দুনিয়াজাত: সালমান রুশদী।। কাজী মাহবুব হাসান

Illustration by Boris Pelcer for The New Yorker

দুনিয়াজাত : সালমান রুশদী

“Wherever they burn books, in the end will also burn human beings.” – Heinrich Heine

(দ্য নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের জুন ১, ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত এই গল্পটি সালমান রুশদীর সাম্প্রতিক উপন্যাস, Two years eight months and twenty eight nights এর প্রথম অধ্যায়টি, যা The Duniyazat নামে প্রকাশিত হয়েছিল, এটি সেই অংশটির অনুবাদ প্রচেষ্টা- কাজী মাহবুব হাসান)

১১৯৫ খ্রিস্টাব্দে, মহান দার্শনিক ইব্ন রুশদ (১), সেভিয়ার (২) এক সময়কার বিচারক, আর খুব সাম্প্রতিক সময়ে তার নিজের জন্ম শহর কর্দোবায় (৩) খলিফা আবু ইয়ুসুফ ইয়াকুবের  (৪) ব্যক্তিগত চিকিৎসক, তাঁর উদারনীতিবাদী ধারণাগুলোর কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে নিন্দিত এবং অপমানিত হয়েছিলেন, ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকা বারবার (৫) ধর্মান্ধদের কাছে যে ধারণাগুলো অগ্রহনযোগ্য ছিল, আর যারা সেই সময় মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়েছিল আরব স্পেনে (৬)।

এবং তাঁকে অভ্যন্তরীণ নির্বাসনে বাস করার জন্য পাঠানো হয়েছিল লুসেনায় (৭) ছোট একটি গ্রামে। সেই গ্রামটি ছিল ইহুদী ঘণবসতিপূর্ণ একটি গ্রাম, যে গ্রামের ইহুদীরা আর কখনোই বলতে পারবেন না যে তারা ইহুদী ছিলেন, কারণ তাদের সবাইকে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করার জন্য বাধ্য করা হয়েছিল। ইবন রুশদ, একজন দার্শনিক, যার কিনা নিজের দর্শন ব্যাখ্যা ও প্রচার করার আর কোনো অনুমতি ছিল না, যার সব লেখাই নিষিদ্ধ আর সব পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল, তাৎক্ষনিকভাবেই বেশ স্বাচ্ছন্দ অনুভব করেছিলেন লুসেনার সেই ইহুদীদের সংস্পর্শে এসে, যে ইহুদীরা আর কখনো বলতে পারবে না যে তারা একসময় ইহুদী ছিলেন। বর্তমান শাসক রাজবংশ, আল-মোহাদ এর খলিফার একজন প্রিয় ভাজন ছিলেন তিনি, কিন্তু প্রিয়রা সব সময় প্রিয় থাকে না, এছাড়া খলিফা আবু ইউসুফ ইয়াকুবও ধর্মান্ধদের অনুমতি দিয়েছিলেন অ্যারিস্টোটলের এই মহান ভাষ্যকারকে তাঁর জন্ম শহর থেকে বিতাড়িত করতে।

দার্শনিক, যিনি তাঁর নিজের দর্শন নিয়ে আর কোনো কথা বলতে পারবেন না, পর্যাপ্ত আলোর অনুপস্থিতির কারণে সর্বক্ষণ ভয়ঙ্করভাবে নিপীড়িত হয়ে সেই গ্রামে বাস করতেন সংকীর্ণ, কাঁচা রাস্তার পাশে ছোট জানালাসহ খুব সাধারণ একটি বাড়িতে। লুসেনায় তিনি চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করেছিলেন, স্বয়ং খলিফার প্রাক্তন চিকিৎসক হিসাবে তাঁর পদমর্যাদা তাঁকে রোগী পেতে সহায়তাও করেছিল। উপরন্তু তাঁর যা সম্পদ ছিল সেটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন বেশ সতর্কভাবে ঘোড়ার বাণিজ্যে প্রবেশ করার জন্য, এছাড়া তিনি, ‘তিনাজা’, বিশালাকার সেই মাটির পাত্র, বানানোর জন্যেও অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন, যে মাটির পাত্রগুলোর মধ্যে ইহুদীরা, যারা আর ইহুদী ছিলেন না, তাদের বানানো জলপাই তেল আর মদ সংরক্ষণ ও বিক্রি করতো।

ইবন রুশদের নির্বাসন শুরু হবার অল্প কিছুদিন পরেই কোনো একদিন, একটি মেয়ে, হয়তো বয়সে ষোল বছর হবে, তার দরজায় এসে হাজির হয়েছিল, নম্রভাবে হেসে, দরজায় কোনো টোকা না দিয়ে বা তার চিন্তায় কোনোভাবে অনুপ্রবেশ না করে, এবং ধৈর্য্য ধরেই শুধু সে দাড়িয়েছিল, যতক্ষণ না অবধি তার উপস্থিতি সম্বন্ধে তিনি সচেতন এবং তাকে ভিতরে আসতে আমন্ত্রণ না জানান। মেয়েটি তাকে বলেছিল, কেবলই সে অনাথ হয়েছে, তার আয়ের কোনো উৎস নেই, কিন্তু বেশ্যালয়ে কাজ করার ইচ্ছাও তার নেই, আর তার নাম হচ্ছে ‘দুনিয়া’, নামটি শুনতে ইহুদী কোনো নামের মত শোনায়নি যদিও, কারণ তার ইহুদী নামটি উচ্চারণ করার কোনো অনুমতি ছিল না, আর যেহেতু সে অশিক্ষিত ছিল, সে নামটি লিখতেও পারেনি। মেয়েটি তাকে বলেছিল যে এক যাযাবর ভ্রমণকারী তাকে এই নামটি প্রস্তাব করেছিল,এবং বলেছিল এটি গ্রীক শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে ‘পৃথিবী’, এবং এই নামটির ধারণা তার বেশ ভালো লেগেছিল। ইবন রুশদ, অ্যারিস্টোটলের অনুবাদক, তার সাথে অযথা কোনো বিতর্কে জড়াননি, বহু সংখ্যক ভাষায় শব্দটির অর্থ যে ‘পৃথিবী’ সেটি যথেষ্ঠ ছিল এই পরিস্থিতিতে পণ্ডিতিপনা দেখানোর বিষয়টিকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলার জন্য। ‘তাহলে কেন তুমি তোমার নাম পৃথিবীর নামে রেখেছো?’ তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এবং মেয়েটি উত্তর দিয়েছিল, কথা বলার সময় তার চোখে চোখ রেখে, ‘কারণ একটি পৃথিবী আমার থেকেই প্রবাহিত হবে, আর যারা আমার থেকে বের হয়ে আসবে তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।’

যুক্তিবাদী মানুষ হবার কারণে, ইবন রুশদ কোনো অনুমান করেননি যে মেয়েটি আসলে অতিপ্রাকৃত একটি প্রাণি, একজন জিনিয়া, নারী জিনদের একটি গোত্র : আর সে ছিল সেই গোত্রেরই প্রধান রাজকুমারী, সার্বিকভাবে মানব পুরুষ সম্বন্ধে তার বিশেষ মুগ্ধতা অনুসরণ করতেই যিনি পৃথিবী অভিযানে এসেছিল, বিশেষ করে সেই সব মানব পুরুষ, যারা অত্যন্ত মেধাবী। ইবন রুশদ তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তার ঘরবাড়ি দেখাশোনা ও প্রেমিকা হিসাবে, এবং পরে কণ্ঠরুদ্ধ শব্দহীন এক রাতে মেয়েটি তার কানে কানে তার ‘সত্য’ – যার মানে হচ্ছে, ‘মিথ্যা’ – ইহুদী নামটি উচ্চারণ করেছিলো, এবং সেটি ছিল তাদের দুজনের একটি গোপন কথা।

