বেণীসংহার বৃত্তান্ত।। কলিম খান




১ [ ... "কেশ' শব্দের একটি প্রতিশব্দ হল 'কচ'। যেখানে মানুষের 'কচ'-হরণ বা মালিকানা-হরণ করা হত, এককালে সেই স্থানকে বলা হত ‘কচ-হরি’। বিহারে ঐ ‘কচ-হরি’ শব্দটি এখনও অবিকল ঐভাবেই উচ্চারিত হয়; আর বাংলায় ঐ শব্দটিই ‘কাচারি’ শব্দের জন্ম দিয়েছে..."। ]

২ ["… ঐ ‘কেশ’ শব্দই বিদেশে গিয়ে যে সকল অনাবাসী ভারতীয় উত্তরসূরীর জন্ম দেয়, অন্য দেশের জল-হাওয়ায় বড় হয়ে তাদের স্বভাব চরিত্রে পোশাক-আশাকের বিস্তর বদল ঘটে যায়; case ও cash যাদের অন্যতম। যাঁরা ঐ ‘কেশ’ নিয়ে কাজ কারবার করেন, স্বভাবতই তাদের দুটি শ্রেণী। দৈহিক কেশ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদেরকে নাপিত বলে এবং মানসিক-কেশ নিয়ে যাঁরা কাজ কারবার করেন তাঁদেরকে আইনজ্ঞ বা উকিল বলে। নিজে উকিল ছিলেন বলেই মহাত্মা গান্ধী এই রহস্য জেনে গিয়েছিলেন। তাই তিনি ঘোষণা করেছিলেন: ‘নাপিত ও উকিলের সমান বেতন হওয়া উচিত...৩" ] -কলিম খান।...

৩ ["... সাধারণত কিন্তু প্রকৃতিগত কারণে, মালিকানার উদ্ভবের মতো কেশোদ্গম হতে থাকলে তাকে মুণ্ডন করে তো আর থামানো যেতে পারে না। ভীষ্ম৯ থেকে গান্ধী পর্যন্ত সবাই সে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, মালিকানা ও কেশ, কামালেই বাড়তে থাকে।" ]

এক

 মেয়েরা লম্বা চুল রাখেন কেন এবং ছেলেরা লম্বা চুল রাখেন না কেন? মানব-মানবীর এইরকম আচরণের পিছনে কি কারও কোনও প্রকার প্ররোচনা আছে, সমাজের কিংবা প্রকৃতির? না কি চুল রাখা বা না-রাখা সংক্রান্ত আচার-ব্যবহার সম্পূর্ণভাবেই ব্যক্তিমানবের বা ব্যক্তিমানবীর ইচ্ছাধীন? অর্থাৎ, কেশচর্চ্চা বিষয়ে মানুষের আচার-আচরণ কি কোনও সমাজ-ঐতিহাসিক বিকাশধারার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না কি তা একান্তভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত বিচ্ছিন্ন তাৎক্ষণিক ঘটনা মাত্র?

এ প্রশ্ন হয়তো এখুনি উঠত না, যদি না মেয়েরা তাঁদের অধিকার দাবি করতেন। না, আধাআধি নয়, মাত্র ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের দাবি করা হয়েছিল। সেই উদ্দেশ্যে সংসদে আনা হয়েছিল মহিলা বিল। কথাটি উঠে পড়েছে সেই বিল নিয়ে আলোচনা কালে। যাঁরা ছেলেদের মতো চুল ছেঁটে ফেলেন, সেই সকল বেণীসংহারকারিণীদের নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 'জনতা-দল'পতি শ্রী শরদ যাদবের মতো কেউ কেউ আজকালকার মেয়েদের ‘বয়কাট’-কেশচর্চায় আপত্তি তুলেছেন। যাঁদের আজানুলম্বিত কেশদাম, যাঁরা দীর্ঘকেশিনী, যাঁরা আলুলায়িত কুন্তলা, তাঁদের নিয়ে অবশ্য শরদ যাদবদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তবে মেয়েদের মাথা নিয়ে ছেলেদের মাথাব্যথা হওয়া উচিত কি না, কিংবা ছেলেদের তেমন অধিকার আদৌ থাকা উচিত কি না, সে সব প্রশ্ন স্বতন্ত্র। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, শেষমেষ ঘুরেফিরে মেয়েদের মাথায় লম্বা চুল রাখা না-রাখার প্রসঙ্গটি উঠে পড়েছে।

মেয়েরা লম্বা চুল রাখেন কেন? অনেকে বলবেন – এ আবার কেমন কথা! রাখার ইচ্ছা হয় রাখে। বলা চলে, এ হল ঐতিহ্য, বহুকাল ক্রমাগত অভ্যাস। কিন্তু প্রশ্ন হল, অমন ইচ্ছাই বা  মেয়েদের হল কেন এবং ছেলেদের হল না কেন? এমন তো নয় যে, মেয়েরা দাঁড়ি-গোঁফ রাখেন না সেসব তাঁদের মুখে জন্মায় না বলে, আর ছেলেরা দীর্ঘকেশ রাখেন না তাঁদের মাথায় চুল জন্মায় না বলে। না, ব্যাপার আদৌ তেমন নয়। ছেলেদের মাথা মেয়েদের মাথার মতোই সমান উর্ব্বর। ছেলেদের মাথাতেও, মেয়েদের মাথার মতোই, একই হারে কেশোদ্গম হয়। মেয়েদের মতো কেশচর্চ্চা করলে তাঁদেরও আজানুলম্বিত বেণী হতে পারে। তাহলে, দেখা যাচ্ছে, ‘মেয়েরা লম্বা চুল রাখেন কেন’ – এই প্রশ্নের উল্টো পিঠে আরও একটি প্রশ্ন রয়েছে : রীতিমতো চুল গোঁফ দাঁড়ি গজানো সত্ত্বেও ছেলেরা সাধারণত সেগুলি কেটে-ছেঁটে ফেলেন কেন?

আজকাল এই প্রকার বহু প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করছে Kinesics বা অন্যান্য ‘বিহেভিয়ারাল সায়েন্স’। তবে মানবজাতির কেশচর্চ্চার বিষয়ে এমন কোনও প্রশ্ন এ যাবৎ সে উত্থাপন করেনি। বলা ভাল, তেমন কোনও প্রশ্ন উত্থাপন করবার যোগ্যতাই সে অর্জ্জন করতে পারেনি; উত্তর সংগ্রহ করা তো দূরের ব্যাপার। এইরূপ অপারঙ্গমতার হেতু সম্ভবত এই যে, কেশচর্চ্চার ব্যাপারটি ‘অতিপ্রত্যক্ষতা’ দোষে দুষ্ট, যেমন ‘অতিপ্রত্যক্ষতা-দোষ’ ছিল আপেলের অধঃপতনে। ‘আপেল কেন পড়ে’, ‘মেয়েরা কেন চুল রাখেন’, ‘ছেলেরা কেন চুল ছেঁটে ফেলেন’ – এই সকল প্রশ্নের যেন প্রশ্ন হবারই যোগ্যতা নেই, এতই সরল ও প্রত্যক্ষ। নিউটন প্রমাণ করে গেছেন, অমন সরল ও প্রত্যক্ষ ব্যাপারের পিছনে কেমন বিশাল বৈজ্ঞানিক রহস্য সংগুপ্ত থাকে।

মানবপ্রজাতির কেশচর্চ্চার পিছনেও রয়েছে তেমনি এক অদ্ভুত রহস্য, সমাজের ও প্রকৃতির কিছু অমোঘ নিয়ম। মেয়েদের ইচ্ছা হল, আর তাঁরা লম্বা কেশ রাখলেন; আর ছেলেদের তেমন ইচ্ছা হল না, তাই তাঁরা সেগুলি কেটে-ছেঁটে ফেললেন – ব্যাপারটি অত সরল নয়। মাথার উপর যে বোঝা বহন করা স্বভাবতই বিরক্তিকর, তাকে গৌরবজনক ভেবে আজীবন তার পরিচর্য্যা ও বহন করতে হলে মনটাকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রস্তুত করা দরকার। মেয়েদের মন কোন বাধ্যবাধকতায় সেভাবে প্রস্তুত হয়ে উঠল, সেটা হিসেবের বাইরে রাখা যায় না। হাজার হাজার বছর ধরে সমাজ ও প্রকৃতির কোন অমোঘ নিয়ম কোটি কোটি মেয়েকে তাঁদের মাথায় ঐ বোঝা বহন করিয়ে নিয়ে চলেছে, এবার সেটি জানা দরকার। আবার, আজকাল শিক্ষিত মেয়েরা কেনই বা সেই বোঝা ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইছেন, ‘বয়কাট’-কেশচর্চা করছেন, জানা চাই তার কারণটাও।

