বাস্তবতার জাদু : তৃতীয় অধ্যায়।। কাজী মাহবুব হাসান



রিচার্ড ডকিন্স : দ্য ম্যাজিক অব রিয়েলিটি 

কেন এত বেশী বিচিত্র ধরনের জীব?

কোনো প্রাণি যেমন দেখতে, কেন তারা তেমন দেখতে হয় সেটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে নানা ধরনের পূরাণ কাহিনী – কিংবদন্তীর সেই গল্পগুলো ‘ব্যাখ্যা’ করেছে যেমন, কেন চিতাবাঘের গায়ে ফোটা ফোটা দাগ থাকে, কেন খরগোশের সাদা লেজ থাকে । কিন্তু খুব বেশী কোনো পূরাণ কাহিনী নেই যা কিনা পৃথিবীতে এই অসংখ্য ধরনের বৈচিত্রময় জীবদের অস্তিত্বের কারণের ব্যপারে কিছু ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছে। টাওয়ার অব বাবেল এর সেই ইহুদী পুরাণ কাহিনীর সমতুল্য আমি কোনো কিছু পাইনি, যা বহু ধরনের বৈচিত্রময় ভাষার উপস্থিতি ‘ব্যাখ্যা’ করেছিল। বহু দিন আগে, এই কাহিনী অনুযায়ী, সারা পৃখিবীর মানুষ একই ভাষায় কথা বলতো। সুতরাং তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে অনেক উচু একটি টাওয়ার নির্মাণ করেছিল, তারা আশা করেছিল সেই টাওয়ারটি যেন আকাশ স্পর্শ করে। কিন্তু ঈশ্বর ব্যপারটি লক্ষ্য করেছিলেন, এবং সবাই যে অন্য সবাইকে বুঝতে সক্ষম হচ্ছে বিষয়টি তার বিশেষ পছন্দ হয়নি। কারণ মানুষরা যদি সবাই সবার ভাষা বোঝে আর একসাথে কাজ করে, এরপরে তাহলে তারা কি না করতে পারে? সুতরাং তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তাদের ভাষাগুলোকে ‘বিশৃঙ্খল আর তালগোল পাকিয়ে’ দেবেন, যেন তারা একে অপরের কথা বুঝতে না পারে। সুতরাং এই পূরাণ কাহিনীটি বলছে, কেন পৃথিবীতে এত ভিন্ন ভিন্ন ভাষা আমরা দেখতে পাই এবং কেন, যখন মানুষ অন্য গোত্র বা দেশের মানুষের সাথে কথা বলতে চায়, তাদের কথা শুনলে পরস্পরের কাছে মনে মনে হয় অর্থহীন বকবকানী। যথেষ্ট অদ্ভুত ব্যপার ইংরেজী ব্যবল ( যার অর্থ অসংলগ্ন বা অর্থহীন কথা বলা বা বকবক করা) আর টাওয়ার অব বাবেল এর মধ্যে কোনে শব্দের উৎপত্তিগত যোগসূত্রতা নেই।

আমি একই ধরনের পূরাণ খুজে পাবো বলে আশা করেছিলাম, যা কিনা পৃথিবীতে নানা ধরনের বৈচিত্রময় জীবদের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করবে, কারণ প্রাণি ও ভাষা বিবর্তনের মধ্যে খানিকটা সদৃশ্যতা আছে, যেমনটি আমরা দেখবো। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এমন কোনো পুরাণ নেই যা সুনির্দিষ্টভাবে বহু বিচিত্র প্রাণিদের অতি বিশাল সংখ্যাটি ব্যাখ্যা করেছে। এটি বেশ বিস্ময়কর, কারণ পরোক্ষ প্রমাণ আছে যে আদিবাসী মানুষরা সেই বাস্তব সত্যটি সম্বন্ধে সচেতন ছিল যে বহু ধরনের প্রাণি আছে। ১৯২০ এর দশকে, এখন অত্যন্ত বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী, আর্নস্ট মায়ার পাপুয়া নিউ গিনির হাইল্যাণ্ডে পাখিদের নিয়ে যুগান্তকারী একটি গবেষণা করেছিলেন। তিনি প্রায় ১৩৭ প্রজাতির বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন, এবং এরপর তিনি আবিষ্কার করেন, অবশ্যই বিস্ময়ের সাথে, স্থানীয় পাপুয়া আদিবাসীদের কাছে এই ১৩৬ পাখির জন্য আলাদা আলাদা নাম আছে।

