বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে হিন্দুরা কেমন আছে?।।রাণা

দেশভাগে দেশত্যাগ

পাকিস্তান মানেই যেখানে সন্ত্রাসে দীর্ণ এক দেশের কথা ভেসে ওঠে, সেখানে সংখ্যালঘুদের কেমন অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়। তারপরেও শুষ্ক-কাষ্ঠং পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
পাকিস্তান ইসলামিক প্রজাতন্ত্র দেশ। এখানে অনেক ক্ষেত্রেই শরিয়তি আইন বলবৎ আছে। ব্লাসফেমি আইনের মত মধ্যযুগীয় কালা আইনও বলবৎ আছে, যে আইনের বলে ইসলাম সম্বন্ধে কটু মন্তব্যকারীকে ফাঁসিতে ঝোলানো অব্দি যেতে পারে। মধ্যযুগীয় আইনের এমন দেশে ওখানের আদি হিন্দু বাসিন্দারা কেমন আছে?
২১ কোটির এই দেশে প্রায় ৯৬% মুসলিম। হিন্দু জনগোষ্ঠী প্রায় ১.৬%।

স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তানে হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিল প্রায় ১৫%। যদিও দেশভাগের উত্তেজনায় দুই দেশের দুই ধর্মের মানব বিনিময় হয়। পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রায়  ৪৭ লক্ষ হিন্দু ও শিখ ভারতে পলায়ন করতে বাধ্য হোন, ঠিক একইভাবে ৬৫ লক্ষ মুসলিম ধর্মালম্বীও পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। স্বাধীনতার পরবর্তীতে হিন্দুদের অবস্থা ভাবতে গেলে ১৯৪৭-র পরের পরিসংখ্যানে নজর দিতে হবে। ১৯৫১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পাকিস্তানে হিন্দু ধর্মালম্বীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১.৬%। ১৯৯৮-র জনগণনাতেও দেখা যাচ্ছে হিন্দুরা প্রায় ১.৬% আছে। গাণিতিক হিসাবে প্রায় ২৫ লক্ষ হিন্দু পাকিস্তানে বসবাস করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাস হিসেবে পাকিস্তান পঞ্চম স্থানে আছে।
পাকিস্তানে দিওয়ালি উৎসব

ভারতের দিকে নজর ফেরানো যাক। ১৯৫১ সালের জনগণনা অনুযায়ী হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ৮৪%, মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় ১০%। যদিও মুসলিম অধ্যুষিত জম্মু ও কাশ্মীরকে এই গণনায় ধরা হয়নি। নাহলে মুসলিম ধর্মালম্বীদের সংখ্যা শতাংশের হিসেবে আরো একটু বাড়ত।
সাম্প্রতিক জনগণনা অনুযায়ী ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা ১৪ শতাংশের কাছাকাছি। ভারত ধীরে ধীরে মুসলিম দেশ হয়ে যাবে বলে যতই প্রচার চলুক, গত ষাট বছরে মুসলিম জনবিন্যাসে বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি।

বাংলাদেশে হিন্দুদের অবস্থান সম্বন্ধে একই সারণী ধরে চর্চা করা যাক। ১৯৫১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মালম্বীরা দেশের জনসংখ্যার ২২% উপরে স্থান অধিকার করে থাকত। সাম্প্রতিকতম জনগণনা অনুযায়ী বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ৯ শতাংশের নিচে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে বাকি ১৩ শতাংশের বেশি হিন্দু ধর্মের মানুষেরা কোথায় গেল?
দেশত্যাহ