বিষয়টিকে বুঝে নেওয়ার জন্য প্রথমে আমরা মানুষের কেশচর্চ্চার ইতিহাসটায় এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নেব। তারপর জেনে নেব, সমাজমনে কেশবিন্যাস বিষয়ে প্রচলিত ধারণা ও সেই ধারণার রদবদলের ইতিহাস। এর পরে আমরা ‘কেশ’ বিষয়ে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গীর গভীরে অনুপ্রবেশ করব, ‘কেশোদ্গম’ ও ‘কেশচর্চ্চা’র প্রাকৃতিক ও সামাজিক রহস্য অনুধাবন করব; জানব সেই অমোঘ অনিবার্য্য নিয়মকে। অতঃপর সেই নিয়ম ঠিক না বেঠিক, কেশবিন্যাসের ইতিহাসের সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ কি না, সেটা মিলিয়ে দেখব। সবশেষে ঐ নিয়মের নিরিখে এ যুগের কেশবিন্যাসের যাথার্থ্য যাচাই করা হবে; টানা হবে ভবিষ্যৎ কালের কেশবিন্যাসের রূপরেখা। অচেতন কেশচর্চ্চার যুগ অতিক্রম করে এভাবেই আমরা সচেতন কেশচর্চ্চার যুগে উত্তীর্ণ হয়ে যেতে পারব।

দুই

সুদূর অতীতে যে সকল মানব মানবীর সাক্ষাৎ আমরা পাই, তাঁদের কেশ নাতিদীর্ঘ ও অবিন্যস্ত। অন্তত প্রাচীনতম ফসিলগুলি সেইরকম সাক্ষ্যই দেয়। নর ও নারীকে কেবলমাত্র কেশের দৈর্ঘ্য দেখে তখন পৃথক করা যেত না। উভয়ের চুলই তখন প্রায় এক মাপের। যেমন বানর-বানরীর, কিংবা বনমানুষ-বনমানুষীর। হয়তো গুহামানুষ অস্ত্র আবিষ্কার করার পর সর্ব্বাগ্রে যা কেটেছিল, সেটা তার চুলই। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধে হয়তো তার চুলটাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, শিংওয়ালা হরিণের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়। কিংবা এমনও হতে পারে যে, সেই সুপ্রাচীন যুগে মানুষের কেশোদ্গমই হত একটা সীমিত মাত্রায়। যাই হয়ে থাকুক, সে বিষয়ে আমরা বেশি কিছু জানি না। 

… তারপর এল নগরসভ্যতার যুগ, মহেঞ্জদারো-হরপ্পা প্রভৃতি। সেই নগরসভ্যতার যুগেই, আমরা দেখতে পাচ্ছি, মেয়েদের লম্বা চুল রাখার প্রথা প্রচলিত হয়ে গেছে। সিন্ধুসভ্যতার ধ্বংসাবশেষ যেমন তার সাক্ষ্য দিচ্ছে, তেমনি প্রাচীনতম রচনাগুলি, পৌরাণিক গ্রন্থগুলিও মেয়েদের কেশের সেইরূপ বর্ণনা দিচ্ছে। কিন্তু ছেলেদের, দেখা যাচ্ছে, প্রায় গুহামানুষের মতো, কিংবা তার চেয়েও ছোট চুল। 

… এরপর আমরা পাচ্ছি জটাধারী পুরুষ এবং যথারীতি দীর্ঘকেশিনী নারী। শিখাধারী কেশহীন ব্রাহ্মণের আবির্ভাব তার পরে। আরও পরে বাবরি-চুল-ক্ষত্রিয়ের আবির্ভাব। কিন্তু নারী আগের মতই দীর্ঘকেশিনী। ‘পাষণ্ড-মৌণ্ড’ বা ‘মুণ্ডিত মস্তক শূদ্র’দের আবির্ভাব তার পরেই। কোল পারশব প্রভৃতি ‘সম্প্রদায়’, যাঁরা গোঁফদাড়ি কামান না তাদেরকে ঐ একই সময়ে দেখতে পাওয়া যায়। তাঁদের ভিতর আবার শকগণ ‘অর্ধ-মুণ্ডিত’, যবন ও কম্বোজগণ ‘মুণ্ডিত-মুণ্ড’ এবং কেরল ও পহ্ণবগণ ‘শ্মশ্রুধারী’ ছিলেন। তার বহু পরে, বৌদ্ধযুগে এসে, আমরা সাক্ষাৎ পাচ্ছি একেবারে নেড়া-বৌদ্ধদের। এর মাঝে মেয়েদের মাথায় হাত পড়েনি তেমন, যদিও ছেলেদের মাথায় বারংবার হাত পড়তে দেখা গেছে। 

… এরপর মোগলদের যুগ। তাদের পুরুষরা বাবরি চুলের অধিকারী হলেও নারীরা ভারতীয় নারীর মতোই দীর্ঘকুন্তলা। ভারতসমাজে তখন শিখাধারী ব্রাহ্মণ, সীমিতকেশ কেউ কেউ, কেউ-বা নেড়া, কেউ-বা শ্মশ্রুধারী কিন্তু নারীরা আগাগোড়া দীর্ঘকেশিনী। … এরপর ইংরেজ এল। সাধারণভাবে ছেলেদের সীমিত কেশ এবং মেয়েদের দীর্ঘকেশের রেওয়াজ বলবৎ থাকল। অবশ্য ইউরোপ থেকে একটা নতুন জিনিস এল – ‘ববকাট’। শিক্ষিত মেয়েদের দু-চারজন সেই ববকাট-এর দ্বারা প্রভাবিত হলেন। বয়কাট, চায়না-কাট, স্লিককাট, ব্লান্ট … ইত্যাদি, এসব এসেছে সম্প্রতি। আর তার প্রকোপ দেখা যায় সাধারণত শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে।

কেশচর্চ্চার এই ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারছি, এককালে নর-নারীর চুলের দৈর্ঘ্য সমান ছিল। তারপর নারী দীর্ঘকেশিনী হয়েছে। সুদীর্ঘকালের দীর্ঘ কেশচর্চ্চা চালিয়ে যাওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, সম্প্রতি সে বয়কাট রপ্ত করতে চাইছে। আর ছেলেরা তাদের নাতিদীর্ঘ কেশের আদিযুগ থেকে জটাধারী, নেড়া, সীমিতকেশ, শিখাধারী ইত্যাদি নানাবিধ অধ্যায় পেরিয়ে এসে বর্ত্তমানে বয়কাট-এ থিতু হচ্ছে। অর্থাৎ কিনা আদিতেও নরনারীর কেশ নাতিদীর্ঘ, অন্তিমে এখনও নাতিদীর্ঘ হতে চলেছে। মাঝের যুগগুলিতে তার নানাবিধ অন্যতর আচরণ।

মাথার উপরে চুল থাকা না-থাকা বিষয়ে সমাজমনে নানাবিধ ধারণা বিদ্যমান। এই কিছুদিন আগেও আমরা দেখেছি, কেউ কোনও নিন্দনীয় সামাজিক অপরাধ করলে তাকে নেড়া করে মাথায় ঘোল ঢেলে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হত। সবাই জানে, নেড়া-নেড়ী কথাটা অত্যন্ত অবজ্ঞাসূচক। তবে কারও কারও কাছে নেড়া হওয়া খুবই গৌরবের বিষয়। উপনয়নে বা শ্রাদ্ধে নেড়া হওয়া একটি পবিত্র ধর্ম্মাচরণ। বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি গৌরবের। জটাধারিগণ জটার মাহাত্ম্যে বিহ্বল বটে, কিন্তু অন্যেরা তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখে থাকেন। অবশ্য মেয়েদের দীর্ঘ কেশ সর্ব্বদাই গৌরবজনক বলে মনে করা হয়েছে। ভারতের গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের মাথায় চুল না-থাকার কথা ভাবাই যায় না। নেড়ী মেয়ের বিয়ে হওয়া প্রায় অসম্ভব। শহরাঞ্চলে এবং শিক্ষিত শ্রেণীর মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়কাট গ্রহণযোগ্য হলেও, নেড়ী মেয়ে এখনও নিন্দনীয়। সাধারণভাবে যে মেয়ের চুল যত লম্বা, বিয়ের বাজারে তার তত কদর। বিপরীতে যার চুল যত ছোট, তার কদর তত কম।