দুনিয়া নামের এই জিনিয়া, তার ভবিষ্যদ্বাণী যেমন ইঙ্গিত দিয়েছিল, বিস্ময়কর মাত্রায় উর্বর ছিল। দুই বছর, আট মাস আর আঠাশ দিন ও রাত যা অতিক্রান্ত হয়েছিল তাদের দেখা হবার পর, দুনিয়া মোট তিনবার গর্ভবতী হয়েছিল, এবং বহু সংখ্যক শিশুর জন্ম দিয়েছিল, অন্ততপক্ষে সাতটি করে প্রতিটি গর্ভাবস্থায়, এবং একটি ক্ষেত্রে এগারো অথবা সম্ভবত উনিশটি । তবে এই বিষয়ে তথ্যগুলো অস্পষ্ট। সব শিশুই দুনিয়ার সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্যটি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল: তাদের কারোরই কানে লতি ছিল না।

যদি ইবন রুশদ রহস্যময় গুপ্তবিদ্যায় পণ্ডিত হতেন, তিনি হয়তো অনুধাবন করতে পারতেন, তার সন্তানরা মানুষ নয় এমন একটি মায়ের সন্তান, কিন্তু তিনি এতটাই আত্মমগ্ন ছিলেন যে বিষয়টি তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। দার্শনিক, যিনি আর দর্শন চর্চা করতে পারবেন না, শঙ্কিত হয়েছিলেন যে তাঁর সন্তানরা হয়তো তার কাছ থেকে সেই দুঃখের উপহারগুলোও উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে পারে, তাঁর জন্য যা ছিল একই সাথে সম্পদ আর অভিশাপ: ‘পাতলা-চামড়ার, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং লাগামহীন জিহবা’ হওয়া মানে তিনি বলেন, ‘খুব বেশী তীক্ষ্মভাবে সব কিছু অনুভব করতে পারার ক্ষমতা, খুব বেশী স্পষ্টভাবে সব কিছু দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা, খুব বেশী স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করার প্রবণতা। এর মানে এই পৃথিবীতে শত্রুদের কাছে নিজেকে আরো বেশী আক্রম্য করে তোলা, যখন পৃথিবী নিজেকেই অনাক্রাম্য বলে বিশ্বাস করে; পৃথিবীর পরিবর্তনশীলতাকে বোঝা, যখন এটি নিজেকে অপরিবর্তনযোগ্য ভাবে, অন্যরা অনুভব করার আগেই অনুভব করা ভবিষ্যতে কি ঘটতে যাচ্ছে, অনুধাবন করা যে বর্বর ভবিষ্যৎ বর্তমানের দরজাগুলো সব ভেঙ্গে ফেলছে, যখন কিনা অন্যরা অবক্ষয়ী ফাঁপা অতীত আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে। আমাদের সন্তানরা যদি ভাগ্যবান হয়, তাহলে তারা শুধু তোমার কানই উত্তরাধিকারসূত্রে পাবে, কিন্তু, দূঃখজনকভাবে, যেহেতু অনস্বীকার্যভাবে তারা আমারও, সম্ভবত তারা খুব শীঘ্রই খুব বেশী চিন্তা করতে শুরু করবে আর খুব আগেই তারা অনেক বেশী কিছু শুনবে, সেই সব কিছু সহ, যা চিন্তা করার অথবা শোনার কোনো অনুমতি নেই।’

‘আমাকে একটা গল্প বলো’, দুনিয়া প্রায়ই বিছানায় শুয়ে দাবী করতো তাদের সহবাসের সেই শুরুর দিনগুলোয়। ইবন রুশদ বেশ দ্রুত আবিষ্কার করেছিলেন যে আপাতদৃষ্টিতে বয়স কম মনে হলেও বিছানায় ও বিছানার বাইরে, দুনিয়া ছিল খুবই চাহিদাপূর্ণ ও জেদী, একরোখা স্বভাবের একজন নারী। ইবন রুশদ বেশ সুগঠিত, আকারে বিশাল পুরুষ ছিলেন, আর দুনিয়া ছিল ছোট পাখি অথবা কোনো কাঠি পোকার মত, কিন্তু প্রায়শই তিনি অনুভব করতেন যে তাদের দুজনের মধ্যে আসলে দুনিয়াই সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী।

বৃদ্ধ বয়সে দুনিয়া তাঁর সুখ ছিল ঠিকই, কিন্তু তাঁর কাছে দুনিয়া যে পর্যায়ের প্রাণশক্তি দাবী করতো সেটি অব্যহত রাখা তার পক্ষে খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। মাঝে মাঝে বিছানায় শুয়ে তিনি যা চাইতেন তা হলো শান্তিতে একটু ঘুমাতে, কিন্তু দুনিয়া তার এই ঘুমিয়ে পড়ার প্রচেষ্টাকে দেখতো শত্রুভাবাপন্ন একটি কাজ হিসাবে। ‘তুমি যদি সারারাত জেগে সঙ্গম করো’, সে বলতো, ‘তাহলে ষাড়ের মত বহু ঘন্টা নাক ঢেকে ঘুমালে যতটা বিশ্রাম নিয়েছো বলে অনুভব করতে, আসলেই তার চেয়ে অনেক বেশী বিশ্রাম নিয়েছো বলেই অনুভব করবে। আর সবারই বেশ ভালো করে জানা আছে এটা।’ তাঁর সেই বয়সে, যৌন সঙ্গমের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতিতে পৌছানো সবসময় সহজ কোনো বিষয় ছিলনা, বিশেষ করে পরপর রাতে। কিন্তু দুনিয়া তাঁর লিঙ্গোত্থানের এই বার্ধক্যজনিত সমস্যাকে দেখতো ইবন রুশদের ভালোবাসাহীন প্রকৃতির একটি প্রমাণ হিসাবে। ‘যদি কোনো নারীকে তুমি আসলেই আকর্ষণীয় মনে করো, তাহলে কখনোই সমস্যা হবার কথা না।’ দুনিয়া তাকে বলেছিল, ‘পর পর যত রাতই হোক না কেন। আমি, আমি সবসময়ই  উত্তেজিত। আমি অনন্তকাল অবধি করে যেতে পারবো –থামার কোনো প্রয়োজন নেই আমার।’

