মিচিও কাকুর ঈশ্বর দর্শনের বিভ্রাট ও আমাদের ঈশ্বর।। বিপ্লব সৎপতি


এর আগে দু'টি সংখ্যায় লিখেছিলাম 'আইনস্টাইন' ও 'হকিং'এর ঈশ্বর বিশ্বাস নিয়ে। সেখানে লিখেছিলাম, "কোনো বিজ্ঞানী ব্যক্তিগত ভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কি না, এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হওয়ার কথা ছিলো না। যে বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন, সেই বিষয়ের উপর কতটা যুক্তি প্রমান দিতে পারছেন, সেটাই আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বর্তমান পেক্ষাপটে বিজ্ঞানের ক্রম-বর্ধমান উন্নতির সাথে সাথে 'সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কিত ধর্মীয় তত্ত্বগুলির' দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকায় ধর্মীয় ব্যবসায়ীদের কাছে 'বিষয়'টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । বিজ্ঞানীরা তার প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী, এটা দেখাতে পারলেই যেন পায়ের নীচে মাটি খুঁজে পায়। "
জাপানী বংশোদ্ভূত  মিচিও কাকু একজন আমেরিকান পদার্থ বিজ্ঞানী। তিনি সিটি কলেজ অব নিউ ইয়র্কের একজন হেনরি সিম্যাট অধ্যাপক, একজন ভবিষ্যতদ্রষ্টা, বিজ্ঞান প্রচারনাকারী এবং জনপ্রিয়কারী । তিনি বিজ্ঞান এবং তদসংশ্লিষ্ট বেশ কিছু বই রচনা করেছেন।মহাবিশ্বেরগঠন সম্পর্কিত 'স্ট্রিং তত্ত্বের' সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
তাহলে দেখা যাচ্ছে 'মিচিও কাকু'র নাম মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক ছাত্রছাত্রীদের শোনার কথা নয়, সাধারন মানুষদের না হয় বাদেই দিলাম। কিন্তু ধর্মীয় ব্যবসায়ীদের হাত ধরে 'মিচিও কাকু'র নাম এখন, যারা টুকটাক বাইরের খবর রাখেন, প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে গেছে। তবে তার গবেষণারর জন্য নয়, একজন ধর্মবিশ্বাসী বিজ্ঞানী হিসেবে।ধর্মীয়  বিশ্বাসের পক্ষে এমন একজন বিজ্ঞানীকে পেয়ে রীতিমতো উল্লসিত তার পাশাপাশি বেশকিছু ঈশ্বরে অবিশ্বাসীরা ঘটনাটি চেপে যেতে চাইছে যাতে বিশ্বাসে চিঁড় না ধরে। 
এমন অবস্থায় আমার লেখার উদ্দেশ্য হল, মিচিও কাকু'র ইশ্বর কী আমাদের ইশ্বরের মতো? না অন্য কিছু?
প্রথমে একাজ করা হয় 'খ্রীস্টান টুডে' নামক একটি ওয়েব পোর্টালে, সেখানে দাবী করা হয়, 'মিচিও কাকু বলেছেন এই মহাবিশ্ব 'ঈশ্বর' নামক কোনো এক ম্যাথমেটিশিয়ানের তৈরী। এরপরেই বিভিন্ন বাংলা 'ওয়েব পোর্টালে ' ও দু-একটি প্রিন্ট মিডিয়ার শুরুহয় দড়ি টানাটানি।
কোথায় হেডিং হচ্ছে, "মিচিও কাকু দেখা পেলেন ইশ্বরের। "
আবার কোথাও,"অবশেষে মিচিও কাকু'র হাত ধরে প্রমাণিত হল,যে ঈশ্বর আছেন।"
একজায়গায় দেখলাম, " নাস্তিকদের মুখে ঝাঁমা ঘষে মিচিও কাকু প্রমাণ করলেন ঈশ্বরের অস্তিত্য। "
যে বক্ত্যবের খণ্ডাংশ নিয়ে এত আলোড়ন, সেই বক্তব্যের ক্ষুরধার বিশ্লেষণ করেছেন অনেকেই। তবে সমস্যাটা হচ্ছে এই বিশ্লেষণ বিপক্ষে গেলে কেওই তা মানতে চান না, তাই সে সমস্যার সমাধানকল্পে এগিয়ে হলেন খোদ মিচিও কাকু নিজেই। ২৭শে মার্চ ও ১৬জুন পর পর দু'বার  প্রকাশিত এক্সক্লুসিভ সাক্ষাতকারে পরিষ্কার করলেন তার অবস্থান। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পল ফ্রেঞ্চ। আসুন দেখি কী বলেছেন তিনি,