মেয়েদের চুলের ব্যাপারে সমাজমনের মানসিকতা ধরা আছে প্রচলিত প্রবাদগুলিতেও। সেগুলিতে চুলের পবিত্রতা ও সতর্কতার নানারকম ইশারা পাওয়া যায়। যেমন মেয়েরা এলোচুলে থাকলে পিশাচী ধরে; মেয়েদের চুলে পুরুষরা হাত দিলে শাপগ্রস্ত হয় … ইত্যাদি। ওদিকে ছেলেদের চুলের ছাঁট কিন্তু বারংবার বদলেছে। জটাধারী থেকে নেড়া, নেড়া থেকে বাবরি, বাবরি থেকে আধুনিক বয়কাট। প্রতি যুগের জ্যাঠামশাইরা এই ছাঁটান্তরে-যাত্রাকে ‘ফ্যাশান’ বলে, ‘বাবুগিরি’ বলে, নিন্দা করেছেন। এ যুগে যেমন ‘পনি-টেল্’-এর বেলায়ও ঘটেছে। বেচারা কপিলদেব শেষমেষ তাঁর সাধের পনিটেল বিসর্জ্জন দিয়েছেন। চীন দেশেও, বিশাল টিকি ত্যাগ করে ছেলেরা যখন বয়কাট গ্রহণ করছিল, তাদের প্রাচীনপন্থীরা খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন। একই ঘটনা ঘটে আরব্য সংস্কৃতির দাড়ি ছেঁটে ফেলার আধুনিকতায়।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলিতেও চুল দাড়ি গোঁফ নিয়ে নানারকম আচরণ দেখা যায়। তবে এখন যে প্রবণতা প্রায় সকল দেশের অগ্রণী শ্রেণীগুলির মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তা হল ছেলে ও মেয়ে উভয়ের ‘বয়কাট’ কেশচর্চ্চা। মালটি-ন্যাশনাল এগজিকিউটিভদের, প্রায় সবাইকে, শুধুমাত্র মুখটুকু দেখে শনাক্ত করা কঠিন। ছেলে না মেয়ে বোঝাই যায় না। সম্ভবত এঁরাই আমাদের ছেলেমেয়েদের ‘রোল মডেল’। … তা সে যাই হোক, আজকের ভারতসমাজের মানসিকতা অনুসারে, সাধারণভাবে মেয়েদের দীর্ঘকেশ এবং ছেলেদের সীমিত কেশ বাঞ্ছনীয়। তবে শহরাঞ্চলে, শিক্ষিত শ্রেণীর মেয়েদের মধ্যে ‘বয়কাট’ ক্রমশ বেশী বেশী গ্রহণীয় হয়ে উঠছে। সমাজের এই মানসিকতা ব্যক্তিমানুষের ইচ্ছার যোগফল। আর ব্যক্তিমানবের ও ব্যক্তিমানবীর সেই ইচ্ছাকে বহুদূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রকৃতি। সেই নিয়ন্ত্রণের স্বরূপ কেমন, এবার আমরা সেই গূঢ় রহস্য অনুধাবনে ব্রতী হব।

তিন

‘নেড়ার নেই বাটপাড়ের ভয়’ – এটি একটি বাংলা প্রবচন। এই প্রবচন থেকে আমরা জানতে পারি, যে মানুষের মাথায় চুল নেই তার কোনো সম্পদের মালিকানা নেই। তাই তার বাটপাড়ের ভয়ও নেই। অর্থাৎ কিনা, কেশহীন হওয়া মানেই সম্পদের মালিকানাহীন হওয়া। সেইজন্য ‘নিকেশ’ করে দেওয়ার অর্থ হল দুরকম : দৃশ্যত দৈহিকভাবে মানুষকে কেশহীন করে দেওয়া এবং মানসিকভাবে তাকে মালিকানাহীন করে দেওয়া; তার সকল সম্পদের মালিকানা কেড়ে নেওয়া। অর্থাৎ কিনা, মালিকানাহীন হওয়ার বাইরের চিহ্ণ হল দৈহিকভাবে চুলহীন হওয়া। তার মানে, মানুষ মানসিক-কেশ খোয়ালে দৈহিক কেশও হারাবে; কিংবা দৈহিক-কেশ না থাকলে মানসিক-কেশও থাকবে না। সম্পদের মালিকানার সঙ্গে মানুষের মাথার চুলের এইরকম গভীর গূঢ় সম্পর্ক। 

প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতকারগণ, যাঁরা তৎকালে ভাষাকে সংস্কার করে সংস্কৃত ভাষা বানিয়েছিলেন, তাঁরা ব্যাপারটি জেনে গিয়েছিলেন। যেহেতু তাঁরা কাজ করছিলেন বহুরৈখিক ( ডায়নামিক ও ভেরিয়েবল ) যৌগিক শব্দ নিয়ে, ‘কেশ’ শব্দের ভিতর সব ধরনের কেশকেই তাঁরা অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এ যুগের ভাষাতাত্ত্বিকেরা তাঁদের সেই ভাষাপদ্ধতি বিষয়ে যথেষ্ট অবহিত নন। বাংলাভাষায় ঐ পদ্ধতি কৃত্তিবাস কাশীরাম পর্য্যন্ত জীবন্ত থাকলেও পাশ্চাত্য প্রভাবের চাপে আজকের বাংলাভাষার বিশেষজ্ঞরাও ব্যাপারগুলি দুঃখজনকভাবে বিস্মৃত হয়েছেন। অথচ ‘ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি’র সাহায্যে ‘কেশ’ শব্দের ও তার প্রতিশব্দগুলির ভিতরে স্থাপিত ধারণাগুলির যাথার্থ্য অনুধাবন করলে ঐ বিষয়ের বিস্তারিত সংবাদ ও প্রমাণাদি পাওয়া যেতে পারে। কেবল তাই নয়, সংস্কৃত শব্দের বিদেশ ভ্রমণ ও যস্মিন দেশে যদাচার গ্রহণের ইতিহাস থেকেও বহু তথ্য পাওয়া যায়। এখানে আমরা সেই শব্দতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহের দু’চারটির পরিচয় দিয়ে আমাদের মূল বিষয়ে ফিরে যাব।

'কেশ' শব্দের একটি প্রতিশব্দ হল 'কচ'। যেখানে মানুষের 'কচ'-হরণ বা মালিকানা-হরণ করা হত, এককালে সেই স্থানকে বলা হত ‘কচ-হরি’। বিহারে ঐ ‘কচ-হরি’ শব্দটি এখনও অবিকল ঐভাবেই উচ্চারিত হয়; আর বাংলায় ঐ শব্দটিই ‘কাচারি’ শব্দের জন্ম দিয়েছে। সেই কাচারি-বাড়িগুলিতে মানুষের সঙ্গে কী ব্যবহার করা হত, সে কথা সবাই জানেন। সম্পদের মালিকানা নিয়ে টানাটানি করা বা ঝগড়া করাকে বলা হত ‘কচকচি’। তাই 'কচকচি', 'চুলোচুলি' ও 'কেশাকেশি' প্রায় সমার্থবাচক শব্দ। এই শব্দগুলি কেবলমাত্র দৈহিক চুল টানাটানিকেই বোঝাত না, মানসিক চুল বা মালিকানা নিয়ে টানাটানিকেও বোঝাত। ‘কেশাকর্ষণ’ কথাটির মানেই ছিল অন্যের মালিকানা ধরে টান মারা, তা সে দ্রৌপদীর কিংবা সীতা যারই কেশাকর্ষণ করা হোক না কেন। 

