উচ্চ শিক্ষায় পড়ুয়া বেড়েও পিছিয়ে, ২৭তম পশ্চিমবঙ্গ


-: সাপ্তাহিক আলোচনার টেবিল :- 
                                           ====================================
 "উচ্চ শিক্ষায় পড়ুয়া বেড়েও পিছিয়ে, ২৭তম পশ্চিমবঙ্গ "......  এইসময়, ০৯/০১/২০১৮

"পরিসংখ্যানেও প্রকাশ, গত ছ’বছরে পশ্চিমবঙ্গে উচ্চশিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের নথিভুক্তকরণ (গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও বা জিইআর) ৬ শতাংশ বেড়েছে৷ তাতে কী! এখনও যে তা জাতীয় গড়ের (২৫.২ শতাংশ) চেয়ে ঢের কম, বেরিয়ে এল সত্যিটা৷ ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে এ রাজ্যের ঠাঁই খুবই নীচের দিকে, ২৭তম স্থানে৷ পশ্চিমবঙ্গের (১৮.৫ শতাংশ) পরে আছে শুধু বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসম ছাড়া নাগাল্যাণ্ডের মতো ছোট রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল৷"

"রাজ্য উচ্চশিক্ষা সংসদের প্রাক্তন ভাইস চেয়ারম্যান পবিত্র সরকারের বক্তব্য, ‘এই ধরনের পরিসংখ্যান অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে৷ উত্তরপ্রদেশে আমাদের চেয়ে জনসংখ্যা বেশি৷ উচ্চমাধ্যমিক বা সমতুল পরীক্ষায় পাশের হারও বেশি৷ ফলে স্নাতকে ভর্তিও বেশি৷ আবার কেরালায় স্বাক্ষরতার হার অন্য সব রাজ্যের চেয়ে বেশি৷’ প্রাক্তন উচ্চশিক্ষামন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরীর আবার পর্যবেক্ষণ, ‘প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা থেকে যাচ্ছে৷ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হালও তথৈবচ৷ সেই সঙ্গে নিত্যদিন কলেজে-কলেজে অশান্তি৷ তা ছাড়া নতুন শিল্প ও কলকারখানা কোথায় ? উচ্চশিক্ষার পর অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা না থাকায় পড়ুয়ারা ভিন্ রাজ্যে চলে যাচ্ছেন৷ সে জন্যই উচ্চশিক্ষায় জিইআর কমছে৷"

রাণা : আমার মনে হয়, পশ্চিবঙ্গের মানুষ মানসিকতায় অনেক উন্নত। মূল্যবোধ ও প্রগতিশীল যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তাও অনেক বেশি। তাই উচ্চশিক্ষা ও কাজে বাইরেও তারা নাম করে। তবে এটা স্বীকার করতেই হয়, নতুন নতুন স্কুল কলেজের মান অত্যন্ত নিচু। ডিসিপ্লিন ও নেই,  পবিত্র সরকারের কথা সঠিক।

সুমিত্রা : পশ্চিমবঙ্গের মানুষ উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে নেই। বাঙালিদের শিক্ষার প্রতি চাহিদা অন্য অনেক রাজ্যের থেকে বেশি। দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে। আমাদেরই ছেলে মেয়েরা হায়দ্রাবাদ চেন্নাই গিয়ে ওখানকার infrastructure , seriousness দেখে মুগ্ধ। এমনকি উড়িষ্যতেও!

রাণা : মহারাষ্ট্রের পুণে বা নাগপুরের কলেজগুলো দেখলে মনে হয় আরো একবার পড়াশোনা শুরু করি!