দুনিয়ার শারীরিক ব্যগ্রতাকে যে গল্প বলে যে প্রশমন করা যেতে পারে, তাঁর এই আবিষ্কারটি তাকে খানিকটা স্বস্তি দিয়েছিল। ‘আমাকে একটা গল্প বলো’, সে বলতো, তার বাহুর নীচে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে, আর তাঁর হাত বিশ্রাম নিতো দুনিয়ার কপালের উপর। এবং তিনি ভাবতেন, বেশ, আজ আমি মুক্তি পেয়েছি, এবং তিনি অল্প অল্প করে দুনিয়াকে তাঁর মনের গল্প নিবেদন করেছিলেন।  তিনি এমন সব শব্দ ব্যবহার করেছিলেন যেগুলো তাঁর সমসাময়িকরাও ভয়ঙ্কর মনে করতেন, যেমন,  ‘যুক্তি’, ‘তর্ক-বিতর্ক’ আর ‘বিজ্ঞান,’ যেগুলো ছিল তার চিন্তা আর ধারণাগুলোর তিনটি মূল স্তম্ভ , যা তাঁর লেখা সব বইগুলোকে পোড়ানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। দুনিয়া এই সব শব্দগুলো ভয় পেতো বেশ, কিন্তু ভয় তাকে আবার উত্তেজিতও করতো, সে ইবন রুশদের আরো কাছে ঘেষে আসতো আর বলতো, ‘আমার মাথাটা ধরো, যখন তুমি তোমার মিথ্যা দিয়ে আমার মাথা ভরে দিচ্ছো।’

ইবন রুশদের মনের ভিতরে একটি গভীর আর দূঃখের ক্ষত ছিল, কারণ তিনি ছিলেন একজন পরাজিত মানুষ, তাঁর জীবনের বড় যুদ্ধটিতে তিনি হেরে গিয়েছিলেন মৃত পারস্যবাসী এক ব্যক্তির কাছে, তুসের গাজালি (৮), একজন প্রতিপক্ষ, যিনি পচাশি বছর ধরেই মৃত। একশ বছর আগে, গাজালি একটি বই লিখেছিলেন যার নাম ছিল ‘দি ইনকোহেরেন্স অব ফিলোসফারস’ বা দার্শনিকদের অসংলগ্নতা (৯), যেখানে তিনি গ্রীকদের যেমন অ্যারিস্টোটল (১০), নিওপ্লেটোনিস্ট  (১১) ও তাদের মিত্রদের, ইবন রুশদের মহান পূর্বসূরি ইবন সিনা (১২) ও আল-ফারাবীকে (১৩) আক্রমন করেছিলেন। জীবনের একটি পর্যায়ে ধর্ম বিশ্বাসের সংকটে আক্রান্ত হয়েছিলেন গাজালি। কিন্তু তিনি তার বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করেছিলেন এমন আত্মবিশ্বাসের সাথে যে, পৃথিবীর ইতিহাসে তিনি দর্শনের শ্রেষ্ঠতম অভিশাপে পরিণত হয়েছিলেন। ‘দর্শন’, তিনি উপহাস করেছিলেন, ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে অক্ষম অথবা এমনকি দুজন ঈশ্বরের অস্তিত্বের অসম্ভাব্যতাও প্রমাণ করতে পারেনা। দর্শন বিশ্বাস করে কারণ এবং প্রভাবের অবশ্যম্ভাবিতার উপর, যা ঈশ্বরের শক্তির প্রতি অপমান স্বরুপ, যিনি অনায়াসে হস্তক্ষেপ করতে পারেন কারণকে নিষ্ফল অকার্যকর করে দিতে, এবং যদি তিনি চান, কারণের প্রভাবকেও পরিবর্তন করে দিতে পারেন।’

যখন রাত তাদের দুজনকে নীরবতার চাদরে আলিঙ্গন করতো, তারা নিষিদ্ধ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারতো, ইবন রুশদ তখন দুনিয়াকে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কি হয়ে, যখন আগুনের শিখা সহ একটি কাঠি তুলার একটি গোলকের স্পর্শে নিয়ে আসা হয়?’

দুনিয়া উত্তরে বলে, ‘অবশ্যই তুলায় আগুন ধরে যাবে।’

‘আর কেন সেটিতে আগুন ধরবে?’

‘কারণ এভাবেই তো হয় সবসময়’, দুনিয়া বলেছিল, ‘আগুনের শিখা তুলাকে স্পর্শ করবে আর তুলা আগুনের অংশ হয়ে যাবে। এভাবেই সবসময় ঘটে।’

‘প্রকৃতির নিয়ম’, তিনি বলেন, ‘সব কার্যকারণের ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব আছে’, এবং দুনিয়া মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় ইবন রুশদের আদর করতে থাকা হাতের নীচে।

‘কিন্তু তিনি ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন.’ ইবন রুশদ বলেছিলেন, আর দুনিয়া জানতো, তিনি তাঁর শত্রু গাজালির কথা বলছেন, ‘তিনি বলেছিলেন যে তুলায় আগুন ধরে কারণ ঈশ্বর এটিকে দিয়ে সেটি করাচ্ছেন, কারণ ঈশ্বরের মহাবিশ্বে একমাত্র আইন হচ্ছে সেটি, যা ঈশ্বর ইচ্ছা করেন।’

সুতরাং যদি ঈশ্বর চান যে ‍তুলাই আগুনকে নিভিয়ে দেবে, বা যদি তিনি চান আগুন তুলার অংশ হয়ে যাবে, তিনি সেটাই করতে পারেন?’

‘হ্যা,’ ইবন রুশদ বলেছিলেন, ‘গাজালির বই অনুযায়ী, ঈশ্বর সেটি করতে পারেন।’

দুনিয়া কিছুক্ষণের জন্য ভাবে, ‘কিন্তু এটাতো বোকার মত কথা হলো’, অবশেষে সে বলে। এমন কি অন্ধকারেও দুনিয়া তাঁর আত্মসমর্পনের মৃদুহাসিটি অনুভব করতে পারে, যে হাসির সাথে মিশে আছে যেমন নৈরাশ্যবাদ, তেমনি আছে কষ্ট, আঁকাবাঁকা হয়ে সেই হাসিটি তাঁর দাড়ি দিয়ে ঢাকা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

‘তিনি বলতেন এটাই হচ্ছে সত্যিকারের  ধর্মবিশ্বাস’,  দুনিয়াকে তিনি বলেন, ‘এবং এর সাথে ভিন্নমত পোষণ করাই হবে .. অসংলগ্নতা।’

‘তাহলে যে কোনো কিছু ঘটতে পারে যদি ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নেন সেটি ঠিক আছে,’ দুনিয়া বলে, ‘যেমন একজন মানুষের পা আর মাটি স্পর্শ নাও করতে পারে, সে বাতাসেই হাটা শুরু করতে পারে।’

‘একটি অলৌকিক ঘটনা’, ইবন রুশদ বলেন, ‘হচ্ছে শুধুমাত্র যখন ঈশ্বর নিয়মগুলো তার ইচ্ছামতন পরিবর্তন করেন, যেভাবে তিনি খেলতে চান, আর যদি আমরা সেটি বুঝতে না পারি, এর কারণ হচ্ছে ঈশ্বর চুড়ান্তভাবে অবর্ণনীয়, যার মানে হচ্ছে এমন কিছু বলা, এটি আমাদের বোঝার ক্ষমতার বাইরে।’

আবারো দুনিয়া চুপ করে থাকে, বেশ কিছুক্ষণ পর সে বলে, ‘ধরো, আমি মনে করলাম যে ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্ব নেই। ধরো, তুমি আমাকে মনে করতে সাহায্য করলে যে, ‘যুক্তি’ আর ‘বিজ্ঞানে’ এমন জাদু আছে যা ঈশ্বরকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলতে পারে। কেউ কি এমনকি এমন কিছু মনে করতে পারে যে এমন কিছু মনে করা সম্ভব হতে হতে পারে?’