ঐ ‘কেশ যার দ্বারা বাহিত হয়’ সেই ‘কেশব’কে সবাই নগদ-নারায়ণ নামে সহজেই চিনতে পারেন। ‘কৃষ্ণ’ শব্দের একটি অর্থ তাই ‘ছলপূর্বক লব্ধ ধন’১ বা কালো টাকা – ব্ল্যাকমানি। মার্ক্স সাহেব এই প্রাচীন ভারতীয় ধারণার নাগাল পেয়ে গিয়ে ঘোষণা করেন – ‘বিষ্ণু, দ্য ক্যাপিটালিষ্ট’২। 

‘কেশর’ শব্দের গৌরবগাথা সবাই ব্যক্তিজীবনে অনুভব করে থাকবেন। মাস্তানি করা বা হিংসা করা যাদের পেশা, প্রাচীন ভারতে তাদেরকে ক্ষত্রিয় বলা হত, ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুসারে, তাই, ‘যে হিংসা করে’ তাকে সিংহ বলে এবং সিংহের 'কেশর' থাকে। এককালে তাই ক্ষত্রিয়েরা বা মাস্তানেরা ‘সিংহ’ উপাধি গ্রহণ করত। এখন, এই পোষ্টমডার্ণ যুগে কাউকে সিংহ বললে তার ভাল লাগবে কি না, বলা শক্ত। হাজার হোক, ব্যাপারটি পশুসুলভ। তবে প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্য্যন্ত, মানুষ নিজেকে সিংহ ভেবে, ‘লায়ন্স ক্লাব’-এর সদস্য ভেবে, গৌরবান্বিত বোধ করেছে। ‘সিংহ-আসনে’ উঠে বসতে খুব কম মানুষেরই অনাগ্রহ দেখা যায়। সিংহ আবার দু-রকম – আইনসঙ্গত ও বেআইনি। ব্রিটিশ সিংহ যাদেরকে বেআইনি ঘোষণা করেছিল, স্বাধীনতা লাভের পর তারাই সিংহাসনে বসে যায় ও অন্যদেরকে বেআইনি উগ্রপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী ইত্যাদি নামে চিহ্ণিত করে। তবে আইনী সিংহই হোক আর বেআইনী সিংহই হোক, সব সিংহেরই ‘কেশর’ থাকে। মাস্তানি করেই তারা ‘কেশরী’ হয়ে যায়। সেই কেশরের ক্ষমতা দেখতে পাওয়া যায় সিংহ যখন 'কেশর' ফোলায়। যাঁরা জীবনে অন্তত একবারও ধনী প্রতিপত্তিশালীর কোপে পড়েছেন, তাঁরা জেনেছেন, 'কেশর' ফোলানো কী জিনিস। 

… ঐ ‘কেশ’ শব্দই বিদেশে গিয়ে যে সকল অনাবাসী ভারতীয় উত্তরসূরীর জন্ম দেয়, অন্য দেশের জল-হাওয়ায় বড় হয়ে তাদের স্বভাব চরিত্রে পোশাক-আশাকের বিস্তর বদল ঘটে যায়; case ও cash যাদের অন্যতম। যাঁরা ঐ ‘কেশ’ নিয়ে কাজ কারবার করেন, স্বভাবতই তাদের দুটি শ্রেণী। দৈহিক কেশ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদেরকে নাপিত বলে এবং মানসিক-কেশ নিয়ে যাঁরা কাজ কারবার করেন তাঁদেরকে আইনজ্ঞ বা উকিল বলে। নিজে উকিল ছিলেন বলেই মহাত্মা গান্ধী এই রহস্য জেনে গিয়েছিলেন। তাই তিনি ঘোষণা করেছিলেন: ‘নাপিত ও উকিলের সমান বেতন হওয়া উচিত।’৩

আদিম যৌথসমাজ ভেঙে পড়ার পর থেকে অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠার সূত্রপাতের কাল থেকে সমাজে সম্পদের মালিকানা নিয়ে যত রকম বাদ-বিসম্বাদ ঘটেছে, সে সবেরই ছায়া পড়েছে মানুষের দৈহিক কেশচর্চ্চার ইতিহাসে। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে চিকুর, কুন্তল, জটা, শিখা, মুণ্ডন, অলক, চুল, কেশর, লোম প্রভৃতি শব্দার্থবিধির ভিতরে প্রবেশ করলে সেই সকল ইতিহাসের বিস্তারিত তথ্য আমরা জানতে পারি। লেখজীবী ও থিসিস-লিখিয়েদের জন্য এ এক নতুন উন্মুক্ত প্রান্তর। এখানে বিচরণ করলে অনায়াসে দশ-বিশ খানি গ্রন্থ লিখে ফেলা যায়। বেণী শব্দটির কথাই ধরা যাক। একটু আঁচালেই জানা যায় – মেয়েদের বেণী বাঁধার চল হয়েছিল সমাজে বেনিয়াবৃত্তি শুরু হওয়ার পর থেকে। মালিকানা এলোমেলো রাখা ঠিক নয় বলেই এলোকেশের উপর অত বিধিনিষেধ।

মালিকানার সংরক্ষণ ও বিন্যাস যেমন যেমন বিকশিত হয়েছে, দৈহিক কেশবিন্যাসের তেমন তেমন বিকাশ ঘটেছে। অ্যাটর্ণীদের অফিসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিকাশ ঘটেছে ‘হেয়ার ড্রেসার’ নাপিতের সেলুনের। ট্যাক্স-রিসিটের নিরাপত্তার সমান্তরালে বিকশিত হয়েছে অ্যান্টিসেপটিক-লোশনের নিরাপত্তা। ‘বেণীমাধব’ হতে হলে এইসব মান্য করে ‘প্রয়াগ’-এ অবস্থান করতে হয়; কারণ ‘প্রয়াগ’ হল সেই স্থান যেখানে ‘প্রকৃষ্ট উৎপাদন কর্মযজ্ঞ চলে যেখানে’। [ অবশ্য মালিকানা সংরক্ষণ ও গোপন করার আর এক উপায় টুপি, পাগড়ী প্রভৃতি শিরস্ত্রাণ। মালিকানার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঐগুলির আবিষ্কার ও বিকাশের মাধ্যমে জ্ঞানগোপন ও ধনগোপন যুগপৎ চলতে থাকে। তবে সে বিষয় বারান্তরে। ]

তবে বিষয়টি সবচেয়ে ভালভাবে বোঝা যায় ‘টাক’-এর দৌলতে। মালিকানা বিলোপের ঐ দৈহিক প্রকাশকে প্রাচীন ভারত শনাক্ত করেছিল ‘ইন্দ্রলুপ্ত’ বলে। কেন যে টাককে ইন্দ্রলুপ্ত বলে, সে কথা প্রচলিত প্রতীকী শব্দার্থবিধিতে বোঝা অসম্ভব। ইন্দ্র শব্দের প্রতীকী অর্থ ইন্দ্রকে ভুল বুঝতে সাহায্য করে। তখন আর ঐ অর্থকে ইন্দ্রলুপ্ত শব্দের সঙ্গে মেলানো যায় না। প্রশ্ন ওঠে, তাই তো – ইন্দ্র নামক বীর লুপ্ত হয়ে গেলে টাক বোঝাবে কেন? … আসলে এটি একটি রোগ, ব্যাধি। মানুষ যখন নিজেই ঠিক করে, সে কোনো বিকাশশীল কাজ করবে না, নিকৃষ্টতম জীবন কাটাবে, হীনতার মধ্যেই যখন সে গৌরব দেখে, তখন সে ইন্দ্রলুপ্ত বা টাক-রোগে আক্রান্ত হয়। 