সুমিত্রা : সত্যি। কত নতুন subject, research lab world standard এর,  আমারো ইচ্ছা করে। আমাদের কোথাও একটা কমতি আছেই। দেখনদারী আর সংখ্যা দিয়ে কী হবে, seriousness না থাকলে।

রাণা : আমাদের এখানে আমরা সেই মুখস্ত করার যুগে পড়ে ছিলাম। যত বড় লিখতে পারব তত বেশি মার্কস জুটবে। শিক্ষাকে যা রাজনীতি মুক্তের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তারই বা বাস্তবায়ন হল কই।  

সুমিত্রা : সেটাই মনে হয় মূল কারণ নিম্নমানের। গুণের বা প্রতিভার কদর নেই।

অরিন্দম : ১। ছাত্র-ছাত্রীরা রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হোক, কিন্তু বাংলায় দলীয় রাজনীতির খবরদারির প্রভাব ভয়ঙ্কর খারাপ। নিজে সক্রিয় ভাবে ছাত্র রাজনীতি করেছি। দেখেছি এর পেছনে থাকে বিশাল দুর্নীতির প্রলোভন। বহু কলেজের প্রিন্সিপাল, প্রফেসর এর বিরোধিতা করার সাহস পায় না, শাসক দলের কৃপাধন্য থাকার জন্য।

রাণা : সাউথে দেখেছি কর্পোরেট কায়দায় কলেজগুলো চলে। শিক্ষায় বেসরকারিকরণের জন্য এমন সম্ভব হয়েছে। শিক্ষায় ব্যাপক বেসরকারিকরণ কি সমর্থনযোগ্য?

অরিন্দম : ২। কলেজের সিলেবাস এর কোনো মাথামুন্ডু নেই। এমন সিলেবাস বানানো হয়, যা একজন ছাত্র/ছাত্রী টিউটোরিয়ালে না গিয়ে শেষ করতে পারে না। তাহলে মাইনে করে এত প্রফেসর রাখার কি দরকার?

সুমিত্রা : একটাই ভয়, ব্যবসার খাতিরে fees অনেক সময় খুব বেশি হয়ে যায়। তবে loan এর সুযোগ থাকে বোধহয়। --- এটা রানার উত্তর,  আমার current syllabus সম্পর্কে জানা নেই।

অরিন্দম : ৩। দক্ষিণ ভারতে বিশেষ করে কর্ণাটকে প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছড়াছড়ি। বিশাল ক্যাপিটেশন ফিস দিয়ে ভর্তি হতে হয়।

সুমিত্রা : সঠিক ডাক্তারের মত, সঠিক কলেজ চিনে নেওয়া একটা আর্ট।

রাণা : ঠিক। সব জায়গায় ঠকে যাওয়ার ভয়।

অরিন্দম : ৪। এই যে এতো আই আই টি। কিন্তু, প্রায় সমস্ত টেকনোলজি বিদেশ থেকে আমদানি। ব্রেন-ড্রেন!!! কারণ, সেই পরিকাঠামোর অভাব।

সুমিত্রা : অনেকেই ৭-৮ লাখ খরচ করে ভুলভাল জায়গায় ভর্তি হয়ে........  চাকরীর জন্য ঘুরচ্ছে!

অরিন্দম : ৫। মেধার অভাব নেই। কিন্তু, সেই মেধাকে তো যত্ন করতে হবে। অনেক ডিগ্রি নিয়ে রিলায়েন্সের মতন কোম্পানিতে চাকরি। মাস গেলে মোটা টাকার মাইনে। ব্যাস!!!

রাণা : কেন শিক্ষার দরকার সেই বোধটা বোধ হয় হারিয়ে ফেলেছি। শিক্ষা মানে অর্থের আগমণ না জ্ঞানের আগমন সেই সংজ্ঞা ভুলে গেছি। শিক্ষা নিয়ে আমাদের মননও গোলকধাঁধায়য় চরকি কাটছে!

অরিন্দম : এই নিয়ে 'থ্রি ইডিয়টস' সিনেমাটা, গোটা শিক্ষাব্যবস্থার ঘাড়টা ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়েছিলো। যদি শুধু চাকরির কথাও ভাবি, কোথায় পাবে এত ছেলেমেয়ে চাকরি???

