বাঁধন তোমার শক্ত যত বাঁধন তোমার টুটবে তত


"আপনারা বিশ্বাস করেন একজন সর্বশক্তিমান , সর্বত্রবিরাজমান , সর্বজ্ঞ ইশ্বর এই মহাবিশ্ব আর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তবে প্রথমে অনুগ্রহ করে আমাকে বলুন কেন তিনি এই দুঃখ, শোক আর অগুন্তি দুর্দশা ভরা পৃথিবীটার সৃষ্টি করেছেন যেখানে একটা মানুষও শান্তিতে নেই ?
অনুগ্রহ করে বলবেন না এটা তাঁর নিয়ম। যদি তিনি কোন নিয়মের নিগড়ে বাঁধা পড়ে থাকেন , তবে তিনি সর্বশক্তিমান নন। অনুগ্রহ করে বলবেন না এটা তাঁর ইচ্ছে। নেরো একটা রোম জ্বালিয়েছিলেন। তিনি একটা সীমিত সংখ্যক মানূষকে হত্যা করেছিলেন। তাঁর অসুস্থ আনন্দের জন্য অল্প কিছু বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাসে তাঁর জায়গা কোথায়? তাঁকে আমরা কিভাবে মনে রেখেছি? সব ধরণের অপমানজনক বিশেষণ তাঁর জন্য বরাদ্দ আছে। ইতিহাসের পাতার পর পাতা নেরোর নিন্দায় ব্যবহার করা ভর্তসনাপূর্ণ সমালোচনায় কালো হয়ে আছে। নেরো অত্যাচারী, নির্দয়, দুষ্ট, নীতিহীন ইত্যাদি। 
এক চেঙ্গিস খান আনন্দের খোঁজে কয়েক হাজার মানূষকে হত্যা করেছিলেন আর তাই আমরা ওই নামটাকেই ঘৃণা করি। এখন কি করে আপনি আপনার সর্বশক্তিমান, শ্বাশত নেরোকে যৌক্তিক ভাবেন যিনি প্রতিটি দিন , প্রতিটি মুহুর্তে তাঁর মানুষের অন্যায় হত্যার আমোদ-প্রমোদ চালিয়ে যাচ্ছেন ? কি করে আপনি তাঁর কীর্তিকলাপকে সমর্থন করেন যা মানুষের উপর নামিয়ে আনা নিষ্ঠুরতা আর দুর্দশার বিচারে চেঙ্গিস খানকেও ছাড়িয়ে যায় ? আমি প্রশ্ন করছি যে সর্বশক্তিমান কেন এই পৃথিবীর সৃষ্টি করেছিলেন যা একটা জীবন্ত নরক ছাড়া আর কিছুই নয় , একটা সবসময়ের তিক্ত অস্থিরতার জায়গা। কেন তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন যখন তাঁর তা না করারও ক্ষমতা ছিল ? আপনাদের কাছে এই প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর আছে ? আপনারা বলবেন যে তিনি পরের জন্মে অন্যায়কারীদের শাস্তি আর ভুক্তভোগীদের পুরস্কার দেবেন। বেশ , বেশ। একজন যিনি আপনাদের সারা দেহ আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করার পর যত্ন করে মোলায়েম আর আরামদায়ক মলম লাগিয়ে দেন তাঁকে আপনারা কতটা যৌক্তিক মনে করেন ? গ্ল্যাডিয়েটরদের দ্বন্ধযুদ্ধের আয়োজক আর সমর্থকরা আধপেটা সিংহের সামনে গ্ল্যাডিয়েটরদের ছুঁড়ে দিতেন। যদি গ্ল্যাডিয়েটররা এই ভয়ানক মৃত্যুর থাবা এড়াতে পারতেন , তবে তাঁদের ভাল করে যত্নআত্তি আর দেখভাল করা হত। তাই আমি প্রশ্ন করছি মানুষকেও কি এইধরনের আনন্দ পাওয়ার জন্য সৃষ্টি করা হয় নি ? তবে তাঁর আর নেরোর মধ্যে ফারাক কোথায় ?"
না উপরোক্ত বক্তব্য আমার নয়। দয়া করে গুলি চালাবেন না। ধর্মীয় গোড়ামির বিরদ্ধে সোচ্চারে এই বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন বিপ্লবী ভগৎ সিং। জানিনা এই স্বাধীন দেশে এই বক্তব্য রাখার জন্য তাঁর ফাঁসির পরেও হিন্দু মৌলবাদীরা এমনভাবে উল্লাস করত কি না! এই মহান বিপ্লবীর চরিত্রহননে নেমে পড়ত কি না!
গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যু ও কতিপয় পশুর দানবীয় উল্লাস আমাদের এমন ভাবতে বাধ্য করছে। যারা ভারতীয় সংস্কৃতির স্বঘোষিত ধ্বজাধারী তারা কিভাবে এক নিরীহ মহিলার মৃত্যুর পরেও আনন্দ প্রকাশ করতে পারেন!  গৌরী লঙ্কেশ জঙ্গি ছিলেন না। তিনি অস্ত্র হাতে নিয়ে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি।
তিনি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতারর উপর আস্থা রেখে বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক কন্নড় ট্যাবলয়েড 'গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকে' সম্পাদনা করতেন। আর এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে কলম যুদ্ধ জারি রেখেছিলেন। আর এই কারণেই তিনি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর চক্ষুশূল হয়েছিলেন। তিনিও পরিচিত মহলে খুনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সেই আশঙ্কাই সত্যি হল। ৫ সেপ্টেম্বর বেঙ্গালুরুতে নিজের বাড়িতেই বুলেটবিদ্ধ হলেন।
বেঙ্গালুরুর পুলিশ কমিশনার টি সুনীল কুমার বলেন, “মোট সাতটি বুলেট ছোঁড়া হয়েছিল গৌরীকে লক্ষ করে। চারটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বাড়ির দেওয়ালে লাগে। বাকি তিনটির মধ্যে দু’টি বুকে লাগে এবং একটি কপালে লাগে।” ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ চারটি কার্তুজ উদ্ধার করেছে।
গৌরী লঙ্কেশ বিজেপি ও আরএসএসের দক্ষিনপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে বরাবর সরব ছিলেন। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর বুলেটেই গৌরীর কলম চিরতরে রুদ্ধ করে দেওয়া হল। ঠিক যেমনভাবে ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোয় ধাবলকর, পানসারে,  কালবু্র্গিকে হত্যা করা হয়, গৌরীও সেই একইভাবে হামলার শিকার হলেন।
গোটা দেশ আজ প্রতিবাদে নেমেছে। এই বর্বর হামলার প্রতিবাদে সামিল আমরাও। কলমের যুদ্ধ কলমেই হোক। বুলেট-তরবারি-চাপাতি দিয়ে কলমকে কোনদিন রোখা যায় না। ইতিহাস সাক্ষী, এক কলম স্তব্ধ হলে শত সহস্র কলম গর্জে ওঠে। অস্ত্র বর্তমান প্রগতিকে সাময়িক রুখতে পারে, আর কলম দিয়ে ভবিষ্যতের ইতিহাস রচনা হয়। 
কলম যুদ্ধ জারি ছিল, জারি আছে, জারি থাকবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