"I&T Today: সাম্প্রতিক সময়ে আপনি অনেকগুলো খবরের শিরোনাম হয়েছেন, যেখানে দাবী করা হয়েছে আপনি এমন কিছু পেয়েছেন, যার ফলে উচ্চ মাত্রার বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। আপনি ঠিক কী পেয়েছেন, তা কী ব্যাখ্যা করবেন?
মিচিও কাকু: কিছু ওয়েবসাইট আমার কথার ভুল ব্যাখ্যা করেছে। জনসমাজের অংশ হওয়ার একটা অসুবিধা আছে, আর তা হলো: মানুষ কখনো কখনো তোমাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করবে। তাদের একাজটি করার কারণ হিসেবে আমি অনুমান করতে পারি, যখন কোনো ব্যক্তি সাধারণ জনতার আকর্ষণের কেন্দ্রে আসে, তখন দেখা যায়, মানুষ তাকে, তার কথাকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করে।সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, আমি বলেছি, ঈশ্বর আছেন তা তুমি প্রমাণ করতে পারো কিন্তু আমার দৃষ্টিকোণ ভিন্ন ছিল। এই বিষয়ে আমার বক্তব্য ছিল, ঈশ্বর আছেন তা যেমন তুমি প্রমাণ করতে পারবে না, ঈশ্বর নেই, তাও তুমি প্রমাণ করতে পারবে না।
যা পরীক্ষণযোগ্য, পুন:উৎপাদনযোগ্য এবং যা মিথ্যা প্রমাণ করা যায়, এই তিন ভিত্তির উপরেই দাড়িয়ে রয়েছে বিজ্ঞান। কিন্তু এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা মিথ্যা প্রমাণ করা যায় না, পরীক্ষা করা যায় না,যেমন ঈশ্বর। "

এখানে দর্শন শাস্ত্রে Burden of Proof টার্ম'টি তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।  যার মর্মার্থ হল, যে কোনো উটকো দাবির যথার্থতা প্রমাণ করার দায়িত্ব দাবিদারের। আপনি যদি ভুতে বিশ্বাসী হন, ঈশ্বরে বিশ্বাসী হন, পূর্বজন্মে বিশ্বাসী হন, অ্যালিয়েনে বিশ্বাসী হন– তাহলে আপনাকেই এই সমস্ত বিষয়ের অস্তিত্বের যথার্তা প্রমাণ করতে হবে। যারা এগুলোতে বিশ্বাস করে না, তাদের দায়িত্ব নয় ‘অঙ্ক কষে’ আপনার দাবি ভুল প্রমাণ করা কিংবা নস্যাৎ করা। কার্ল স্যাগানের কথায়--
Extraordinary claims require extraordinary evidence.
অথাৎ আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলে তার প্রমাণ আপনাকেই করতে হবে।
এখন আসি নেতিবাচক অস্তিত্বের প্রস্তাবনার ব্যাপারে। যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন অথচ ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ চাইলেই উল্টে প্রতিপক্ষের কাঁধে দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে বলেন, ‘প্রমাণ করুন তো, ঈশ্বর বলে কিছু নেই’– তিনি আসলে নিজের অজান্তেই একটি যৌক্তিক ভ্রান্তিতে (logical fallacy) আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, দর্শনে যার একটি সম্ভ্রান্ত নাম আছে– Shifting the Burden of Proof, সহজ বাংলায় যাকে বলে ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানো। এই ভ্রান্তিটিকে দর্শনশাস্ত্রে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে–
The burden of proof is always on the person asserting something. Shifting the burden of proof is the fallacy of putting the burden of proof on the person who denies or questions the assertion. The source of the fallacy is the assumption that something is true unless proven otherwise.
[Ref: The Atheism Web, Logic & Fallacies] 
দর্শনশাস্ত্র আমাদের শেখাচ্ছে  যে, নেতিবাচক অস্তিত্বের প্রস্তাবনা (negative existential proposition) কখনওই প্রমাণযোগ্য নয়।