আবার পুরাণে ফিরে যাই। উত্তর আমেরিকার হপি গোত্রের আদিবাসীদের এক দেবী ছিলেন, যার নাম স্পাইডার উওম্যান। তাদের সৃষ্টিতত্ত্বের পূরাণে, এই দেবী সূর্য দেবতা তাওয়ার সাথে জোট বেধেছিলেন, এবং প্রথমে তাদের জাদুকরী গান গেয়েছিলেন দ্বৈতভাবে। এই গানটি সৃষ্টি করেছিল পৃথিবী, জীবন। স্পাইডার উওম্যান এরপর তাওয়ার চিন্তার সুতোগুলোকে নিয়ে বুনে রুপ দিয়েছিলেন মাছ, পাখি এবং অন্য সব প্রাণিদের।

উত্তর আমেরিকার অন্য গোত্রগুলো যেমন পুয়েবলো আর নাভাহো আদিবাসীদের একটি পুরাণ কাহিনী আছে যার সাথে বিবর্তনের খুব সামান্য কিছু মিল আছে: পৃথিবী থেকে জীবন বেরিয়ে এসেছিল যেমন করে কোনো বিকাশমান উদ্ভিদ বেড়ে ওঠে ধারাবাহিক কিছু ধাপের অনুক্রমে। পোকামাকড়রা তাদের জগত, প্রথম বা লাল বিশ্ব থেকে, উপরে উঠে আসে দ্বিতীয় বিশ্বে, নীল বিশ্ব, যেখানে পাখিদের বাস। দ্বিতীয় বিশ্ব এরপর আরো বেশী জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে, সেকারণে পাখিরা আর কীটপতঙ্গরা উড়ে যায় তৃতীয় জগতে বা হলুদ বিশ্বে যেখানে মানুষ আর স্তন্যপায়িদের বাস। এর পর হলুদ বিশ্বও ক্রমে জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে, খাদ্যের ঘাটতি দেখা যায়, এবং সবাই চতুর্থ বিশ্বে উঠে আসে, সাদা আর কালো বিশ্বে, দিন ও রাতের বিশ্ব। এখানে দেবতারা ইতিমধ্যেই বুদ্ধিমান মানুষদের সৃষ্টি করে রেখেছিলেন, যারা জানতো কিভাবে চতুর্থ বিশ্বে চাষাবাদ করা যায়, এবং তারা নবাগতদের শিখিয়েছিল কিভাবে শস্য উৎপাদন করতে চাষাবাদ করতে হয়।

ইহুদীদের সৃষ্টি পূরাণ জীববৈচিত্রতার ব্যাপারে খানিকটা সুবিচার করেছে বলা যেতে পারে, তবে এটি ব্যাখ্যা করার কোনো চেষ্টা করেনি। আসলেই, হহুদীদের পবিত্র গ্রন্থে দুটি ভিন্ন সৃষ্টিতত্ত্ববাদের পূরাণ আছে, যেমনটি আমরা এর আগের অধ্যায়ে দেখেছিলাম। প্রথমটিতে, ঈশ্বর সবকিছুরই মাত্র ছয়দিনে সৃষ্টি করেন। পঞ্চম দিনে তিনি মাছ, তিমি ও অন্য সামুদ্রিক প্রাণিদের সৃষ্টি করেন, এছাড়াও আকাশে ওড়া পাখি। ষষ্ঠ দিনে তিনি বাকী সব স্থলবাসী প্রাণিদের সৃষ্টি করেন মানুষ সহ। পুরাণের ভাষা কিছুটা নজর দিয়েছিল জীবিত প্রাণিদের সংখ্যা ও তাদের বৈচিত্রময়তা ব্যাখ্যা করার জন্য।

যেমন, ‘ঈশ্বর সৃষ্টি করেছিলেন বিশাল তিমিদের এবং প্রতিটি জীবিত প্রাণি যারা নড়াচড়া করে, পানি যা জন্ম দিয়েছিল প্রচুর পরিমানে তাদের সেই নানা প্রকারের, এবং প্রতিটি ডানাওয়ালা পাখিদের আলাদা করে। এবং সৃষ্টি করেছেন, ‘পৃথিবীর প্রতিটি জন্তু’ এবং ‘সব কিছু যা পৃথিবীর উপর হামাগুড়ি দিয়ে চলে’। কিন্তু কেন এই বৈচিত্রময়তা? আমাদের সেটি বলা হয়নি।

