আমার ভারত,এ ভারত ভুখা ভারত ।। চিন্ময় মন্ডল


১৯৪৭ এর ১৫ আগস্ট দিনটা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে। আজ আমরা ৭১তম স্বাধীনতা দিবস পার করলাম। দেশ ও দশের স্বার্থে ভগৎ সিং-ক্ষুদিরাম-মাস্টারদা সূর্য সেন-এর মতো প্রমুখ সাম্যকামী ব্যক্তিরা দিয়েছিলেন জীবন আহুতি। আপোষহীন সংগ্রামে ব্রতী হয়েছিলেন এই সমস্ত নেতারা। প্রতি বছর এই ১৫ আগস্ট 'স্বাধীনতা দিবস' হিসেবে মহা সমারোহে পালিত হয়। দেশাত্ববোধক গানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। তবু নাগরিক(সংখ্যাগরিষ্ঠ) তুমি কি পেয়েছো মানুষের মর্যাদা? 
ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার পর ৭১টা বছর অতিবাহিত হল। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের সময় এসেছে মিলিয়ে দেখার যে বিদেশি শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার পর ভারত বিভিন্ন বিষয়ে কতটা এগোল!
সাংসদ বিধায়ক এরা হল জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এরা সরাসরিভাবে জনগনের কাছে দায়বদ্ধ। আর আইন তৈরী ও বিলোপের অধিকার সাংসদ বিধায়কদের হাতে। এইসব জনপ্রতিনিধি সংবিধানকে মর্যাদা দিতে দায়বদ্ধ। প্রত্যেক নাগরিকের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও সমবিচার পাওয়া, এ তাদের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু তারপরেও দেশের সবচেয়ে বেশি নাগরিকের কাছে এই অধিকার গুলোর প্রত্যেকটিই অধরা রয়ে গেছে। তাই স্বাধীনতার এত বছর পরেও দলিত-শোষিত মানুষ আজ দেশের সংখ্যাগুরু। মূলত এই সংখ্যাগুরু মানুষগুলো জানেই না বা জানতে দেওয়া হয় না তাদের অধিকার গুলো কি? জানেই না স্বাধীনতা খায় না মাথায় দেয়! জীবনের উদ্দেশ্যই হয়ে দাঁড়ায় বেঁচে থাকতে হয় বলে শুধু বেঁচে থাকা!
স্বাধীনতা সহ সমস্ত কিছুই অর্থহীন হতে বাধ্য যখন দেখি দেশে বছরে ২৫লক্ষ মানুষ শুধু না খেতে পেয়ে মারা যায়, প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার শিশু অনাহারে মরে, প্রতিদিন কুড়ি কোটি মানুষ রাত্রে কিছু না খেয়ে ঘুমোতে যায়, প্রতিদিন গড়ে প্রায় আঠারো জন কৃষক দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেন এবং ৭০ শতাংশ শিশু ও ৫৬ শতাংশ মা অপুষ্টির শিকার। ৭৫ শতাংশ মানুষের দৈনিক মাথাপিছু আয় রাষ্ট্রসংঘের নির্ধারিত দারিদ্রসীমার স্থিতিমাপকের চেয়েও কম।
এ দেশে খালি পেটে রোজ রাতে শুতে যাওয়া শিশুদের সংখ্যাটা গত তিন বছরে আরও বেড়েছে। বেড়েছে অপুষ্টি। স্রেফ খেতে না পেয়ে আরও বেশি শুকিয়ে যাওয়া কচি কচি মুখগুলোর সংখ্যাও বেড়েছে লাফিয়ে।
১১৯টি দেশের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে 'ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট' বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের (গ্লোবাল হাংগার ইনডেক্স বা জিএইচআই) এই ফল প্রকাশ করতেই প্রতিবারের ন্যায় এবারও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, এ দেশের ক্ষুধার প্রকৃত চেহারাটা। বাইরের চাকচিক্য, অচ্ছে দিনের ঢাকঢোল, উন্নয়নের গর্বিত প্রচার যে আসলে নেহাতই ফাঁপা, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এই আন্তর্জাতিক সমীক্ষায়।
২০১৪ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ৭৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ৫৫। ২০১৬-য় ১১৮টি দেশের মধ্যে তা নেমে আসে ৯৭-এ। আর এ বছর ১১৯টি দেশের মধ্যে নেমে এল ১০০য়! ব্রিকস-ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ভারতের স্থান সর্বনিম্ন। এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ,নেপালের মত প্রতিবেশী দেশ গুলি।
