। শিকার, কাজকর্ম ও চলাফেরা করতে হয় সুবিধে। সূর্যের আলো দ্বারা হয় শীত নিবারণ। অতএব সূর্য হচ্ছে এক বিশাল উপকারি দেবতা। সুতরাং সূর্যকে খুশী না করলে ওটা মাঝে মাঝে রাগ করে বসে। সব কিছু পুড়িয়ে দিতে চায় (খরা) আবার বৃষ্টির সময়ে গর্জন করে (বিদ্যুৎ ও বজ্রপাত দ্বারা) নানা বিপত্তি ঘটায়। অতএব সূর্য দেবতা ভীষণ শক্তিশালী, ওকে খুশ রাখা খুবই জরুরি। এরকম মানসিক ধারণা থেকে সূর্যকে মানুষ নানা ভাবে পূজো দিতে শুরু করে। অনেক আদিম সম্প্রদায় আগুনকে সূর্যের প্রতিনিধি মনে করে অগ্নিপূজা করতো।

প্রাচীনকালে মানুষের প্রধান শত্রু ছিল বিভিন্ন ধরণের পশুপাখি বা জীবজন্তু। নিয়েন্ডার্থেল মানুষের হাতিয়ার দুর্বল ছিল। ফলে হিংস্র জীবজন্তুকে প্রতিহত করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। তারা শুধুমাত্র একটি পশুকে নয়,পশুর ছায়াকেও ভয় পেত। প্রথমে যদিও তারা পশুকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করত, তারা ভাবত- তাদের কাছে হাতিয়ার আছে। অন্য পশুকে শিকার করার জন্য তারা হাতিয়ার ব্যবহার করছে। কিন্তু পশুরা তা করছে না। পশুরা তাদের নখ,দাঁত,শিং,বিষ,চামড়া ও গর্জন দিয়ে প্রতিহত করছে তাদের। এছাড়া পাখি ও মাছের মধ্যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। পাখি আকাশে উড়তে পারে এবং মাছ পানিতে চলাফেরা করে। হিংস্র প্রাণীরা কিভাবে এক থাবাতেই তাদেরকে বধ করছে এবং পাখি বা মাছের বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাদেরকে ভাবতে সাহায্য করায় যে-ঐসব জীবজন্তু তাদের থেকে অনেক বেশি ক্ষমতা শীল। ফলে মানুষ ওগুলোর কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। ভেবে নেয় যে- সবকিছুর নিয়ন্তা ঐ জীবকুল। ফলে শুরু হয় পশু পূজা।তাদের মনে বিশ্বাস ছিল যে,তাদের টিকে থাকার জন্য অবশ্যই পূজা করতে হবে ঐসব জীবকে যেগুলো তারা পরাস্ত করতে পারে নি। যেমন- সাপ, বাঘ ইত্যাদি। 

টোটেম সমাজে পশু পূজার মধ্য দিয়ে উৎপত্তি লাভ করে ভোজবিদ্যা ও কলাবিদ্যা। কেননা তারাই সর্বপ্রথম পশু পূজাকে উৎসবে রূপ দেয়। বিভিন্ন পশুকে কেন্দ্র করে টোটেমে উৎসব আয়োজন করা হত। আর প্রতিটি টোটেমের আলাদা নাম ছিল। যে টোটেম যে পশুকে পূজা করত তাদের টোটেমের নাম সেই অনুযায়ী রাখা হত। এবং তারা ভাবত শিকারের সময় ঐ নির্দিষ্ট পশু তাদেরকে সমস্ত বিপদের হাত থেকে রক্ষা করবে। কিভাবে টোটেম পশু তাদেরকে সহায়তা করে এগুলোই তারা বর্ণনা করত নেচেগেয়ে। উৎসব শেষে বলি দেওয়া হত পশুকে। তারা ভাবত পশুর রক্ত ও মাংস তাদেরকে ঐ পশুর সমান ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করবে। এ থেকেই পশু বলি দেওয়া, নৃত্যকলা ও ভোজ উৎসবের জন্ম।

এইটুকু পর্যন্ত ধর্ম ছিল সামাজিক সম্পত্তি, এখান থেকে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোনরকম লাভ বা ফায়দা লুটার চেষ্টা ছিল না। ছিল নিজস্ব অজ্ঞতা ও ভয় থেকে উৎসারিত একান্তই ভক্তি বাদ, স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে। এখানে ধর্ম প্রতারণার বা রাষ্ট্র / সমাজ ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হয়ে উঠেনি। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

X

Never Miss an Update!

Join my newsletter to get the latest posts from littlemag.in directly to your inbox.