ভারতে এবং চীনে এককালে এইরকম ধর্ম্মতত্ত্ব ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল, যার মর্ম্মার্থ – ‘Life, not from engagement but from withdrawal’।৪ কর্ম্মজগৎ থেকে তখন মানুষ ক্রমশ নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে থাকে। নতুন নতুন উৎপাদন, নতুন ম্যানুফ্যাকচারিং, ইণ্ডাষ্ট্রি – এসব ক্রমশ রুগ্ন হতে হতে লুপ্ত হয়ে যায়। ব্যক্তিজীবনে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হলে এইরকম প্রতিক্রিয়া ঘটে, তার সৃষ্টিশীলতা স্তব্ধ হয়ে যায় এবং দিনগত পাপক্ষয় করে বাকী জীবনটা কাটায় সে। তাই মানবদেহে ইন্দ্রলুপ্ত রোগ যেন সমাজদেহে ইণ্ডাষ্ট্রিলুপ্ত     ( ইন্দ্রস্ত্রীলুপ্ত ) রোগেরই ছায়া মাত্র। অর্থাৎ সমাজদেহে ইন্দ্রত্ব (ইন্দ্ = প্রভুত্ব করা) করার ইচ্ছা না থাকলে যেমন ইণ্ডাষ্ট্রির অস্তিত্ব লোপ পায়, মানবদেহে ইন্দ্রত্ব করার ইচ্ছা না থাকলে তেমনি ইন্দ্রলুপ্ত হয়, আর কেশ-মালিকানা জন্মায় না। 

৭০০ খ্রীষ্টাব্দে ভারতে সমুদ্রযাত্রা নিষেধ এবং চীনে বারুদ আবিষ্কৃত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তার উৎপাদন ও ব্যবহারের উপর কঠোর নিষেধ হীনতাকেই গৌরব ভাববার সেই সামাজিক মানসিকতারই প্রমাণ। যার ফলে সৃজনশীলতা স্তব্ধ হয়ে যায়, বিকাশ শ্লথ হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে জীবনের রৌদ্রতপ্ত কঠোরতা থেকে বাঁচার একটি মাত্র উপায় খোলা থাকে – পরচুলা পর। তাই তখন বিদেশী শিল্পপতির (বা ইণ্ডাষ্ট্রিওয়ালাদের বা ইন্দ্রস্ত্রীওয়ালার) ইণ্ডাষ্ট্রিকে উপর থেকে মাথায় চাপিয়ে নেয় সমাজ। রাজনীতিবিদগণ তখন তাকে সাম্রাজ্যবাদ বলে চিহ্ণিত করেন। …

যাই হোক, সম্পদের মালিকানার সঙ্গে মানুষের মাথায় কেশোদ্গম ও কেশচর্চ্চার যে একটা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে, সে বিষয়ে আজ আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারি। এই সম্বন্ধকে সমাজ প্রকৃতি যুগপৎ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ঠিক কীভাবে প্রকৃতি ঐ নিয়ন্ত্রণ খাটায়, সে বিষয়ে আমরা বিশেষ কিছুই জানি না। অর্থাৎ কীভাবে প্রকৃতি মানুষকে তার সম্পদের মালিকানাবোধের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে কেশচর্চ্চায় প্ররোচিত করে, সে বিষয়ে প্রামাণ্য কোনো তত্ত্ব আমাদের হাতে এখনও আসেনি। হয়তো জিনতত্ত্ব একদিন এ রহস্য উন্মোচন করবে। কেননা আমাদের প্রায় পঞ্চাশ হাজার জিনের মধ্যে কেবলমাত্র হাজার পাঁচেক জিনের স্বভাব-চরিত্র ও কর্ম্মকুশলতা বিষয়ে এখন পর্য্যন্ত আমরা জানতে পেরেছি। 

অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এমন কোনো জিনের পরিচয় পাওয়া যাবে, যে, মানুষের মানসিক-কেশ ও শারীরিক-কেশ যুগপৎ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কেবলমাত্র তখনই আমরা জানতে পারব, গোষ্ঠীসাম্যে স্থিত কোনো কোনো উপজাতীয় মানুষদের কখনোই দীর্ঘ কেশোৎপত্তি হয় না কেন; আমাদের বঙ্গদেশে ‘খোঁপাচুলওয়ালা’ মানুষদের ক্ষেত্রে যেমন হতে দেখা যায়। বলে রাখা যাক, ঐ ‘খোঁপাচুল’ একপ্রকার অত্যন্ত কোঁকড়ানো চুল, মাথার প্রায় মাঝামাঝি স্থান থেকে শুরু, পেছনে প্রায় খাড়া হয়ে ফুলে থাকে এবং কখনোই সুদীর্ঘ ও ‘নিম্নগামিনী’ হয় না। ঐ জিনের পরিচয় পাওয়া গেলে হয়তো তখনই আমরা জানতে পারব কেন সম্পদের মালিকানার বিপর্য্যয় ঘটে গেলেও কেশোদ্গমের রীতি বংশানুক্রমিক হয়ে থাকে এবং সম্পদহীন হয়ে গেলেই মানুষ লুপ্তকেশ হয়ে যায় না কেন? 

সর্ব্বোপরি, যন্ত্রযুগের দারুণ প্রকোপে মানুষ যখন ‘maximally distanced from nature’৫ হয়ে যায় তখন ঐ জিন ‘latent’ হয়ে যায় কি না; যে কারণে এযুগের অতি ধনীদের সুদীর্ঘ কেশ রাখতে দেখা যায় না, জানা যাবে কেনই বা তেমন ঘটে। … মোট কথা, সাধারণভাবে সম্পদের মালিকানার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রকৃতি মানুষকে কেশচর্চ্চা করতে প্ররোচিত করে থাকে, এমন কথায় বিশ্বাস করলে দেখা যায়, মানুষের সম্পদের মালিকানার ইতিহাস এবং মানুষের কেশচর্চ্চার ইতিহাস সাধারণভাবে আগাগোড়া সমান্তরাল এবং গুণগত বিচারে সমধর্ম্মী। উভয় ইতিহাসকে পরস্পরের সঙ্গে মেলালে ঐ সমধর্ম্মিতা আমরা সু্স্পষ্টভাবে দেখতে পাই।


চার

আদিম সাম্যবাদী এশীয় সমাজের শেষ যুগে আমরা নারীকে দেখি দীর্ঘ কেশ রাখতে। তার আগে সম্ভবত নারী পুরুষের সমান দৈর্ঘ্যের কেশ ছিল এবং তারা কেশচর্চ্চা করত হরিণের সিং চর্চ্চার মতো, সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতি বা ইন্‌ষ্টিঙ্কট্‌-তাড়িত হয়ে। আদৌ তাকে কেশচর্চ্চা বলা যায় কি না সন্দেহ। নারী দীর্ঘকেশ দিয়েই কেশচর্চ্চার প্রকৃত ইতিহাসের সূত্রপাত। তখনও সমাজ ছিল যৌথ এবং যৌথ উৎপন্নকে সকলের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হত; আর যে-যা ভাগে পেত সেটাই ছিল তার ‘ভাগ্য’। 

তবে মেয়েরাই ‘ভাগ্যবান’ ছিলেন, কেননা সমাজটা তখনও পর্য্যন্ত মাতৃতান্ত্রিক ছিল এবং পুরুষদের মনে করা হত কোন না কোন নারীর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত সদস্যরূপে। স্বগোত্রে যৌন সম্পর্ক ছিল না। গোত্রান্তর্ভুক্ত মেয়েরা সবাই ছিল ‘উৎপাদনের উপায়’ (= ভগ)-সমূহের মালিক অর্থাৎ ‘ভগিনী’। তাই তাদেরই গৃহকর্ত্রী রূপে ‘ভাগ্যবান’ হবার অধিকার ছিল। সেই কারণে ভারতের কয়েকটি প্রদেশে আজও নারীকে ‘ভাগ্যবান’ বলে সম্বোধন করবার প্রথা প্রচলিত রয়েছে, বিশেষত গৃহকর্ত্রীদের। ‘ভাগ্যবান’ হওয়ার কারণে নারীই আদি সুকেশিনী। সামাজিক সম্পদের উপর তখন কেবলমাত্র তারই মালিকানা স্বীকৃত। নারীর সেই ভাগ্যবান হওয়ার অধিকারে হাত দেওয়া আর তার চুলে হাত দেওয়া একই ব্যাপার ছিল সেকালে। যে তা করার চেষ্টা করত, তার উপর নেমে আসত সমাজের ভর্ৎসনা, কোপ, শাপ। 