অনাবিল : পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষায় একটা দিক দেখা যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে নারী পুরুষ রেশিও তে নারীরা অনেক এগিয়েছে। এবং সংখ্যার দিক থেকেও অনেক এগিয়ে চলে।  মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতকস্তরে এখন নারীর সংখ্যাই বেশী। শুধু সংখ্যায় নয় মানেও এগিয়ে চলছে। সেখানে ছেলেদের গতি নিন্মে।  গ্রামীণ বাংলার উচ্চশিক্ষা এখন মেয়েদের দখলে। ছেলেরা উচ্চমাধ্যমিকেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। পিছনে অবশ্যই গ্রামীণ বাংলার অনিশ্চিত জীবনযাপন।

রাণা : তবে কি এটা হতে পারে যে মেয়েরা সরকারি স্কুলমুখী, আর ছেলেরা রোজগেরে হবে ভেবে বেশি খরচা করে বেসরকারি স্কুল বা কলেজে পড়ছে। এতেই কি পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডের ক্ষেত্রে এইরকম পার্থক্যগুলো আসছে। 

অনাবিল : কিছুটা ঠিক। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় পশ্চিমবঙ্গে মেয়েরা বেশী যাচ্ছে।  সঙ্গে একটা বিরাট অঙ্কের ছেলেরা গ্রাজুয়েশনের আগে বা পরে গজিয়ে উঠা চাকারী পাইয়ে দেবার সেন্টার গুলোতে চলে যাচ্ছে।  যেমন রাইস, জাইস, জর্জ ইত্যাদি।  যেগুলো কোন রকম সরকারি পরিসংখ্যানে আসছে না।  এদের ফিও কিন্তু আকাশছোঁয়া এবং চলছে প্যারালাল ভাবে বেসরকারি কলেজ বা ইউনিভার্সিটির মতো। একটা সময় পর্যন্ত (২০০৫ সাল)  পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির    মারপ্যাচে পড়ে কাহিল হয়েছিল। তারপরে চাপে না অন্যকিছুরর উত্তাপে বেসরকারি শিক্ষার আস্বাদন পায় বাংলার মানুষ। পরিসংখ্যান বলছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প:ব:-এ অনেক কম। যেহেতু পরে এসেছে তাই এদের মানও অন্যান্য রাজ্যের কাছে পৌচ্ছায়নি।  কিন্তু  পারিপাশ্বিক পরিবেষ্টন (রাজনৈতিক সহ) কাঙ্ক্ষিত মানে পৌছতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অরিন্দম : হয়ত এই আলোচনায় একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। তবুও, একটা বিশেষ পেশার সাথে যুক্ত থাকা এবং সরকারি/ বেসরকারি সংস্থায় 'কাজ' করার খানিকটা অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি-এখানে কাজের চেয়ে বেশি চাকরি তৈরি হয়। এটাই হয়ে এসেছে। ফলে বিপুল মেধার অপচয় যার সাথে শিক্ষা গভীরভাবে সম্পর্কিত।

অনাবিল : এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললে হয় না।  সেটা প্রথাগত  শিক্ষা এখন চাকরী পাওয়ার জায়গায় দাঁড়িয়েছে।  তাই সেটা গজিয়ে উঠা ওইসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো করছে আরো ভালো করে সেখানেই ভিড়, যারা ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট দেয়না। দেয় চাকরী পাওয়ার যোগসূত্র। কিন্তু এই দুইয়ে মেল বন্ধন করে বাইরের রাজ্যের প্রথাগত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো। তাই ওখানে উচ্চশিক্ষায় এই ডপ আউট অনেক কম।  এই রাজ্যে তা বেসরকারি প্রথাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোও এই পরিসেবা দিতে অপারগ। সেই ইংরাজ বণিকদল এর নীতি এখনো বর্তমান!  কেরানী গড়ার শিক্ষা। রবীন্দ্রনাথ যে শিক্ষার কথা বলেগেছে।  তা আমাদের পাঠ্যবই এ রয়েগেছে,  আজকাল শিক্ষা আর উৎকোচ সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।  এটি বলার কারণ টাকাই আমার আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা তৈরি করে দিচ্ছে।