দ্বিতীয় পূরাণে আমরা কিছুটা আভাস পাই যে ঈশ্বর হয়তো ভেবেছিলেন যে প্রথম মানুষের বিচিত্র ধরনের সঙ্গীর দরকার আছে। অ্যাডাম, প্রথম মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছিল একা, এবং তাকে সুন্দর স্বর্গোদ্যানে রাখা হয়েছিল, কিন্তু তারপর ঈশ্বর অনুধাবন করলেন যে, মানুষের একা থাকা উচিৎ না। ‘সুতরাং তিনি স্থলে প্রতিটি প্রাণি আরা আকাশে প্রতিটি পাখি সৃষ্টি করলেন এবং তাদের অ্যাডামের কাছে নিয়ে আসেন দেখাতে, কি নামে সে তাদের ডাক’।

কিন্ত আসলেই … এত বিচিত্র ধরনের প্রাণি কেন?

সব প্রাণির নাম দেয়ার কাজটি স্পষ্টতই বেশ কঠিন ছিল – প্রাচীন হিব্রুদের পক্ষে যতটুকু বোঝা সম্ভব হয়েছিল তার চেয়ে বেশী। অনুমান করা হয় প্রায় ২ মিলিয়ন প্রজাতিকে আপাতত আমরা বৈজ্ঞানিক নাম দিতে পেরেছি, এবং এটি যে প্রজাতিদের এখনও বৈজ্ঞানিক নাম দেয়া সম্ভব হয়নি তার খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ।

কিন্তু আমরা কিভাবে সিদ্ধান্ত নেই যে দুটি জীব একই প্রজাতির সদস্য, নাকি তারা দুটি ভিন্ন প্রজাতির ? যে জীবরা যৌন প্রজনন করে, সেখানে আমারা একটা সংজ্ঞা প্রস্তাব করতে পারি। জীবরা ভিন্ন প্রজাতির যদি তারা পরস্পরের সাথে প্রজনন করতে না পারে। কিন্তু ব্যতিক্রম আছে যেমন, ঘোড়া আর গাধা, যারা পরস্পরের সাথে প্রজনন করতে পারে, এবং সন্তানও জন্ম দিতে পারে ( যাদের বলা হয় মিউল বা হিনিস – খচ্চর) তবে তারা অনুর্বর, তার মানে এরা নিজেরা কোনো সন্তানের জন্ম দিতে পারেনা। আমরা সেকারণে ঘোড়া আর গাধাকে ভিন্ন প্রজাতিতে শ্রেণীভুক্ত করেছি। আরো সুস্পষ্ট উদহারণ যেমন ঘোড়া আর কুকুররা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির সদস্য কারণ তারা এমনকি চেষ্টাও করেনা নিজেদের মধ্যে প্রজনন করতে, এবং যদি তারা সেটি করেও তারা কোনো সন্তান জন্ম দিতে পারবেনা, এমনকি অনুর্বর কোনো সন্তানও। কিন্তু স্প্যানিয়েল আর পুডলস জাতের কুকুর একটি প্রজাতির সদস্য কারণ নিজের মধ্যে সহজেই প্রজনন করতে পারে, এবং তাদের সন্তানও উর্বর, অর্থাৎ তারাও সন্তানের জন্ম দিতে পারবে।