সেই স্মৃতি সমাজ আজও তার প্রবাদ-প্রবচনের মাধ্যমে বহন করে নিয়ে চলেছে বলেই এখনও আমরা শুনতে পাই : মেয়েদের চুলে হাত দিলে পুরুষ শাপগ্রস্ত হয়। যদিও আজ আর তা সত্যিই হয় না। তবে হত, অন্তত সমাজটা যতদিন মাতৃতান্ত্রিক ছিল, ততদিন কেউ তেমন চেষ্টা করলে তার কী বিড়ম্বনা হত সেকথা যেমন আসামের কামরূপ অঞ্চলে এখনও বর্ত্তমান আধা-মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ঘটনাবলী থেকে জানতে পারি, তেমনি কিছুটা জানতে পারি 'দীর্ঘতমা' ঋষিকে বেঁধে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনা থেকেও। তাছাড়া, একথা সুবিদিত যে, প্রচলিত সমাজবিধি লঙ্ঘন করলে সমাজ তাকে ছেড়ে কথা বলে না, তা সে যে সমাজেই হোক। তাই, মাতৃতান্ত্রিক সমাজও তার সমাজবিধি লঙ্ঘন করলে শাস্তি দিত। তেমন পরিস্থিতির সূত্রপাত হয় প্রায় আজ থেকে বারো হাজার বছর আগে, যখন কৃষিকাজ আবিষ্কার করে নারী ‘ভাগ্যবান’ হয়ে গিয়েছিল। 

আজ আমরা যাকে সমাজ, সামাজিক নিয়ম, বিধিনিষেধ বলি, সে পরিস্থিতি আদৌ তেমন নয়। বরং অনেকটা পশুযূথের মতো, পশুযূথের নিয়ম ও বিধিনিষেধের মতো, মানুষ তখনও সিদ্ধান্ত নেয় মূলত ইনষ্টিঙ্কট্-পরিচালিত হয়ে। সেই অবস্থাতে সেই যৌথসমাজেই নারীর ঐরূপ মালিকানা ও কেশচর্চ্চার সূত্রপাত। পরবর্ত্তী প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে অপ্রতিহতভাবে চলেছে নারীর সেই দীর্ঘ মালিকানা ও দীর্ঘকেশের অভ্যাস। তারপর একদিন গৃহকর্ত্রীকে গৃহকর্ত্রীর আসনে বসিয়ে রেখেই তার মালিকানার অধিকার আত্মসাৎ করে গৃহকর্ত্তা হয়ে উঠল পুরুষ; যেভাবে জাপান ও ইংল্যাণ্ডে রাজার ক্ষমতা হরণ করে পার্লামেণ্ট। 

রাজার ঠাট-বাট যেমন বজায় থেকে গেছে, তেমনি নারীর গৃহকর্ত্রীসুলভ ঠাট-বাট বজায় থাকল এবং স্বাভাবিকভাবেই তার দীর্ঘকেশের অভ্যাসও যথারীতি বহাল থেকে গেল, প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মালিকানা হারিয়েও। কিন্তু ঐ দীর্ঘকেশ যে মালিকানার সঙ্গে যুক্ত, পুরুষ নিজে তা প্রমাণ করল কিছুদিনের মধ্যে স্বয়ং জটাধারী হয়ে। তবে ততদিনে সেই মাতৃতান্ত্রিক যৌথসমাজ ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে শুরু করেছে, ব্যক্তিমালিকানার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে এবং স্বভাবতই সবাই ধনী হতে পারেনি বলে সবাই জটাধারী পুরুষে পরিণত হতে পারেনি। তাই সব নারী দীর্ঘকেশিনী হলেও সব পুরুষ জটাধারী হয়নি।

কিন্তু যৌথ সামাজিক উৎপাদন ও বণ্টনে এতকাল ধরে অভ্যস্ত সমাজ ঐ সকল জটাধারীদের প্রাদুর্ভাব ভাল বলে মেনে নিতে পারেনি। একদিন অতএব বেজে ওঠে রুদ্রের রণডঙ্কা, আবির্ভূত হয় ব্রাহ্মণ, শিব (=‘শিখা বহন করে যে’)-রূপে। সকল জটাধারীদের 'নিকেশ' করে তাদের সমস্ত মালিকানা কেড়ে নিয়ে পূর্ব্বতন সাম্য পুনরায় ঘোষণা করে ব্রাহ্মণ এবং নিজেও মস্তক মুণ্ডন করে নিয়ে জ্ঞানের অগ্নিশিখাটুকু প্রজ্জ্বলিত রাখেন। [ আদি ব্রাহ্মণ যে এক বৈপ্লবিক কারণে শিখা ধারণ করেছিল, সেকথা অনেকেই খেয়াল করেন না, জানেন না টিকিই ছিল আদি বিপ্লবীর চিহ্ণ ]। কিছু জটাধারী পালায়, হয়তো মেসোপটেমিয়ায়, মিশরে বা অন্যত্র। গড়ে তোলে পিরামিড সভ্যতা। 

তাই বলে ভারতীয় উপমহাদেশে বা শিবঠাকুরের এই দেশে, শিবঠাকুরের ঐ রাজত্ব খুব বেশী দিন দীর্ঘজীবী হয়নি। কয়েকশ' বছর কাটতে না কাটতে শিখাধারী ব্রাহ্মণ স্বয়ং কলুষিত হয়ে অধঃপতিত হয়ে যায়, গোপন ব্যক্তিমালিকানার প্রকোপে ঝাঁঝরা হয়ে যায় যৌথবণ্টন ব্যবস্থা। শুরু হয়ে যায় সনাতন সাম্যবাদীদের বিতাড়ন – ‘শিব পালাল মক্কায়’।৬ বিরোধীদের নিকেশ করা হয়। সর্ব্বস্ব কেড়ে নিয়ে নেড়া করে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। কখন কখন এবং কী কী প্রকারে ঐ বিতাড়ন প্রক্রিয়া চলে, তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে পুরাণাদিতে। শক, যবন, পহ্নব, কম্বোজ, কেরল, চীন, খশ, পর্শূ, মুণ্ডা, কৈবর্ত্ত, চণ্ডাল প্রভৃতি জাতিগুলির ইতিহাসের মধ্যেও সেই সেই ঘটনাবলীর কিছু কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। তার থেকে জানা যায়, ভারতসমাজ কোন-কোন জাতিকে মস্তকমুণ্ডন করতে বাধ্য করেছিল; কোন-কোন ‘সম্প্রদায়’কে দাড়ি-গোঁফ না-কামাতে বাধ্য করেছিল এবং কীভাবে সেই বাধ্যতামূলক আচরণ ক্রমে আচারে পরিণত হয় ও হাজার হাজার বছর ধরে বংশানুক্রমিকভাবে বাহিত হতে থাকে। 

অধঃপতিত নষ্ট ব্রাহ্মণের গড়ে তোলা ঐ পুরোহিততন্ত্রের নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে যারা দূর দেশে পালিয়েছিল কিংবা আশ্রয় নিয়েছিল দুর্গম গিরি অরণ্য মরুতে, তাদের মাথায় সেইজন্য ঐ নিপীড়ক সমাজের হাত পৌঁছতে পারেনি। সে কারণেই দূর পাশ্চাত্যের ও গহণ অরণ্য-পর্ব্ববতের আদিবাসী জাতিগুলির কেশচর্চ্চায় তেমন বিশেষ কোনো সামাজিক বিধিনিষেধ দেখতে পাওয়া যায় না।