আবার ফিরে যাই মিচিও কাকু'র সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন,"ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আইনস্টাইনের যে ঈশ্বর তার মধ্যেই প্রজ্ঞা লুকিয়ে রয়েছে। আইনস্টাইনের কাছে ঈশ্বর মুলত দুই ধরনের ছিল। একটি ঈশ্বর হলো ব্যক্তি ঈশ্বর, যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, যে ঈশ্বর ফিলিস্তিনীদের উপর অত্যাচার নীরবে অবলোকন করেন। যে ঈশ্বর জলের উপরে হাটেন। এটা হচ্ছে প্রথম ঈশ্বর। কিন্তু আরো এক ঈশ্বর এর কথা তিনি ভাবতেন। আর তা হলো স্পিনোজীয় ঈশ্বর। যে ঈশ্বর অত্যন্ত সরল, যার মধ্যে সুর নিহীত, যার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে সৌন্দর্য।
এই মহাবিশ্ব অত্যন্ত চমৎকার। এই মহাবিশ্ব অনেক সাদামাটা(simple)। কিন্তু এই মহাবিশ্ব এমন নাও হতে পারত। এই মহাবিশ্ব হতে পারত বিশৃঙ্খল, হতে পারত নিকষ কালো, অন্ধকার। হতে পারত ইলেক্ট্রন-প্রোটনের কতগুলো বিশৃঙ্খল সমন্বয়। কোনো জীবন নেই, কোনো প্রাণ-প্রাচুর্য নাই। আকর্ষণ তৈরী হবে এমন কিছু নাই। শুধুমাত্র ইলেক্ট্রন-প্রোটনের কুয়াশাছন্ন এলোমেলো কিছু সমন্বয় মাত্র। মহাবিশ্ব এমনটাও হতে পারত, কিন্তু এমনটা হয় নি। আমাদের মহাবিশ্ব সমৃদ্ধ, সে সুন্দর, সে পরিচ্ছন্ন।"
অথাৎ 'আইনস্টাইন' মহাবিশ্বের সুশৃঙ্খলতা কে ঈশ্বর বলতে চেয়েছেন। তারেই অনুগামী মিচিও কাকু। এই ঈশ্বর রুপক মাত্র এটাকে আপনি প্রাকৃতিক নিয়ম বা রাম, শ্যাম, যদু, মধু যা খুশি নামে ডাকলেও এর নিয়ম পরিবর্তন হয় না('আইনস্টাইনের ঈশ্বর বিশ্বাস' নিয়ে আমার একটি লেখা আগের সংখ্যা নিয়ে পড়তে পারেন বা 'মুক্তমন ও মুক্তনয়নের' ফেসবুক পেজ দেখতে পারেন।)
যে সব ধর্ম ব্যবসায়ী ও শিক্ষিত ধার্মিক'রা উল্লসিত হচ্ছেন, তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন

★মিচিও কাকু'র ঈশ্বর কী 
আমাদের ঈশ্বরের মতো ৪২০০০ ধরনের নিয়ম তৈরী করেনআমাদের? ধর্ম পাল্টালে নিয়মও পাল্টান?
★মিচিও কাকু'র ঈশ্বর কী আমাদের ঈশ্বরের মতো লক্ষ-লক্ষ মন্দির,মসজিদ,চার্চ তৈরী করে পূজো, উপাষণা করতে বলে?খাবার ও পোষাকে ফোতোয়া দেন? 
★মিচিও কাকু'র ঈশ্বর কী আমাদের ঈশ্বরের মতো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে?বিপক্ষ মত সহ্য করতে পারেন না? 
★মিচিও কাকু'র ঈশ্বর কী আমাদের ঈশ্বরের মতো শতশত মানুষ মেরে নিজেকে সর্বশেষ্ঠ প্রমান করেন? রাম-বাবরি মসজিদ নিয়ে নোংরা রাজনীতি করেন?
তালিকা আর দীর্ঘ করলাম না। কী বলতে চেয়েছি আশাকরি বোঝাতে পেরেছি।
এরধুর পড়ে যদি আপনার মনে হয় সবনিয়ম ঈশ্বর নয় মানুষ করেছেন  তাহলে ধরে নেবো আমাদের ঈশ্বরের সবকটি গুনের আপনি উর্দ্ধে। 
এখন ব্যক্তি ঈশ্বর  মিচিও কাকু'র কাছে নিয়তঃ প্রার্থনা করতে হয় তাকে বাদ দিয়ে কেও যদি এমন ঈশ্বরের কথা ভাবে যিনি শুধুমাত্র সুর সঙ্গীত নিয়ে ভাবেন এবং তাকে যদি আস্তিক বলা হয়,(স্পিনোজীসমকে একসময় নাস্তিক্যবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হত) তাহলে আমাদের আর কীই বা বলার থাকতে পারে???


তথ্যসূত্র -  L&K Today, Muktamona blog, Michio Kaku website

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