প্রতিটি জীবের বৈজ্ঞানিক নামে দুটি ল্যাটিন শব্দ আছে, সাধারণত ইটালিক রুপে লেখা হয়। প্রথম শব্দটি হচ্ছে জিনাস বা গণ বা প্রজাতিদের গ্রুপ ইঙ্গিত করে এবং দ্বিতীয় শব্দটি সেই জিনাসের মধ্যে নির্দিষ্ট প্রজাতিকে নির্দেশ করে। হোমো সেপিয়েনস (Homo sapiens – জ্ঞানী মানুষ) আর এলিফাস ম্যাক্সিমাস (Elephas maximus -খুব বড় হাতি) যেমন উদহারণ। প্রতিটি প্রজাতি একটি জিনাসের (গণ) সদস্য। হোমো হচ্ছে একটি জিনাস, তেমনি এলিফাসও। সিংহ হচ্ছে প্যানথেরা লিও (Panthera leo) এবং জিনাস প্যানথেরার মধ্যে আছে প্যানথেরা টাইগ্রিস (Panthera tigris) (বাঘ),প্যানথেরা পারদুস ( Panthera pardus) ( চিতাবাঘ বা প্যানথার) এবং প্যানথেরা ওনকা (Panthera onca) ( জাগুয়ার)। আমাদের হোমো জিনাসে কেবল একটি প্রজাতি এখনও বেঁচে আছে, কিন্তু জীবাশ্মদের যেমন নাম দেয়া হয়েছে হোমো ইরেকটাস (Home erectus) এবং হোমো হ্যাবিলিস (Homo habilis)। অন্য মানব সদৃশ্য জীবাশ্মগুলো হোমো থেকে যথেষ্ঠ পরিমানে ভিন্ন যে তাদের ভিন্ন একটি জিনাসে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে, যেমন অষ্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানাস (Australopithecus africanas) এবং অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেনসিস (Australopithecus afarensis) ( না..অস্ট্রেলিয়ার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, প্রসঙ্গক্রমে অস্ট্রালো মানে দক্ষিণের, অস্ট্রেলিয়া নামটাও সেখান থেকেই এসেছে।)

প্রতিটি জিনাস একটি পরিবার বা ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত, সাধারণ রোমান হরফে বড় হাতের প্রথম অক্ষরসহ এটি লেখা হয়। ক্যাটস বা বিড়ালরা ( যার মধ্যে আছে সিংহ, চিতাবাঘ, লিঙ্কস এবং আরো অনেক ছোট আকারের বিড়াল) মিলে ফেলিডি (Felidae) পরিবার তৈরী করে। প্রতিটি পরিবার আবার একটি অর্ডার বা বর্গের সদস্য। বিড়াল, কুকুর, ভালুক, উইজেল, হায়েনা এরা ভিন্ন ফ্যামিলির হলেও তারা সবাই কার্নিভরা (Carnivora) অর্ডারের সদস্য। বানর, এইপ ( আমরা সহ) এবং লেমুররা সব ভিন্ন ভিন্ন ফ্যামিলির তবে প্রাইমেট (Primate) অর্ডারের। এবং প্রতিটি অর্ডার আবার একটি ক্লাস বা শ্রেণীর সদস্য, সব স্তন্যপায়ীরা ম্যামালিয়া (Mammalia) শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।

আপনি কি দেখতে পারবেন একটি গাছের ধারণা আপনার মনে মধ্যে গড়ে উঠছে যখন আপনি শ্রেণীবিন্যাসের বিবরণটি পড়ছিলেন? এটাই পারিবারিক বৃক্ষ – একটি গাছ যার বহু শাখা আছে, প্রতিটি শাখার আছে উপশাখা, প্রতিটি প্রশাখাও আবার বিভক্ত বেশ কয়েকটি ধাপে। প্রতিটি ডালের শেষ মাথাগুলো হচ্ছে প্রজাতি। অন্য গ্রুপিং, শ্রেণী বর্গ, পরিবার, গণ হচ্ছে শাখা, প্রশাখা উপশাখা। পুরো বৃক্ষটাই পৃথিবীর সমস্ত জীবনের প্রতিনিধিত্ব করছে।

চিন্তা করে দেখুন গাছটিতে এত বেশী শাখা প্রশাখা কেন? শাখাগুলোও উপশাখায় বিভাজিত । যখন আমাদের যথেষ্ঠ পরিমান শাখার শাখার শাখা হবে, তাহলে গাছের ছোট ডালের সংখ্যাও অনেক বেশী হবে। বিবর্তনে সেটাই ঘটে। চার্লস ডারউইন নিজে একটি শাখা বিভাজিত হওয়া গাছ এঁকেছিলেন, তার বিখ্যাত অন দি অরিজিন অব স্পিসিস বইয়ে একমাত্র ছবি হিসাবে। এর একটি প্রাথমিক সংস্করণ তিনি এঁকেছিলেন কয়েক বছর আগে তার নোটবুকে। পৃষ্ঠার উপর সেখানে তিনি রহস্যময় একটি ছোট বার্তা লিখেছিলেন তার নিজের জন্য: আই থিঙ্ক। আপনি কি ভাবেন তিনি কি বোঝাতে চেয়েছিলেন এই বাক্যটি দিয়ে? হয়তো তিনি কোনো একটি বাক্য লিখতে শুরু করেছিলেন এবং তার ছেলে মেয়েদের কেউ এসে বিরক্ত করায় হয়তো বাক্যটি তিনি লিখে শেষ করতে পারেননি।