অরিন্দম : ঠিক তাই। তাই বোধহয় সায়েন্স শুধুই একটা সাবজেক্ট, দৈনন্দিন জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই তার কোনো প্রতিফলন নেই।

অনাবিল : এই আলোচনা শুরু তে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে।  প:ব: এর শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থানের কারণ উপরের প্রতিটি আলোচনা থেকে পাওয়া যাবে আশাকরি।

রাণা : ভারতে মনে এইসব ব্যবসার মূল পুঁজি ভয়। ধর্ম বেঁচে আছে এই ভয়কে পুঁজি করে। হাসপাতালগুলো এই ভয়ের ব্যবসা করে। যত বেশি খরচা করবেন আপনি তত নিরাপদ। সরকারি হাসপাতাল মানেই মৃত্যু নিশ্চিত। এমন ভয় ঢোকানো হয়েছে ধীরে ধীরে। তাই লোকে ঘটি-বাটি বেচে বাইপাসের ধারের হাসপাতালে ভিড় করে। শিক্ষাতেও সেই ভয়কে পুঁজি করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো রমরম করে বিজনেস করছে। আপনার ছেলে বা মেয়ে কিন্তু ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে পড়বে কিন্তু - ব্যস ভয় পেয়ে ছুটলেন কোন দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে। এখানে যুক্তি নেই, ভয় আছে। কেউ পরখ করে দেখে না, কেন ঐ প্রতিষ্ঠানে যাব। পাশের বাড়ির অমুকের ছেলে যাচ্ছে তো আমাকেও যেতে হবে।

সুমিত্রা : একদম.....  মধ্যবিত্তরা ভয়ের দ্বারাই চালিত হয়..... অবশ্য বুদ্ধি থাকলে এতো বোকাবোকা ভয় পাবে না।  

অনাবিল : একদম সহমত,  এইসব মৌলিক চাহিদা গুলোতে চিকিৎসা, শিক্ষা, আইনি পরিসেবাতে ভয়ের চাদরে চেপে দুর্নীতির পাহাড় তৈরি হচ্ছে।

অরিন্দম : আর একটা সমস্যা... অনেক ছেলে-মেয়ে সাবজেক্ট বাছছে, 'ভালো চাকরি' পাবে বলে। তাদের ওই সাবজেক্ট এর ওপর এমনিতে কোনো আগ্রহ নেই। তাই অনেকে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ইত্যাদি হয় 'বাই ডিফল্ট', 'বাই চয়েস' নয়।

রাণা: তবুও পরিসংখ্যান বাদ দিয়েও বলতে পারি গড় ভারতের তুলনায় শিক্ষার চাহিদা পশ্চিমবঙ্গে খানিকটা বেশি।

অনাবিল : সমস্যার শেষ নেই,  প:ব: তথাকথিত  ভালো ছাত্রছাত্রীরা সরকারি পরীক্ষা মাধ্যমে স্কুলকলেজ এর শিক্ষক হচ্ছেন। তারাই স্কুলকলেজ এ না পড়িয়ে (বা দরকার পড়ে না) প্রাইভেট শুধুই নোট দিয়ে যাচ্ছে।  এরাই প্রাইভেট স্কুলকলেজ এর সামনে লাইন দিচ্ছেন,  এইসব স্কুলকলেজ এর শিক্ষকদের শিক্ষকতা যোগ্যতা নিয়ে এরাই প্রশ্ন তোলে।  আজব শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তার মান!  আমরা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বর্তমান সময় এমএ পাশ ছেলে মেয়েরা নিজেরা যে চাকরীর পরীক্ষায় বসছে তার ফর্মই নিজেরা ফিলাপ করতে পারেনা। সাধারণ জ্ঞানের মান খুবই নিন্মে পৌচেছে।  পরীক্ষায় বমি করেই এমে অবধি টেনে দিয়েছে!!!  সংখ্যার সাথে মানের হার ক্রমেই নিন্মগামী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