দুনিয়া অনুভব করে, তার শরীর শক্ত হয়ে উঠেছে। সে ভাবে এখন তিনি তার শব্দগুলোকেই ভয় পাচ্ছেন, এবং খুব অদ্ভুতভাবে সেটি তাকে তৃপ্তি দেয়, ‘না,’ ইবন রুশদ খুব রুঢ়ভাবেই বলেন, ‘সেটা খুবই বোকার মত একটি প্রস্তাবনা হবে।’

তিনি নিজেই একটি বই লিখেছিল, ‘দি ইনকোহেরেন্স অব দি ইনকোহেরেন্স’ বা অসংলগ্নতার অসংলগ্নতা (১৪), হাজার মাইল দূরে বসে, শত বর্ষ সময়ের ব্যবধানে গাজালির প্রত্যুত্তরে, কিন্তু এর চমক লাগানো শিরোনাম সত্ত্বেও বইটি পারস্যবাসী সেই মৃত ব্যক্তিটির প্রভাব হ্রাস করেনি এবং অবশেষে ইবন রুশদকেই  অপমানিত হতে হয়েছে, তার বইগুলোই ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল আগুনের শিখায়, যে শিখা তার পৃষ্ঠাগুলোকে গ্রাস করেছিল কারণ ঈশ্বর সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আগুনকে সেটি করতে অনুমতি দেয়া উচিৎ হবে। তার সব লেখায়, ইবন রুশদ চেষ্টা করেছেন ‘যুক্তি’, ‘তর্ক-বিতর্ক’ আর ‘বিজ্ঞান’ শব্দগুলোকে ‘ঈশ্বর’, ‘ধর্মবিশ্বাস’ আর ‘কোরান’ শব্দগুলোর সাথে সমন্বয় করার জন্য, কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি, এমনকি যদিও তিনি খুব সূক্ষ্মতার সাথে দয়া থেকে নেয়া যুক্তি ব্যবহার করেছেন, কোরানের উক্তি ব্যবহার করে প্রদর্শন করেছিলেন যে, ঈশ্বরের অবশ্যই অস্তিত্ব থাকতে হবে, কারণ মানব জাতির জন্য এমন সমৃদ্ধ পৃথিবী তিনি দান করেছেন: আমরা কি মেঘ থেকে পিষ্ট করে বৃষ্টিপাত ঘটাইনি, পর্যাপ্ত পরিমানে পানি ঝরে পড়েছে, যেন তোমরা শস্য আর নানা উদ্ভিদ চাষ করতে পারো এবং বৃক্ষ দিয়ে ঘণ করে রোপন করতে পারো বাগান? তিনি নিজে খুবই আগ্রহী ছিলেন শখের বাগান করতে, এবং দয়া থেকে আসা যুক্তিটি তার কাছে মনে হয়েছিল একই সাথে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে ও তিনি আবশ্যিকভাবে দয়ালু, উদারনীতিবাদী প্রকৃতির, সেটিও প্রমাণ করে। কিন্তু নিষ্ঠুর কঠোর ঈশ্বরের ধারণার প্রবর্তকরা তাকে পরাজিত করেছিল। এখন তিনি শুয়ে আছেন, বা যেমনটি তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, একজন ধর্মান্তরিত ইহুদীর সাথে, যাকে তিনি বেশ্যালয় থেকে বাঁচিয়েছিলেন, এবং যার ক্ষমতা আছে তার স্বপ্নগুলোর ভিতর প্রবেশ করার, যেখানে তিনি গাজালির সাথে বিতর্ক করেছিলেন অসমন্বয়যোগ্য ভাষায়, বিশুদ্ধ আন্তরিকতার ভাষায়, সবটুকু উজাড় করে দিয়ে, যদি জাগ্রত জীবনে তিনি সেই ভাষা কখনো ব্যবহার করতেন, তাকে জল্লাদের হাতে প্রাণ দিতে হতো অভিশপ্ত হয়ে।

দুনিয়া গর্ভ যখন শিশু দিয়ে পূর্ণ হচ্ছিল আর ছোট বাসায় সে তাদের প্রসব করছিল, তখন সেখানে ইবন রুশদের নির্বাসিত মিথ্যার জন্যে জায়গাও কমে আসছিল। দম্পতিটির অন্তরঙ্গ মুহূর্তের সময়ও ক্রমশ কমতে শুরু করেছিল এবং অর্থ একটি বড় সমস্যা ছিল। ‘একজন সত্যিকারের পুরুষ তাদের কাজের পরিণতির মোকাবেলা করতে পারে,’ দুনিয়া তাকে বলেছিল, ‘বিশেষ করে যে মানুষটি কার্যকারণ ও তার প্রভাবে বিশ্বাস করেন।’ কিন্তু অর্থ উপার্জনের মত কোনো কাজে তার দক্ষতা কখনোই ছিল না। ঘোড়ার বাণিজ্য খুবই অনির্ভরযোগ্য একটি ব্যবসা ছিল, এবং যেখানে প্রতারকেরও কোনো অভাব ছিলনা এবং তার লভ্যাংশ ছিল সামান্য। তিনাজার বাজারেও তার বহু প্রতিদ্বন্দী ছিল, সুতরাং সেখানে দামও কম ছিল। ‘রোগীদের কাছ থেকে আরো বেশী পয়সা নাও,’ দুনিয়া তাকে উপদেশ দিয়েছিল কিছু বিরক্তিসহ, ‘তোমার উচিৎ তোমার অতীতের সুনামকে পুঁজি করে টাকা আয় করা, সেটি যতই কলঙ্কিত হোক না কেন। আর কি আছে তোমার? শুধুমাত্র বাচ্চা পয়দা করার দানব হওয়াই যথেষ্ঠ নয়। তুমি বাচ্চা তৈরী করবে, বাচ্চার জন্ম হবে, এবং বাচ্চাদের অবশ্যই খাওয়াতে হবে। এটাই ‘যৌক্তিক’, ‘এটাই যুক্তিসঙ্গত।’ দুনিয়া  জানতো কোন শব্দগুলো সে তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। সে বিজয়ীয় মত চিৎকার করে বলে, ‘আর সেটা না করাই হচ্ছে অসংলগ্নতা বা অযৌক্তিক।’

জিনরা চকচকে জিনিসের বিশেষ ভক্ত হয়ে থাকে, যেমন চকচকে সোনা আর রত্ন ইত্যাদি এবং প্রায়শই তারা তাদের সম্পদ লুকিয়ে রাখে মাটির নীচে কোনো গুহায়। কেন তাহলে জিনিয়া, যে কিনা জিনদের রাজকুমারী, চিচিং ফাক বলে চিৎকার করেনি তার গুপ্তধনের গুহার দরজার সামনে দাড়িয়ে এবং তাদের অর্থনৈতিক সমস্যা এক নিমেষেই সমাধান করেনি? কারণ, সে  মানব জীবন নির্বাচন করেছিল, এক মানুষের ‘মানব’ স্ত্রীর জীবন, তার নিজের নির্বাচনই তাকে সীমাবদ্ধ করেছিল। এই পর্যায়ে তার প্রেমিকের কাছে তার প্রকৃত পরিচয় উন্মোচন, এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতাকেও উন্মোচন করবে, তাদের সম্পর্কের কেন্দ্রে থাকা একটি মিথ্যাকে ‍উন্মুক্ত করে দেবে। সুতরাং দুনিয়া নীরব ছিল সেই শঙ্কায়, তিনি হয়তো তাকে ত্যাগ করতে পারেন সত্যটি জানলে।