হয়তো এই বাক্যটাকে শব্দের চেয়ে সহজ মনে হয়েছিল তার তিনি ডায়াগ্রামটিকে নিয়ে কি ভাবছেন তা প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। হয়তো আমরা কখনোই তা জানবো। সেই পৃষ্ঠায় আরো একটি হাতের লেখা আছে, কিন্তু সেটি মর্মোদ্ধার করা বেশ কঠিন। মহান বিজ্ঞানীদের সত্যিকার নোটগুলো পড়া লোভনীয়, যা হয়তো কোনো বিশেষ দিনে তিনি লিখে রেখেছিলেন নিজের জন্য, প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে নয়।

পরের অংশটি কিভাবে জীবদের এই গাছটি শাখা প্রশাখায় বিভাজিত হয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে সেটি আলোচনা করবে না, কিন্তু আপনাকে মূলনীতি সম্বন্ধে একটি ধারণা দেবে। কল্পনা করুণ একটি আদি পূর্বসূরি প্রজাতি বিভাজিত হয়েছে দুটি প্রজাতিতে। এরপর যদি সেই প্রজাতি দুটি আরো দ্বিবিভাজিত হয় তাহলে সংখ্যা দাড়াবে চার। তাদের প্রত্যেকটি যদি দ্বিবিভাজিত হয় তাহলে হবে আটটি, এভাবে ১৬,৩২,৬৪,১২৮,২৫৬, ৫১২ ..; আপনি দেখতে পারছেন যে যদি এই দ্বিগুণ হওয়া আপনি অব্যহত রাখেন, খুব বেশী সময় লাগবেনা মিলিয়ন সংখ্যক প্রজাতিতে পৌছাতে। হয়তো বিষয়টি আপনি বুঝতে পারছেন, কিন্তু আপনি হয়তো ভাবছেন, কেন একটি প্রজাতি বিভাজিত হবে। বেশ, এটি অনেকটাই মানব ভাষা যেকারণে বিভাজিত হয়েছে সেই একই কারণে, তাহলে আসুন একটি বিরতি নেই সেই বিষয়টি নিয়ে ভাবার জন্য।

পার্থক্য সৃষ্টি ; কিভাবে ভাষা, এবং প্রজাতি বিভাজিত হয়

যদিও টাওয়ার অব বাবেলের কিংবদন্তীর কাহিনী আসলেই সত্যি নয়, কিন্তু এটি বেশ কৌতুহোদ্দীপক একটি প্রশ্ন উত্থাপন করে, কেনই বা এত বেশী ভিন্ন ভিন্ন ভাষার অস্তিত্ব আছে পৃথিবীতে। ঠিক যেমন কিছু প্রজাতি অন্যদের চেয়ে বেশী পরস্পর সদৃশ এবং তাদের শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে একই ফ্যামিলি বা পরিবারে, ভাষার ক্ষেত্রেও ঠিক এমন পরিবার আছে, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, পর্তুগীজ, ফরাসী এবং বহু ইউরোপিয় ভাষা এবং ভাষাভঙ্গি যেমন রোমান্স, গ্যালিসিয়ান, অক্টিয়ান এবং কাটালান প্রত্যেকটি ভাষাই পরস্পর সদৃশ। আজ একসাথে এগুলোকে বলে রোমান্স ভাষা পরিবার। এই নামটি আসলে এসেছে ল্যাটিন থেকে তাদের সাধারণ উৎপত্তির কারণে, রোমের যা ভাষা ছিল। না, সেই রোমান্সের সাথে এর কোনো যোগসূত্রতা নেই। কিন্তু আসুন ভালোবাসার একটি অভিব্যক্তিকে আমরা ব্যবহার করি আমাদের উদহারণ হিসাবে। আপনি কোন দেশে বাস করেন তার উপর নির্ভর করবে উল্লেখিত এই উপায়গুলোর কোনটি আপনি ব্যবহার করতে পারেন আপনার একান্ত সেই অনুভূতিটি ঘোষণা করার জন্য: `Ti amo’, `Amote’, `T’aimi বা Je t’aime । ল্যাটিন ভাষায় এটি হবে `Te amo’ – ঠিক আধুনিক স্প্যানিশ ভাষার মতই।