মানুষের কেশচর্চ্চার উপর সমাজের এই মাতব্বরির যে কোনো বিরোধিতা হয়নি, তা নয়। হাজার হাজার বছর ধরে বারে বারে বিদ্রোহ হয়েছে। বিদ্রোহীরা কখনো সখনো বিজয়ী হলেও শেষ পর্য্যন্ত প্রতিবিপ্লবে পরাজিত হয়েছে। আর, প্রত্যেক পরাজয় ডেকে এনেছে নিদারুণ বিভীষিকা। পুরাণাদিতে সেই সকল বিভীষিকার বিস্তৃত বর্ণনা বিদ্যমান। এখানে অন্তত একটা উদাহরণ নেওয়া যাক – ‘…তদনন্তর তাহাদিগকে সংহার না করিয়া সগর তাহাদিগের ধর্ম্ম ও বেশ পরিবর্ত্তন করিয়া দিলেন। তাহাতে তদবধিই শকগণ অর্দ্ধমুণ্ডিত, যবন ও কম্বোজগণ মুণ্ডিতমুণ্ড, পারদগণ মুণ্ডকেশ এবং পহ্ণবগণ শ্মশ্রুধারী হইল। … তাহারা ম্লেচ্ছ নামে প্রসিদ্ধ হইল। …মহামনা 'সগর' এইরূপে শক যবন কম্বোজ পারদ পহ্ণব কোলসব্য মহিষ দার্ব্ব চোল কেরল খশ তুখার চীন মদ্র কিষ্কিন্ধক কৌন্তল বঙ্গ শাল্ব কোঙ্কণদিগকে পরাজিত করিয়া ধর্ম্ম ভ্রষ্ট করিয়াছিলেন।’৭ মনে রাখা ভাল, পুরোহিততন্ত্রের মতে সেই কারণে বঙ্গবাসী-বঙ্গভাষী মাত্রেই ‘ম্লেচ্ছ’।

এই পরিস্থিতির উপর সবচেয়ে জোরালো আঘাত হানে বৌদ্ধরা। ব্যক্তিমালিকানা সম্পূর্ণভাবে বিনাশ করে আদি ব্রাহ্মণদের মতোই তারা নিজেরা নেড়ামুণ্ডী হয়ে যায় এবং সারা ভারতবর্ষ জুড়ে 'ষোড়শ মহাজনপদ' প্রতিষ্ঠা করে। বহু নারীও ঐ সময় নিজ নিজ বেণীসংহার করে নেড়ী-সন্ন্যাসিনী হয়ে যান। সমাজ পরিচালকদের কারোরই তখন কোনো প্রকার মালিকানা নেই, কেশও নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ঐ সময় ব্রাহ্মণে-ক্ষত্রিয়ে-বৈশ্যে-শূদ্রে বিভেদ ‘প্রায় মিলাইয়া গিয়াছিল’।৮ তবে ভারতবর্ষের সেই রামরাজত্ব বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। শঙ্করাচার্য্যের নেতৃত্বে পুরোহিততন্ত্রের পুনর্জ্জন্ম হয়। বৌদ্ধরা বিতাড়িত হয় তান্ত্রিক প্রদেশগুলিতে, চীন জাপান কাম্বোডিয়ায়। দৈহিক কেশচর্চ্চা সকলের চোখে পড়ে যায় বলে এর পর থেকে পুরোহিত মানসিক কেশচর্চ্চা করতে থাকলেও আর দৈহিক কেশচর্চ্চা করেনি। পুরোহিতের সেই নবরূপের কেশচর্চ্চার ফলে ‘দেউল’ ক্রমান্বয়ে মানুষের সর্ব্বস্ব হরণ করে; ভারতসমাজের সমস্ত সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয় মন্দিরে, মন্দিরের গর্ভগৃহে। ভারতের মানুষ দেউল কর্ত্তৃক শোষিত হয়ে ‘দেউলিয়া’ হয়ে যায়।

এরপর সেই মন্দিরের কেন্দ্রীভূত সম্পদ লুঠ করবার জন্য লুঠেরার প্রয়োজন হল। এল পাঠান মোগল। ইসলাম তাদের সাম্যে দীক্ষিত করেছিল, সুদ গ্রহণে মানা করেছিল, কিন্তু ব্যবসা করতে মানা করেনি। কার্য্যত ব্রাহ্মণ যেভাবে কালক্রমে ক্ষমতা-সৌরভে কলুষিত হয়েছিল, ৭০০ খ্রীষ্টাব্দের ইসলাম ১২০০ খ্রীষ্টাব্দে পৌঁছে সেভাবেই অধঃপতিত হয়ে গেল এবং ফলত ইসলাম-ধর্ম্মবিরোধী স্বভাবে বা লুঠেরায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল আগন্তুক পাঠান-মোগলেরা। অবশ্য, ইতোপূর্ব্বে আদি মহাপ্লাবন কালে ও তৎপরবর্ত্তী অনেকানেক বিতাড়নকালে তাকেই তো বাধ্য করা হয়েছিল মস্তকমুণ্ডন করতে এবং শ্মশ্রুধারী হতে। এবার সে যখন নববলে বলীয়ান হয়ে ফিরে এল, সে তার দাড়িটাকেই লাগামছাড়া করে দিল। 

… এরপর এলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, শোনালেন সাম্যের বাণী, বললেন মস্তক মুণ্ডনের কথা। পুরোহিততন্ত্রের গুপ্ত কেশচর্চ্চার তীব্র বিরোধিতা করেছিল বলে যে অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গবাসীদেরকে পুরোহিততন্ত্র ‘ম্লেচ্ছ’ বলে ঘেন্না করত, তাঁরাই দলে দলে অনুসরণ করলেন শ্রীচৈতন্যকে; যেমন করে তাঁরা একদিন অনুসরণ করেছিলেন বুদ্ধকে। … এরপর এলেন রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নেচারোপ্যাথির প্রবক্তা, স্বাভাবিকতায় বিশ্বাসী, প্রাকৃতিক নিয়মকে তিনি কৃত্রিম নিয়মের ঊর্দ্ধে স্থান দিতেন। তাঁর জমিদারী ও অন্য আগমের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি তাঁর চুল দাড়ি গোঁফকে স্বাধীনতা দিলেন।

অপরদিকে গান্ধী শুরু করলেন ক্রমান্বয়ে নিঃস্ব হতে, বারংবার ক্ষুর প্রয়োগ করতে লাগলেন মাথায়। কিন্তু প্রকৃতিগত কারণে, মালিকানার উদ্ভবের মতো কেশোদ্গম হতে থাকলে তাকে মুণ্ডন করে তো আর থামানো যেতে পারে না। ভীষ্ম৯ থেকে গান্ধী পর্য্যন্ত সবাই সে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, মালিকানা ও কেশ, কামালেই বাড়তে থাকে।

পাঁচ 

মালিকানা নিয়ে একই সমস্যায় পড়েছিলেন সমাজতান্ত্রিকেরা। তাঁরা বহু দুঃখে শিখলেন, মাথা মুড়িয়ে দিলেই মানুষের ‘কেশ-কাচারি’ সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। তবে ঘটনাগুলি ঘটে প্রতীকী দিক থেকে।

ষোড়শ শতাব্দীতে আলোকপ্রাপ্তির দর্শন আসে সাম্য মুক্তি স্বাধীনতার বাণী নিয়ে, শত পুষ্প বিকশিত হবার দাবী নিয়ে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিকাশের তত্ত্ব নিয়ে, যন্ত্র যুগ নিয়ে। দার্শনিক সমাজতাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা প্রতিটি কাজের কারণ খুঁজতে লাগেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিকাশ ও যন্ত্রের বিকাশ তাঁদেরকে প্রকৃতি থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলে। ফলে মানসিক-কেশকাচারি নিয়ে তাঁরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং তার সঙ্গে যে দৈহিক কেশের সম্পর্ক রয়েছে তা আর তাঁদের চোখে পড়ে না। অবশ্য জনসাধারণের তেমন অস্বাভাবিকতা দেখা যায় না। মধ্যবিত্তের উদ্ভব হয় এবং তাঁরা সীমিত-কেশচর্চ্চার .........।  সাধারণত শুরু করেন। 

বেণীর তো সূত্রপাত হয়েছিল বেনিয়াবৃত্তির সূচনা থেকেই। ভারতে, বৌদ্ধযুগের শেষ দিকে যখন শ্রেষ্ঠীদের রমরমা, তখন মালিকানার যত প্যাঁচ সৃষ্টি হয়েছিল, খোঁপার, বিনুনির, কবরীবন্ধনের ততরকম প্যাঁচ-পয়জারের প্রচলন হয় শ্রেষ্ঠী-ঘরণীদের মধ্যে; খোঁপার নামকরণগুলির মাধ্যমে সে ইতিহাস আজও প্রবহমান রয়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্যে তেমন হল না। কোম্পানিগুলির মালিকানার প্যাঁচ-পয়জার, নানা প্রকার দলিলপত্র, কোম্পানি-ট্রাষ্টি ডিড, শেয়ারের বিধিনিষেধ ইত্যাদির ছায়া তেমনভাবে সেগুলির মালিকদের কেশচর্চ্চায় ছায়া ফেলল না। আলোকপ্রাপ্তির দর্শন তাকে স্বতন্ত্র হতে শেখাল, যা কিনা প্রকৃতপক্ষে তাকে করে তুলল মানসিকভাবে মধ্যবিত্ত। পুঁজিপতি, আমাদের পুরোহিতের মতোই, মানসিক-কেশচর্চ্চা চালাল চুটিয়ে; কিন্তু দৈহিক কেশচর্চ্চা করে নিজেকে জটাধারীতে পরিণত করল না। 