পারস্য দেশের একটি বই আছে, ‘হাজার আফসেনেহ’ বা ‘এক হাজার গল্প’, যা আরবী ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। আরবী সংস্করণটিতে অবশ্য এক হাজারের চেয়ে কিছু কম সংখ্যক গল্প ছিল কিন্তু পুরো ঘটনাটিকে বিস্তৃত করা হয়েছিল এক হাজার রাতে, অথবা, যেহেতু জোড় সংখ্যাকে কুৎসিৎ বিবেচনা করা হয়, এক হাজার রাতের সাথে আরো একটি রাত বাড়তি যোগ করা হয়েছিল। ইবন রুশদ বইটি দেখেননি, কিন্তু এর বেশ কিছু গল্প রাজসভায় থাকার সময় তাকে বলা হয়েছিল। মাঝি ও জিনের গল্পটি তাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল, তবে এর বিস্ময়কর জাদুকরী বিষয়গুলোর জন্য ততটা নয় ( প্রদীপের জিন, জাদুর কথা বলা মাছ, মন্ত্রে আচ্ছন্ন রাজকুমার, যিনি অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক মার্বেল), বরং এর কারিগরী সৌন্দর্যের জন্য, যেভাবে এর গল্পগুলো অন্য গল্পগুলোর ভাজে লুকিয়ে থাকে এবং তারপরও আরো অন্য অনেক গল্প সেটি ধারণ করে থাকে এর মধ্যে, যেন গল্পটি জীবনের সত্যিকারের আয়নায় রুপান্তরিত হয়। ইবন রুশদ ভাবতেন, আমাদের জীবনের সব গল্পগুলোই অন্যদের জীবনের গল্প ধারণ করে, আর সব গল্পগুলো নিজেরাই আবার আরো বিশাল কাহিনীরই অংশ, আমাদের পরিবারের অথবা আমাদের জন্মভূমির কিংবা আমাদের বিশ্বাসের। গল্পের মধ্যে গল্পের চেয়ে এমনকি আরো বেশী সুন্দর ছিল গল্প বলিয়ের গল্পটি, শাহরাজাদ বা শেহেরজাদে নামের এক রানী, খুনি এক স্বামীকে তার গল্পগুলো বলছিলেন, উদ্দেশ্য সে যেন তাকে হত্যা না করতে পারে। গল্পগুলো বলা হয়েছিল মৃত্যুকে পরাজিত করার জন্য, একজন বর্বর মানুষকে সভ্য করার জন্য বলা হয়েছিল গল্পগুলো। এবং বিয়ের শয্যায় পায়ের কাছে বসে ছিল শেহেরজাদের বোন, তার সবচেয়ে একনিষ্ঠ নিখুঁত শ্রোতা, আরো একটি গল্পের জন্য সে বায়না করেছে যখনই একটি গল্প শেষ হয়েছে এবং তারপর আরো একটা, তারপর আরো একটা। এই বোনটির কাছ থেকে ইবন রুশদ সেই নামটি পেয়েছিলেন যা তিনি দিয়েছিলেন তার প্রেমিকা দুনিয়ার গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা এক দঙ্গল শিশুদের নাম হিসাবে। কারণ ঘটনাচক্রে বোনটির নাম ছিল দুনিয়াজাদে; ‘যা এখানে আমাদের  আছে, যা অন্ধকার  ঘরটিকে পূর্ণ করেছে এবং আমাকে বাধ্য করেছে লুসেনার অসুস্থ আর দূর্গত মানুষের কাছ চিকিৎসার জন্য থেকে অতিমাত্রায় বেশী ফি আরোপ করতে, সেটি হচ্ছে   দুনিয়াজাতের আবির্ভাব, এর মানে দুনিয়ার গোত্র, দুনিয়ার জাত, দুনিয়া মানুষ, যার মানে  পৃথিবীর মানুষ।’

দুনিয়া গভীরভাবেই অপমানিত বোধ করেছিল, সে বলেছিল ‘তার মানে তুমি বলতে চাইছো, যেহেতু আমরা বিবাহিত নই, আমদের সন্তানরা তাদের বাবার নাম বহন করতে পারবে না?’

তিনি হাসেন, তার দুঃখী, কিছুটা বাঁকা হাসি, ‘এটাই উত্তম যে তাদের নাম দুনিয়াজাত হোক’, তিনি বলেন, ‘এটি এমন একটি নাম যার মধ্যে পৃথিবীর নাম থাকবে, নাম দিয়ে তাদের কেউ বিচার করবেনা। তাদের যদি রুশদী বলা হয়, তাহলে সেটি তাদের কপালে কলঙ্ক এঁকে ইতিহাসের  দিকে পাঠানো হবে।’

শেহেরজাদের বোন হিসাবে দুনিয়া কথা বলতে শুরু করেছিল, সবসময়ই সে গল্প শুনতে চাইতো, শুধুমাত্র তার শেহেরজাদে ছিল একজন পুরুষ – তার প্রেমিক, তার ভাই নয় – আর তাঁর কিছু গল্প যথেষ্ঠ ছিল তাদের দুজনকেই হত্যা করার জন্য, দূর্ঘটনাবশত যদি সেই শব্দগুলো তাদের শয়নকক্ষের অন্ধকার থেকে কখনো বের হয়ে আসতো। সুতরাং ইবন রুশদ এক ধরনের শেহেরজাদে বিরোধী, দুনিয়া তাকে বলেছিল, ‘এক হাজার এক রাতের’ গল্প বলিয়ের ঠিক বিপরীত: তার গল্প তার জীবন বাঁচিয়েছিল, যখন ইবন রুশদের গল্প তাঁর জীবনকে ঝুকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল।

কিন্তু তারপর খলিফা আবু ইউসুফ ইয়াকুব যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন, তার জীবনের সবচেয়ে বড় সামরিক বিজয়, গুয়াদিয়ানা নদীর কাছে আলারকসে কাস্তিলের খ্রিস্টীয় রাজা অষ্টম আলফনসোর বিরুদ্ধে। আলারকসের যুদ্ধের পর, যেখানে খলিফার বাহিনী খ্রিস্টিয় সেনাবাহিনীর ঠিক অর্ধেক, প্রায় দেড় লক্ষ খ্রিস্টান সৈন্যকে হত্যা করেছিল, আবু ইউসুফ নিজেকে আল-মনসুর- বিজয়ী – দিয়েছিলেন, বিজয়ী বীরের আত্মবিশ্বাসসহ তিনি ধর্মান্ধ বারবারদের আধিপাত্যের পরিসমাপ্তি ঘটান, এবং রাজসভায় ফিরে আসার জন্য ইবন রুশদকে ডেকে পাঠান।