তানজানিয়া বা উগাণ্ডায় যদি আপনি কাউকে ভালোবাসার অঙ্গীকার করেন,তিনি বলতে পারেন, সোয়াহিলি ভাষায়, ‘Nakupenda’, আরো দক্ষিণে মোজাম্বিক, জাম্বিয়ায় বা মালাওয়ি, যেখানে আমার শৈশব কেটেছে, আপনাকে হয়তো চিনইয়ানযা ভাষায় কথা বলতে হবে, ‘Ndimakukonda’। অন্য তথাকথিত বান্টু ভাষায় দক্ষিণ আফ্রিকায় আপনি হয়তো বলবেন ‘Ndinokuda’, ‘Ndiyakuthanda’ অথবা কোনো জুলুকে ‘Ngiyakuthanda’। এই বান্টু পরিবারে ভাষাগুলো খুবই আলাদা রোমান্স পরিবারের ভাষাগুলো থেকে, আবার এই দুই পরিবার খুব আলাদা জার্মানিক পরিবারের ভাষাগুলো থেকে, যেমন ডাচ, জার্মান এবং স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ার ভাষাগুলো। দেখুন কিভাবে আমরা ফ্যামিলি শব্দটি ব্যবহার করছি, ঠিক যেভাবে প্রজাতির জন্য ব্যবহার করেছি ( বিড়াল বা ক্যাট পরিবার, কুকুর পরিবার) এবং অবশ্যই আমাদের নিজেদের পরিবারগুলো ( যেমন – জোনস পরিবার, রবিনসন পরিবার, ডকিন্স পরিবার)।

খুব কঠিন কিন্তু না না সমধান করা কিভাবে একই পরিবারের কাছাকাছি ভাষাগুলো উদ্ভব হয়েছে কয়েক শতাব্দী সময় ধরে। ভালো করে শুনুন কিভাবে আপনি ও আপনার বন্ধু কথা বলেন, এবং এটি তুলনা করুন কিভাবে আপনার দাদা দাদী কথা বলতেন, তাদের ভাষা সামান্য খানিকটা আলাদা এবং আপনি খুব সহজে তাদের বুঝতে পারতেন, তারা মাত্র দুটি প্রজন্ম দূরের। আর এবার কল্পনা করুন, আপনার দাদা দাদী নয় আপনার ২৫ তম প্র পিতামহ ও পিতামহীর ভাষা। আপনি যদি ইংরেজ হন, তাহলে সেটি আপনাকে নিয়ে যাবে চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে, জিওফ্রে চসারের জীবদ্দশায়, যিনি এমন কিছু লিখেছিলেন

He was a lord ful fat and in good poynt;

His eyen stepe, and rollynge in his heed,

That stemed as a forneys of a leed;

His bootes souple, his hors in greet estaat.

Now certeinly he was a fair prelaat;

He was nat pale as a forpyned goost.

A fat swan loved he best of any roost.

His palfrey was as broun as is a berye

বেশ, এটি যে ইংলিশ সেটি তো শনাক্ত করা যাচ্ছে, তাই না? তবে আমি বাজি রাখতে পারবো যে আপনার এটি বুঝতে বেশ কষ্টই হবে যদি এটি কাউকে বলতে শোনেন। এবং যদি এটি আরেকটু বেশী ভিন্ন হতো তাহলে আপনি হয়তো এটিকে ভিন্ন একটি ভাষা হিসাবে মনে করতেন, ভিন্ন কোনো ভাষা, যেমন ইতালিয় ভাষা থেকে স্প্যানিশ ভাষা।