ভারতবর্ষ বর্তমানে ধর্মের কারণে তিন ভাগে বিভক্ত। স্বাধীনতার পরবর্তীতে পাকিস্তান ও ভারতে হিন্দু ও মুসলিম জনবিন্যাস মোটামুটি একইরকম আছে। কিন্তু বাংলাদেশে ক্ষেত্রে ভয়াবহ চিত্র সামনে আসছে। প্রায় রোজ বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর মুসলিম উগ্রবাদীদের পরিকল্পিত হামলা চলছে। হিন্দু এলাকা ধরে ধরে অগ্নি সংযোগ, মন্দির ভাঙচুর, দৈহিক আক্রমণ, ধর্মান্তরকরণ - সবকিছুর পরিণতিতে হিন্দুরা রোজ একটু একটু করে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। ফেসবুকের পোস্টকে কেন্দ্র করে এই নভেম্বর মাসেই বাংলাদেশের রংপুরে হিন্দু জনবসতির উপর হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে এই ঘটনা নিত্যদিনের। দূর্গাপূজা এলেই মন্দির ও মুর্তিতে হামলা চলতে থাকবে। ভারত ১৯৫১-র পর থেকে বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য শরণার্থী শিবির খুলে বসলে দেখা যেত শিবিরগুলোতে কয়েক কোটি হিন্দু ধর্মের মানুষের ভিড়। বাংলাদেশে হিন্দু বিতাড়ণ ও প্রাণের দায়ে ভারতে আশ্রয় রোজের ঘটনা।  মায়ানমার থেকে ৪ লক্ষের মত রোহিঙ্গা সেনার অত্যাচারে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের দাবি ওঠে, তাহলে বাংলাদেশে এই ব্যাপক হিন্দু বিতাড়ণে কোন দেশের হস্তক্ষেপ করা উচিত? রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের মধ্যেই উস্কানি ওঠে মায়ানমারে হামলা করার, তাহলে ভারত যে কয়েক কোটি বাংলাদেশি হিন্দুর ভার বহন করে চলেছে এবং সেই ভার দিনে দিনে বেড়েই চলেছে, তাহলে ভারতের কী করা উচিত? বাংলাদেশের শ্রদ্ধেয় কবি নির্মলেন্দু গুণ রোহিঙ্গাদের সাথে সহমর্মিতায় পারলে মায়নমারের জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন, তাহলে আপনার দেশের হিন্দুদের সহমর্মিতায় আপনি কি কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে চান? বাংলাদেশের মুসলিমদের হাতে শুধু যে হিন্দুরা আক্রান্ত এমন নয়, সংখ্যালঘু বৌদ্ধ বা চট্টগ্রাম ডিভিশনের পাহাড়িয়ারাও ব্যাপকভাবে আক্রমণের শিকার হন। ভারত বাংলাদেশের চাকমা জনগোষ্ঠীকেও বছরের পর বছর ধরে আশ্রয় দিয়ে চলেছে। দু-তিনমাস আগেই পাহাড়িয়ারা সন্ত্রাসের শিকার হন।
রংপুরে হামলার পরে

যে পাকিস্তানকে নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের একাংশ রোজ গালমন্দ করেন, সেখানে আর যাই হোক হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের রোজ দেশ থেকে পলায়ন করতে হয় না। জনবিন্যাসেও কোন পরিবর্তন হয়নি। পাকিস্তানে হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টও বিদ্যমান। পাকিস্তান সংসদে হিন্দুদের আলাদা আসন সংরক্ষণও আছে। এছাড়াও হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনা ঘটলে সরকারি তরফ থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় আলাদা মন্ত্রক আছে। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে রাণা ভগবানদাস সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হতে পারেন। উল্টোদিকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে চরম অসম্মানজনক পরিস্থিতিতে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয়।
যদিও পাকিস্তানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয়ে ভারতের হিন্দুত্ববাদী দলগুলো যতটা প্রচার করে, তার ছিটেফোঁটাও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। বরং তাদের উৎসাহ থাকে কতটা তাড়াতাড়ি এদের বেআইনি ভাবে ভারতের নাগরিকত্ব দিয়ে নিজেদের ভোটব্যাঙ্কে পরিণত করা যায়। বাম থেকে বিজেপি সবাই এক কাজ করে এসেছে।

২০১৩ সালে পাকিস্তান প্রায় হাজারের মত হিন্দু ভারতে এসে আশ্রয়প্রার্থী হলে তা জাতীয় রাজনীতিতে আলোড়ন তোলে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর লক্ষ হিন্দু ভারতের জনগোষ্ঠীতে মিশে গেলেও তা নিয়ে প্রতিবাদ হয় না। 
পাকিস্তানের সাথে উত্তেজনা তৈরি হলে সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, অস্ত্র আমদানিতে গতি আসবে, ফলে নেতাদেরও পকেটে বাড়তি রোজগার ঢুকবে। উল্টে বাংলাদেশের সাথে যুদ্ধের সম্ভাবনা নেই, তাই বেশি হইচইয়ের দরকার নেই। বরং বাংলাদেশ, শ্রীলংকা হল ভারতীয় শিল্পপতিদের কাছে সোনার খনি। তাই বেশি ঘাঁটানো যাবে না। তাই বিজেপি যতই হিন্দুত্বের জিগির তুলুক, বাংলাদেশ নিয়ে রা কাড়া যাবে না। শিল্পপতিরা যদি রেগে যায়। ভারত সরকারের কেউই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে রাষ্ট্রসংঘে টু শব্দটি করবে না। শ্রীলংকার জাফনা উপদ্বীপেও সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী কর্তৃক তামিল হিন্দুদের উপর অকথ্য নির্যাতন হলেও, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ দেখা যাবে না। শিল্পপতিরা ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্বহহীন হয়ে পড়বে যে।

ধার্মিক হয় বা অধার্মিক যেকোন অঞ্চলে ধর্মের নামে সংখ্যালঘু উৎপীড়ন হলে প্রতিবাদ করা উচিত। ভারতে মুসলিমদের উপর আঘাত নেমে এলে তার প্রতিবাদ যেমন জরুরি, ঠিক তেমনই দ্বিচারিতা ঝেড়ে বাংলাদেশ-পাকিস্তানে হিন্দু সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হলে তার প্রতিবাদও করা দরকার। মানুষকে ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে না ধরে মনুষ্য ন্যায় বিবেচ্য হলে ধর্মীয় হানাহানিও কমে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