বৃদ্ধ দার্শনিকের কপাল থেকে  লজ্জার কলঙ্ক মোছা হয়, তার নির্বাসনের জীবনের সমাপ্তি হয়। তিনি পুনর্বাসিত হন, তার বিরুদ্ধে সব অপমানের সমাপ্তি হয়, পুরোনো সন্মান নিয়ে আবার রাজসভায় খলিফার ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসাবে তার প্রাক্তন দ্বায়িত্বে ফিরে আসেন, তার নির্বাসন শুরুর দুই বছর, আট মাস এবং আঠাশ দিন ও রাত পরে, তার মানে, এক হাজার দিন ও রাত ও আরো একটি দিন ও রাতের পর। এবং দুনিয়া তখন আবারো গর্ভবতী, অবশ্যই, এবং তিনি তাকে বিয়ে করেননি, অবশ্যই, তার গর্ভজাত সন্তানদের তিনি তাঁর নাম দেননি অবশ্যই, এবং তিনি তাকে তার সাথে আল-মোহাদ রাজসভাতেও নিয়ে আসেননি অবশ্যই, সুতরাং দুনিয়া ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়। যখন তিনি কর্দোবার উদ্দেশ্যে আবার যাত্রা শুরু করেছিলেন তার আলখেল্লাগুলোর সাথে তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন, বুদবুদসহ গলাওয়ালা কিছু কাচের পাত্র, তার পাণ্ডুলিপি, কিছু বাধাই করা, কিছু কাগজের কুণ্ডুলী, অন্যদের বইয়ের কিছু পাণ্ডুলিপি, কারণ তার নিজেরগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল, যদিও বহু কপি রক্ষা পেয়েছিল, তাকে জানানো হয়েছিল, অন্য শহরে, বন্ধুদের পাঠাগারে, যেখানে তিনি সেগুলো লুকিয়ে রেখেছিলেন তার বিরুপ দূর্দিনে, কারণ একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি সবসময় খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকেন, কিন্তু যদি তিনি সত্যিকারভাবে বিনম্র হন, তাহলে সৌভাগ্যকে সুযোগ দেন তাকে বিস্মিত করার জন্য।

সকালের খাবার শেষ না করে বা বিদায় না নিয়েই তিনি লুসেনা ত্যাগ করেন, আর দুনিয়াও তাকে কোনো হুমকি দেয়নি, তার সত্যিকারের প্রকৃতিটি উন্মোচন করেনি বা তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা শক্তিটিও দেখায়নি, আর বলেনি যে, আমি জানি তুমি তোমার স্বপ্নে জোরে জোরে কি কথা বলো, যখন তুমি এমন কিছু মনে করো যা মনে করা হবে নির্বুদ্ধিতা, যখন তুমি অসমন্বয়যোগ্যতার সাথে সমন্বয় করার প্রচেষ্টা বন্ধ করো এবং ভয়ঙ্কর কিছু বলো, ভয়ঙ্কর সত্য।  ধরে রাখার কোনো চেষ্টা না করে দুনিয়া ইতিহাসকে সুযোগ দিয়েছিল তাকে পরিত্যাগ করতে, ঠিক যেভাবে শিশুরা কোনো বড় মিছিলকে অতিক্রম করতে দেয়, সেটিকে তাদের স্মৃতিতে শুধু ধরে রেখে, এটি তাদের নিজের করে নিয়ে। এবং দুনিয়া তাকে ভালোবাসা অব্যাহত রেখেছিল, যদিও তিনি তাকে খুবই হালকাভাবে পরিত্যাগ করেছিলেন। ‘তুমি ছিলে আমার সব কিছু’, দুনিয়া তাকে বলতে চেয়েছিল, ‘তুমি ছিলে আমার সূর্য এবং চন্দ্র, আর কে এখন আমার মাথায় হাত দেবে, কে আমার ঠোঁটে চুমু খাবে, কে আমাদের সন্তানদের পিতা হবে?’ কিন্তু ইবন রুশদ ছিলেন সেই মহান মানুষদের একজন যার নিয়তি নির্ধারিত ছিল অমরদের বিশাল ঘরে বাস করা, এইসব চিৎকার করা শিশুরা তার যাবার পথে ভার কমানোর জন্য ছুড়ে ফেলা অপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

বিশ্বাস করা হয় যে, দুনিয়া মানুষের মধ্যে আরো কিছুদিন বসবাস করেছিল, সে হয়তো আশার বিরুদ্ধে আশা করেছিল ইবন রুশদের ফিরে আসার জন্য। এবং যেহেতু তিনি তাকে টাকা পাঠানো অব্যাহত রেখেছিলেন, হয়তো মাঝে মাঝে তিনি দুনিয়ার সাথে হয়তো দেখাও করেছিলেন। দুনিয়া তার ঘোড়ার ব্যবসায় হাল ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু অব্যাহত রেখেছিল তাঁর তিনাজার ব্যবসাটি। কিন্তু এখন যখন ইতিহাসের সূর্য ও চন্দ্র তার বাসায় চিরকালের মত অস্ত গিয়েছিল  তখন তার গল্প রুপান্তরিত হয়েছিল ছায়া আর রহস্যের একটি বিষয়ে।সুতরাং হয়তো এটি সত্য, যেমন মানুষরা বলতো, ইবন রুশদ মারা যাবার পর তার আত্মা দুনিয়ার কাছে ফিরে এসেছিল ও তার সাথে এমনকি আরো বেশী সন্তানের জন্মও দিয়েছিল।  মানুষ আরো বলেছিল যে, ইবন রুশদ তাকে একটি প্রদীপ এনে দিয়েছিলেন, যার মধ্যে একটি জিন ছিল, আর তাকে পরিত্যাগ করে তিনি চলে যাবার পর সেই জিনটাই আসলে ছিল দুনিয়ার সন্তানদের পিতা – সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি কিভাবে গুজব সবকিছু ‍ওলট পালট করে দিতে পারে! তারা আরো বলেছিল, খানিকটা নিষ্ঠুরতার সাথে, পরিত্যক্ত সেই নারী যে কোনো মানুষকে সঙ্গ দিয়েছিল, যারা তার বাড়ি ভাড়া শোধ করতে পেরেছিল, এবং প্রতিটি মানুষ যার সাথেই দুনিয়া সম্পর্ক করেছিল, প্রত্যেকেই তাকে দিয়ে গিয়েছিল আরো এক দঙ্গল সন্তান। সুতরাং দুনিয়াজাত, দুনিয়ার সন্তানরা, আর জারজ রুশদী ছিলনা, অথবা তাদের কেউ কেউ তা ছিল না অথবা তাদের অনেকেই সেটি ছিল না। কারণ বেশীর ভাগ মানুষের চোখে দুনিয়ার জীবনের গল্প রুপান্তরিত হয়েছিল তোতলামীপূর্ণ একটি বাক্যে, কতদিন সে বেঁচে ছিল অথবা কোথায় অথবা কার সাথে অথবা কখন ও কিভাবে – অথবা সে কি মারা গিয়েছিল কিনা, সেই তথ্যগুলো উন্মোচন করতে অক্ষম এই বাক্যের বর্ণগুলো নানা অর্থহীন রুপে দ্রবীভুত হয়ে গিয়েছিল।

কেউই লক্ষ্য করেনি কিংবা আদৌ কিছু মনে করেনি একদিন যখন দুনিয়া এক পাশে ফিরে পৃথিবীর একটি ছিদ্র দিয়ে তার পরীস্থানে ফিরে গিয়েছিল, অন্য একটি বাস্তবতায়, স্বপ্নের জগতে, যেখান থেকে জিনরা মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসতো মানবজাতির জন্য জ্বালাতন কিংবা আশীর্বাদ হিসাবে। লুসেনার গ্রামবাসীদের জন্য, দুনিয়া সম্ভবত মিলিয়ে গিয়েছিল, হয়তো আগুনহীন ধোয়ায়।