শিশুদের অপুষ্টি, বাড়বৃদ্ধি, শিশুমৃত্যুর পরিসংখ্যান-সহ একাধিক বিষয়ে সমীক্ষা চালিয়েই এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়। এ বারের রিপোর্টে দেখা গেছে, এ দেশের পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুদের প্রতি পাঁচ জনের এক জনের ওজন উচ্চতা সাপেক্ষে অত্যন্ত কম। প্রতি তিন জনের এক জন বয়স অনুপাতে খর্বকায়।
এদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় 'ক্ষুধা' ও 'অপুষ্টি' নামক মারণ ব্যাধিতে, ক্যান্সার-হার্ট অ্যাটাকে নয় । রক্তের রং লাল তার চেয়েও আরো গভীর লাল হল ক্ষুধার রং। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত থেকে যতই উঠে আসুক না কেন নিষ্পেষিতদের আর্তনাদ তারপরেও কিন্তু মজার ব্যাপার হল আমাদের দেশপ্রমিক সাংসদদের বেতন আর ভাতা পুরো দ্বিগুণ হয়েছে, এছাড়াও রয়েছে বিনামূল্যে ভ্রমন, চিকিৎসা, অত্যন্ত সুলভ মূল্যে এলাহি খাওয়া-দাওয়া, লালবাতি গাড়ি, নিরাপত্তারক্ষী সহ আরো অনেক সুবিধা। সবচাইতে মজার ব্যাপার হল এই সমস্ত সাংসদরা কোটিপতি হলেও নিজেদের সেলারী ছাড়া কোনো ক্ষেত্রে এক পয়সাও আয়কর দিতে হয় না! আর এই দেশেই দেনার দায়ে আত্মহত্যা করে হজারো কৃষক।কি অসম্ভব নির্লজ্জ আমাদের জনপ্রতিনিধিরা!
প্রিয় পাঠক পাঠিকা! ভাবতে পারছেন! পৃথিবীর যে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার দেশের সংখ্যাধিক্য ক্ষুধার্ত মানুষজনের খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না সেই সরকারই ২০.৩ ইউ এস বিলিয়ন ডলারের মালকিন নীতা আম্বানির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত ১১জন সশস্ত্র পুলিশ সহ 'Y' ক্যাটাগরির সিকিউরিটি প্রদান করে,২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে মূর্তি বানানোর জন্য,ঋণ খেলাপী দের কে ছাড় দেয়,আরোও কতই না নাচন-কুদন করে....।টাকাটা আসে কিন্তু আপনার-আমার কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকা থেকে
এতোগুলো বছর পরেও আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশের এগোনোর চেয়ে পেছনোর পরিসংখ্যানটাই 
প্রকট, তাহলে বিদেশি শোষণের চেয়ে দেশীয় আগ্রাসন যে বেশি সেটা কি আমরা বলতে পারি না?
বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী, দেশপ্রেম ইত্যাদি আজ ইমেজের হিসাবেই উপস্থাপিত হচ্ছে তাই তো পূর্বের আত্মত্যাগ এখন আবেগের খোরাক আর আদর্শ চাটনিতে পর্যবসিত হয়েছে।
প্রিয় পাঠক পাঠিকা, আসুন আমরা প্রশ্নহীন আনুগত্য ও হুজুগের আবর্জনাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ সহ নাগরীকের মৌলিক অধিকার গুলল বুঝতে সচেষ্ট হই।
অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয় বলেই বুঝতে
হবে যে- শাসক শ্রেণী শ্রেণী স্বার্থ বজায় রাখতে কিভাবে ধর্মকে কাজে লাগায়। শ্রেণী বিভাজনকে সাম্প্রদায়িক বিভাজন করে তুলে কেন? শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ম কেন প্রতিবন্ধক? কেন ধর্মকে আঘাত না করে শ্রেণীহীন সমাজ সম্ভব নয়? ধর্ম আর বিজ্ঞানের দ্বন্দ্বে দুটোই কি ভাবে শাসক শ্রেণীর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে? সভ্যতাকে শ্রেণীহীনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প কোনোও উপায় নেই আমাদের।
নচেৎএকশোটা স্বাধীনতা দিবস যত সাড়ম্বরেই পালিত হোক না কেন মিলবে না আমাদের বেঁচে থাকার নূন্যতম মৌলিক অধিকারগুলো, বেঁচে থাকার অর্থই হয়ে উঠবে বিলাসিতা, আর মিটবে না স্বাধীনতার পরেও ভারতের জ্বলন্ত সমস্যা॥

তথ্যসূত্র:- Front Line, উইকিপিডিয়া,GHI Report.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