সেই সময়ে এলেন সমাজতান্ত্রিকেরা। তাঁরাও যেহেতু আলোকপ্রাপ্তির সন্তান, তাঁরাও কেবল মানসিক-কেশচর্চ্চা নিয়েই মাথা ঘামালেন। রাশিয়া চীন প্রভৃতি দেশগুলিতে মানুষকে মানসিক-নেড়া বানিয়ে তাঁরা সাম্য আনার চেষ্টা করে শেষমেষ ব্যর্থ হলেন। প্রত্যেক মানুষই অন্ততপক্ষে তার নিজের দেহ ও মাথাটার মালিক। ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের এই যুগে ঐ মালিকানাটারও একটা মূল্য আছে। দুইখানি বিশ্বযুদ্ধ পার হয়ে সে কথাটা কখন জানি স্বীকৃতি পেয়ে গেল যে, নেড়া নয় জটাধারীও নয়, সীমিত-কেশ-সম্বল-মাথাওয়ালা মানুষদের নিয়েই মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। সব মানুষকে নেড়া করে নেড়া-মানুষের সাম্য হবে না, সব মানুষকে জটাধারী করে জটাধারী মানুষদের সাম্যও প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।

কিন্তু সারা পৃথিবী তো আর রাতারাতি মধ্যবিত্ত হয়ে যাবে না, পৃথিবীর সব নরনারী রাতারাতি সবাই ‘বয়কাট’ কেশচর্চ্চাশুরু করে দেবে, এমনও নয়। তারও একটা ক্রমপদ্ধতি থাকতে হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, অর্থাৎ মানসিক-জটাধারী ও মানসিক-নেড়াদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর আবির্ভূত হল ভূতুড়ে-পুঁজি। আর সেই ভূতুড়ে-পুঁজির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলল উদ্ভট কেশচর্চ্চা – হিপি থেকে পনিটেল পর্য্যন্ত। কিন্তু ঐ ভয়ানক যুদ্ধের প্রকৃত সন্তান আত্মপ্রকাশ করল ধীরে ধীরে এবং দৃঢ় পদক্ষেপে – কর্পোরেট ক্যাপিটাল। সাম্রাজ্যবাদের পিছু পিছু যেমন আলোকপ্রাপ্তির আহ্বান এসেছিল, এর পেছনে আসছে একাকারের ডাক। মানুষের পছন্দ করবার অধিকারকে মর্য্যাদা দিলে সে সীমিত-কেশ ছাড়া অন্য কোনো প্রকার কেশচর্চ্চা পছন্দ করে না। নেড়া মাথার যন্ত্রণার চেয়ে জটাধারীর জ্বালা বড় কম নয়। বিশ্ব জুড়ে তাই মধ্যবিত্ত সৃষ্টির ধূম পড়ে গেছে। দারিদ্র্যসীমার নীচে যে বাস করে, তাকে তুলে আনতে সবাই উঠে পড়ে লেগেছে। সবাই এগোচ্ছে ঐ দিকেই, মানুষের আদি ও আদর্শ কেশচর্চ্চার দিকে, সীমিত মানসিক-কেশচর্চ্চার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলবে সীমিত দৈহিক-কেশচর্চ্চা। এতে দেহ মন দুটোই সুরক্ষা ও শান্তি পায়। তবে সমাজের সেই বাসনা শেষমেষ কোনদিকে পৌঁছবে, আমরা জানি না।

বিগত দশকগুলিতে বিশ্ব জুড়ে নারীবাদী আন্দোলনগুলি ‘আধুনিক’ নারীকে একথা বুঝে নিতে প্ররোচিত করেছে যে, এবার তার আর ঠাট-বাটের প্রয়োজন নেই। পুরুষের মতো সেও এখন কর্মজগতে সরাসরি নিজের উপস্থিতি জাহির করছে। মালিকানার ব্যাপারে সেও এখন সমান অংশীদার। আইনের কচকচি সম্বলিত বিশাল দলিল নয়, পঞ্চাশ রকমের আইনী কাগজপত্র নয়, কেবল একখানা নিয়োগপত্র যদি মালিকানার কেশ হয়, তবে মাথার উপর মিথ্যে বোঝা আর থাকে কেন? কিরণ বেদীরা তাই আগামী যুগের আদর্শ। ‘ভাগ্যবান’-এর মিথ্যে বোঝা মাথায় করে বয়ে বেড়ানোর আর কোনো সার্থকতা নেই। হাজার হাজার বছরের ঐ বিরক্তিকর, ক্লান্তিকর ও অমর্য্যাদাকর দায় থেকে এবার মেয়েদের নিষ্কৃতি হোক। ঢের হয়েছে, আর নয়।

যুগ আসছে যখন মানুষে-মানুষে নর-নারীতে অর্থহীন-সাম্য নয়, অর্থময়-সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। হয়তো সেজন্যেই কারও কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই শরদ যাদব ও কিরণ বেদীদের ঘাড়ের উপরটা ক্রমশ দেখতে একরকম হয়ে যাচ্ছে। তাই কিরণ বেদীদেরকে দীর্ঘকেশিনী হয়ে থাকবার দাবিটা শরদ যাদবদের এইবার ছাড়তেই হবে। কেননা ঘাড়ের উপরটুকু দেখে উভয়কে সমমর্য্যাদা সম্পন্ন মনে হলে সেটা উভয়ের পক্ষেই সম্মানজনক। অন্তত মাথায়-মাথায় সাম্য প্রতিষ্ঠা হোক, যেটা মানুষের ও সমাজের এক্তিয়ারে। যে অসাম্য প্রকৃতির অধিকারে, সেটা প্রকৃতির হাতে ছেড়ে রাখাই ভাল।

সবশেষে বলে রাখা যাক, আমরা কেউ চাই বা না চাই, আগামী যুগের মেয়েরা হয়তো বা বেণীসংহার করে ফেলবেন, ছেলেদের মতোই মেয়েরাও বয়কাট, স্লিককাট, ব্লান্ট, রিভার্সব্লান্ট ইত্যাদি নানাবিধ ‘সীমিত-কেশচর্চ্চা’-য় বেশী বেশী করে লিপ্ত হবেন, তা তেল শ্যাম্পুর ব্যবসায়ীরা তাদের যতই উল্টো ফুসমন্তর দিক। কেননা, সমাজ ও প্রকৃতি তাঁদেরকে সেদিকে যেতেই প্ররোচিত করছে বলে মনে হয়। 

টীকা :

১। দ্রষ্টব্য : হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’।

২। Capital, Vol 1. Page 560, Progress Publisher, 1977

৩। ‘আমার ধ্যানের ভারত’ – গান্ধী।

৪, ‘… Society could not be improved by group action, but by individual withdrawal’ – Lao-tzu / from ‘100 Great Thinkers’.

৫। Val Plumwood রচিত ‘Woman, Humanity and Nature’ নিবন্ধ থেকে বাক্যাংশটি উদ্ধৃত হল।

৬। এটি একটি প্রচলিত বাংলা প্রবাদ।

৭। হরিবংশপুরাণে এই প্রকার বিস্তারিত বর্ণনা বিদ্যমান। অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থেও এ বিষয়ের কমবেশী বিবরণ রয়েছে।

৮। ‘ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা’ – রবীন্দ্রনাথ।

৯। ভীষ্ম কীভাবে Recapitalization বন্ধ করার সঙ্গে যুক্ত, সে কাহিনী জানা যায় ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে। এখানে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া গেল না।

(নিবন্ধটি ১৯৯৮-এর ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার দধীচি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