দুনিয়ার আমাদের পৃথিবী ত্যগ করার পর, জিনদের জগত থেকে আমাদের জগতে অভিযাত্রীদের সংখ্যাও কমে গিয়েছিল, আর তারপরে একসময় তারা পুরোপুরিভাবে আমাদের জগতে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল, এবং পৃথিবীর সেই ছিদ্রগুলোকে ঢেকে দিয়েছিল প্রথাগত ভাবনার কল্পনাহীন আগাছা, আর প্রাণহীন নানা বিষয়ের কাটার ঝোপ, যতক্ষণ না অবশেষে সেগুলো পুরোপুরি বন্ধ না হয়ে যায় এবং জাদুর অভিশাপ বা আশীর্বাদ ছাড়া তাদের পক্ষে যতটা করা সম্ভব ততটা করা ছাড়া আমাদের পূর্বপুরুষদের অবশেষে আর কিছুই করার ছিলনা ।

কিন্তু দুনিয়ার সন্তানরা বেশ ভালো করেছিল। এতটুকু অন্তত বলা যেতে পারে। এবং এর প্রায় তিনশ বছর পর, যখন ইহুদীদের স্পেন থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল, এমনকি সেই ইহুদীদেরকে, যারা বলতে পারবে না যে তারা ইহুদী ছিল, দুনিয়ার প্র-পৌত্রদের প্র-পৌত্ররা কাদিজ আর পালোস দে মোগুয়ের থেকে জাহাজে উঠেছিল, অথবা পিরেনিজ পর্বতমালা তারা অতিক্রম করেছিল হেটে, অথবা তাদের জাদুর কার্পেটে চড়ে উড়ে গিয়েছিল, অথবা দানবীয় আকারের শবাধারে চড়ে, যেমন তাদের জিন স্বজাতিরা যাতায়াত করতো। তারা মহাদেশ অতিক্রম করেছিল, সাত সমূদ্র পাড়ি দিয়েছিল, উচু পর্বতে চড়েছিল এবং বিশাল নদী সাতরে পার হয়ে গভীর উপত্যাকায় প্রবেশ করেছিল, এবং যেখানেই তারা পেরেছিল সেখানেই আশ্রয় আর নিরাপত্তা খুঁজে নিয়েছিল, পরস্পরকেও তারা ভুলে গিয়েছিল দ্রুত অথবা মনে রেখেছিল যতদিন তারা মনে রাখতে পেরেছিল এবং তারপর ভুলে গিয়েছিল অথবা কখনোই ভোলেনি, একটি পরিবারে রুপান্তরিত হয়েছিল যা আর ঠিক আর কোনো পরিবারের মত ছিলনা, একটি গোত্র যার আর ঠিক কোনো গোত্রের মত ছিলনা, তারা সব ধর্মকেই গ্রহন করেছিল এবং কোনো ধর্ম ছাড়াই, তারা সবাই ধর্মান্তকরণের বহু শতাব্দী পর, তাদের অতিপ্রাকৃত উৎস এবং জোরপূর্বক ইহুদিদের ধর্মান্তকরণের কাহিনী সম্বন্ধে অজ্ঞ, তাদের কেউ কেউ পাগলের মত ধর্মান্ধ হয়েছিল, যখন অন্যরা হয়েছিল ঘৃণাপূর্ণ অবিশ্বাসী। কোনো জায়গা ছাড়া পরিবার ছিল তারা কিন্তু প্রতিটি জায়গায় তাদের সাথে ছিল পরিবার, কোনো ঠিকানা ছাড়া একটি গ্রাম, কিন্তু পৃথিবীর প্রতিটি জায়গায় সেটি ঘুরে বেড়িয়েছে, শিকড় ছাড়া বৃক্ষের মত, মস অথবা লাইকেন ও লতানো অর্কিডের মত, যাকে অবশ্যই কারো উপর নির্ভর করতে হবে, কারণ একা দাড়ানোর কোনো শক্তি তার নেই।

ইতিহাস তাদের প্রতি খুব নির্দয় হয়, যারা তাকে পরিত্যাগ করে, এবং একইভাবে ইতিহাস নির্দয় তাদের প্রতিও, যারা তাকে তৈরী করে।  পুনর্বাসনের পর মারাকেশে ভ্রমণ করার সময় মাত্র বছরের পার না হতেই ইবন রুশদ মারা গিয়েছিলেন (বার্ধক্যজনিত কারণে, অথবা যেমনটি আমরা বিশ্বাস করি), কখনোই তিনি দেখে যেতে পারেননি কিভাবে তার খ্যাতি বেড়েছিল, কখনো দেখে যেতে পারেনি কিভাবে সেটি তার নিজের জগতে সীমানা অতিক্রম করেছিল আর অবিশ্বাসীদের জগতে প্রবেশ করেছিল, যেখানে অ্যারিস্টোটল নিয়ে তার ব্যাখ্যা রুপান্তরিত হয়েছিল তার শক্তিশালী পূর্বসূরির জনপ্রিয়তা ভিত্তি হিসাবে, অবিশ্বাসীদের ঈশ্বরহীন দর্শনের ভিত্তি হিসাবে, সেকুলারিস, যার অর্থ এমন একটি ধারণা যারা মাত্র একবারই আসে এক সেকুলামে, পৃথিবীর একটি সময়কাল অথবা হতে পারে একটি ধারণা, যে কোনো যুগেরই, আর যা ছিল শুধুমাত্র স্বপ্নে যা তিনি বলেছিলেন তার হুবুহু প্রতিলিপি আর প্রতিধ্বণি। হয়তো, ঈশ্বরভক্ত একজন মানুষ হিসাবে, ইতিহাস তাকে যে আসনে বসিয়েছে, তা নিয়ে ইবন রুশদ হয়তো কখনো খুশি হতেন না, কারণ খুব অদ্ভুত নিয়তি এটি কোনো বিশ্বাসীর জন্য, যিনি কিনা সেই ধারণাগুলোর অনুপ্রেরণা হয়েছিলেন, যার জন্য কোনো বিশ্বাসের প্রয়োজন ছিলনা এবং আরো বিস্ময়কর নিয়তি হচ্ছে কোনো ব্যক্তির দর্শনের জন্যে যা বিজয়ী হয়েছিল তার নিজের জগতের সীমানার বাইরে, কিন্তু তার নিজের জগতের সীমানার মধ্যে যা পরাজিত হয়েছিল, কারণ তিনি যে পৃথিবীকে জানতেন সেখানে তার মৃত প্রতিদ্বন্দী, গাজালির সন্তানরা বংশবৃদ্ধি করেছে, উত্তরাধিকার সূত্রে রাজত্ব পেয়েছিল, অন্যদিকে তার নিজের জারজ সন্তানরা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা পৃথিবীতে, তার নিষিদ্ধ নাম পেছনে ফেলে, সারা পৃথিবীকে জনাকীর্ণ করতে।