সুতরাং, কোনো একটি এলাকায় ভাষা পরিবর্তিত হয় বহু শতাব্দী ধরে, আমরা বলতে পারি এটি ক্রমশ পরিবর্তিত হয় ভিন্ন কিছুতে। এবার সেই বাস্তব সত্যটি যোগ করুন, যে মানুষ যারা বিভিন্ন জায়গায় বাস করে, কিন্তু কথা বলে একই ভাষায় প্রায়শই তাদের সুযোগ থাকে পরস্পরের কথা শোনার ( অথবা নিদেনপক্ষে তারা সেই সুযোগ পায়নি টেলিফোন বা রেডিও আবিষ্কারের আগে); এবং আরো একটি বাস্তব সত্য যে, ভাষা পরিবর্তিত হয় একেক জায়গায় একেক ভাবে। শব্দগুলো যেমন পরিবর্তিত হয়, তেমনি সেগুলো কেমন ভাবে উচ্চারিত হয় এটি তার উপর একইভাবে প্রভাব ফেলে। চিন্তা করে দেখুন ইংরেজী কত ভিন্ন স্কটল্যাণ্ড, ওয়েলশ, জিওরর্ডি, কর্নিশ, অস্ট্রেলিয়া অথবা আমেরিকার উচ্চারণ ভঙ্গিতে। এবং স্কটল্যাণ্ডের কেউ অনায়াসে আলাদা করতে পারবে এডিনবরা, গ্লাসগো অথবা হেবরিডিয়ান উচ্চারণভঙ্গিগুলোর মধ্যে। সময়ের সাথে, কিভাবে ভাষাটি বলা ও শব্দগুলো উচ্চারিত হচ্ছে, সেটি কোনো একটি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যসূচক হয়ে ওঠে। যখনই একই ভাষা দুই ভাবে বলার উপায়টি যথেষ্ঠ দূরে সরে যায়, আমাদের তাদের ভিন্ন ধরনের ডায়ালেক্ট বা উপ কিংবা আঞ্চলিক ভাষা হিসাবে চিহ্নিত করি।

বহু শতাব্দীর পৃথকীকরণের পরে, বিভিন্ন এলাকার উপভাষাগুলো অবশেষে ধীরে ধীরে এত বেশী আলাদা হয়ে যায়, কোনো একটি এলাকার মানুষ অন্য এলাকার মানুষের ভাষা আর বুঝতে পারেনা। এই পর্যায়ে আমরা তাদের পৃথক ভাষা হিসাবে চিহ্নিত করি। এটাই ঘটেছিল যখন জার্মান আর ডাচ ভাষা আলাদা হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন দিকে, এখন বিলুপ্ত কোনো পূর্বসূরি ভাষা থেকে। এবং এটাই ঘটেছিল ফরাসী, ইতালীয় ও পর্তূগীজ ভাষার সাথে স্বতন্ত্রভাবে, যখন তারা ল্যাটিন থেকে ক্রমশ সরে গিয়েছিল ইউরোপের পৃথক পৃথক এলাকায়। যদি আপনি ভাষার কোনো পারিবারিক বৃক্ষ আকেন, ফরাসী, পর্তুগীজ আর ইতালীয় সম্পর্কিত ভাষাগুলো কাছাকাছি শাখায় অবস্থান করবে এবং ল্যাটিনের মত পূর্বসূরিরা থাকবে গাছের আরো ভিতরের দিকে, ঠিক যেমন ডারউইন প্রজাতিদের সাথে করেছিলেন।

ভাষার মতই প্রজাতিও সময়ে সাখে এবং দূরত্বের সাথে পরিবর্তিত হয়। আর কেন এমন ঘটে সেটি দেখার আগে, আমাদের দেখতে হবে কিভাবে তারা কাজটি করে। প্রজাতির ক্ষেত্রে ‘শব্দের’ সমতূল্য হচ্ছে ডিএনএ, সেই জিনগত তথ্য, যা প্রতিটি জীব তাদের কোষে বহন করে যেখানে এটি নির্ধারণ করে, কিভাবে জীবটি তৈরী করা হবে। আমরা যেমন দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখেছি। যখন কোনো সদস্য যৌন প্রজনন করে, তারা তাদের ডিএনএ গুলোর মিশ্রণ করে। যখন একটি জনগোষ্ঠীর আরেকটি জনগোষ্ঠীর সাথে মিশ্রিত হয় তারা তাদের জিনগুলো সেই জনগোষ্ঠীতে অনুপ্রবেশ করায় নতুন জনগোষ্ঠীর কোনো সদস্যের সাথে প্রজননের মাধ্যমে। আমরা একে বলি ‘জিন ফ্লো বা জিন প্রবাহ’।