যারা বাঁচতে পেরেছিল তাদের বড় একটি অংশ মহান উত্তর আমেরিকা মহাদেশে এসে বসতি গড়েছিল এবং আরো অনেকে মহান দক্ষিণ এশিয় উপমহাদেশে, ‘গুচ্ছ’ প্রপঞ্চের সুবাদে, এলোমেলো সজ্জার যা রহস্যময় অযৌক্তিতার অংশ, তাদের অনেকে পরে পশ্চিমে আর দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকা মহাদেশের মধ্য দিয়ে, আর উত্তর ও পশ্চিমে এশিয়ার পায়ের কাছে সেই মহান হিরকখণ্ড থেকে, পৃথিবীর সব দেশে, কারণ দুনিয়াজাত সম্বন্ধে খুব নিরপেক্ষভাবে বলা যাবে যে অদ্ভুত কান ছাড়াও তাদের পাগুলোও খুব অস্থির ছিল। ইবন রুশদ মৃত, কিন্তু তিনি ও তার প্রতিদ্বন্দী কবর পেরিয়ে এখনও দ্বন্দরত, কারণ মহান চিন্তাবিদদের যুক্তিতর্কের কোনো শেষ নেই। এই বিতর্কটাই মনকে উন্নত করার একটি উপকরণ, সবচেয়ে ধারালো উপকরণ, জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসায় যার জন্ম, যার মানে হচ্ছে, দর্শন।

টীকা:

১ ইবন রুশদ (১১২৬-১১৯৮) ( আবু-ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবন আহমাদ ইবন রুশদ),  আভেরোয়েস নামে পশ্চিমে পরিচিত: আন্দালুসিয়া (আরব স্পেনের) একজন পলিম্যাথ ও দার্শনিক, তিনি যুক্তিবিদ্যা,অ্যারিস্টোটল, ইসলামী দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, ইসলামি আইন দর্শন, মনোবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ভুগোল, গনিত, সঙ্গীত তত্ত্ব, মধ্যযুগীয় চিকিৎসা বিজ্ঞান,জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান সহ নানা বিষয়ে লিখেছিলেন। তিনি জন্মগ্রহন করেছিলেন বর্তমান স্পেনের কর্দোবা শহরে, মারা যান বর্তমান মরোক্বোর মারাকেশ শহরে। তার কাজের উপর ভিত্তি করে গড়েছিল ত্রয়োদশ শতকের খ্রিস্টীয় ও ইহুদি দার্শনিক আন্দোলন (Averroism);

২ সেভিল ( সেভিয়া), বর্তমান স্পেনের সেভিয়া প্রদেশের রাজধানী।

৩ কর্দোবা বা কর্দোভা, দক্ষিণ স্পেনের একটি শহর। অষ্টাদশ শতকে মুসলিম সেনারা এটি দখল করে, এবং পরে এটাই কর্দোবার খিলাফতের রাজধানী ছিল।

৪ আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল-মনসুর (১১৬০-১১৯৯), তৃতীয় আল-মোহাদ খলিফা।

৫ বারবার (Berber) উত্তর আফ্রিকা বিশাল একটি অংশ জুড়ে বসবাসকারী আদি জনগোষ্ঠীর একটি গ্রুপ।

৬ আল- আন্দালুস, মুসলিম স্পেন ( সময়কাল ৭১১ – ১৪৯২)

৭ লুসেনা, কর্দোবার ৬০ কিমি দক্ষিণ পূর্বের একটি এলাকা

৮ আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ আল-গাজালি (১০৫৮-১১১১), আল গাজালি নামে আরবী ভাষায় পরিচিত, অত্যন্ত প্রভাবশালী মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক, আইন বিশেষজ্ঞ, দার্শনিক ও মিস্টিক ছিলেন। তিনি বর্তমান ইরানের খোরাসান প্রদেশের টুস জেলার তাবারান শহরে জন্মগ্রহন করেন।

৯ The Incoherence of the Philosophers ( আরবীতে Tahāfut al-Falāsifa)  একাদশ শতকে প্রকাশিত পারস্যের ধর্মতাত্ত্বিক আল-গাজালির যুগান্তকারী একটি বই। ইসলাম দর্শনের আশারাইট ধারণার অনুসারী গাজালি ইবন সিনা ও আল-ফারাবীকে আক্রমন করেছিলেন এই বইটিকে। সব ঘটনা ও ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া প্রাকৃতিক নয় বরং ঈশ্বরের ইচ্ছায় ঘটে, তার এই বিশ্বাসটি মূলত এই বইটির ভিত্তি, এবং নাটকীয়ভাবে এই বইটি সফল হয়েছিল, এবং এটি ইসলাম দর্শন ও ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনায় যুক্তিবাদী ধারাটিকে সফলভাবে প্রতিস্থাপিত করেছিল।

১০ অ্যারিস্টোটল ( ৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) – গ্রীক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী, পশ্চিমা দর্শনে যার কাজের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এখনও অনুভূত হয়।

১১ নিওপ্লেটোনিজম – আধুনিক এই শব্দটি দর্শনের একটি ধারাকে চিহ্নিত করে যা বিকশিত হয়েছি তৃতীয় শতাব্দীতে, এবং এটি টিকে ছিল ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম তিন দশক অবধি। নিউপ্লেটোনিস্টরা মূলত প্লেটোর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তবে নিউপ্লেটোনিষ্ট দার্শনিকরা তাদের চিন্তায় বৈচিত্রময় ছিলেন। সুতরাং মূলত তাদের সংজ্ঞায়িত করা হয় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। সেই অর্থে নিওপ্লেটোনিজম হচ্ছে গতিময় একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি যার সূচনা হয়েঠি প্লোটিনাস এর কাজ থেকে।

১২ ইবন সিনা ( ৯৮০ -জুন ১০৩৭) পারস্যের সর্ববিষয়বিদ, ইসলামের স্বর্ণযুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদদের একজন। প্রায় ৪৫০ টি বই লিখেছিলেন তিনি, যার মধ্যে ২৪০ টি টিকে ছিল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর ৪০ টি বই লিখেছিলেন। তার ক্যানন অব মেডিসিন পাঠ্যবই হিসাবে ব্যবহৃত হয়েঠে ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ অবধি।

১৩ আল-ফারাবি (৮৭২-৯৫০/৯৫১), সিরিয়ার দামাস্কাসে জন্ম নেয়া অত্যন্ত বিখ্যাত দার্শনিক ও বিচার দর্শন বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানী। আরব দর্শনে তাকে দ্বিতীয় মাস্টার বলা হয় অ্যারিস্টোটলের পরই। বহু দার্শনিককে তিনি প্রভাবিত করেছিলেন।

১৪  The Incoherence of the Incoherence ( আরবীতে Tahāfut al- Tahāfut ) আন্দালুসিয়ার দার্শনিক ইবন রুশদের লেখা গুরুত্বপূর্ণ একটি বই, যেখানে তিনি অ্যারিস্টোটলের দর্শনকে সমর্থন করেছিলেন ইসলামী দর্শনের পটভূমিতে। বইটি লেখা হয়েছিল সংলাপের ভঙ্গিমায় আল-গাজালির দর্শন বিরোধী বই  The Incoherence of the Philosophers এর প্রস্তাবিত যুক্তিগুলো খণ্ডন করে। বহু ভাষায় বইটি অনূদিত হয়েছে। ইবন রুশদের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্হ হিসাবে বিবেচিত, যেখানে তিনি বিশ্বাস ও দর্শনের সমন্বয় করার চেষ্টা করেছিলেন।

১৫ অষ্টম আলফনসো (১১৫৫-১২১৪), আলারকসের আলমোহাদ খলিফার কাছে পরাজিত হবার পর, ১২১২ সালে খ্রিস্টীয় রাজাদের একটি জোটের সফল নের্তৃত্ব দিয়েছিলেন আলমোহাদ সেনাবাহিনীদের বিরুদ্ধে, যা আরব স্পেনে খ্রিস্টীয় আধিপাত্যের সূচনা হয়েছিল।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