সমতুল্য কিছু, যেমন ধরুন, ইতালীয় ও ফরাসীরা পৃথক হয়েছে এত দূরে যে, দুটি ভিন্ন জনগোষ্ঠীর ডিএনএ ক্রমেই সদৃশ্যতা হারিয়েছে সময়ের সাথে। তাদের ডিএনএ পরস্পরের সাথে ক্রমেই কাজ করার জন্য অসামঞ্জষ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে কোনো সন্তান তৈরীর করার জন্য। ঘোড়া ও গাধারা পরস্পরের সাথে প্রজনন করতে পারে, কিন্তু ঘোড়ার ডিএনএ গাধার ডিএনএ থেকে এতটাই দূরে সরে গেছে যে তারা আর নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করতে পারেনা, বা বরং বলা উচিৎ যথেষ্ঠ ভালোভাবে মিশ্রিত হতে পারেনা – ডিএনএ এর দুটি ‘ডায়ালেক্ট’ মোটামুটি মিশ্রিত হতে পারে – একটি জীবিত প্রাণি সৃষ্টি হয় – মিউল (খচ্চর), কিন্তু তারা যথেষ্ঠ ভালোভাবে মিশ্রিত হয়না এমন প্রজন্ম সৃষ্টি করতে যারা সফল প্রজনন করতে পারে, যেমনটি আমরা দেখেছি, এরা উর্বর নয়।

প্রজাতি আর ভাষার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হচ্ছে, কোনো একটি ভাষা অন্য একটি ভাষা থেকে শব্দ ধার করতে পারে, পুরোপুরি স্বতন্ত্র ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবার বহু পরেও। রোমান্স, জার্মানিক এবং কেল্টিক ভাষা থেকে যেমন আলাদা হবার বহু দিন পরও ইংরেজী ভাষা বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ সংগ্রহ করেছে। ইংলিশ ভাষা হিন্দী থেকে Shampoo শব্দটি, নরওয়ের ভাষা থেকে Iceberg, বাংলা থেকে Bungalow, ইনুয়িট থেকে Anorak ইত্যাদি। প্রাণি প্রজাতিরা এর ব্যতিক্রম কখনোই আর ডিএনএ বিনিময় করেনা, একবার যখন তারা যথেষ্ঠ পরিমান দুরে চলে যায়, তারা পরস্পরের সাথে প্রজননও বন্ধ করে দেয়। ব্যাকটেরিয়াদের কাহিনী অবশ্য ভিন্ন, তারা জিন বিনিময় করে, কিন্তু এই বইয়ে সেটি নিয়ে আলোচনা করার মত যথেষ্ঠ জায়গা নেই, অধ্যায়ের বাকী অংশে মনে করুন আমরা শুধু প্রাণিদের নিয়ে কথা বলছি।

দ্বীপ এবং বিচ্ছিন্নতা: পৃথকীকরণের শক্তি

সুতরাং প্রজাতির ডিএনএ, ভাষার শব্দের মত, যখন পৃথক হয়ে পড়ে তারা ক্রমেই দূরে সরে যায়। কেন এটা ঘটে? কিন্তু পৃথকীকরণ প্রক্রিয়াটি শুরু করতে পারে কি? একটি সুস্পষ্ট সম্ভাবনা হচ্ছে সমুদ্র। পৃথক পৃথক দ্বীপের প্রাণি জনগোষ্ঠীর সদস্যদের পরস্পরের সাথে দেখা হয় না – অন্তত সচরাচর বিষয়টি ঘটে না – সুতরাং দুই সেট জিনের সুযোগ থাকবে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে সরে যাবার। এই বিষয়টি দ্বীপদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে নতুন প্রজাতির উৎপত্তির জন্য। কিন্তু আমরা কোনো দ্বীপকে চারিদিকে পানি দিয়ে ঘেরা একটুকরো ভূখণ্ড ছাড়াও আরো বেশী কিছু বা অন্যভাবে ভাবতে পারি। কোনো ব্যঙের জন্য একটি মরুদ্যাণই হচ্ছে দ্বীপ, কোনো মাছের জন্য একটি হৃদ হচ্ছে একটি দ্বীপ। দ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ, প্রজাতি কিংবা ভাষার জন্য, কারণ কোনো একটি দ্বীপে জনগোষ্ঠী অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শ থেকে সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন ( প্রজাতির ক্ষেত্রে যা জিন ফ্লো বা জিন প্রবাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে, ঠিক যেভাবে এটি ভাষার ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া ঠেকায়), সুতরাং এটি মুক্ত একটি নিজস্ব দিকে বিবর্তিত হবার জন্য।

এর পরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে কোনো একটি দ্বীপে জনগোষ্ঠীকে আবশ্যিকভাবে পূরোপুরিভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে না চিরকালের জন্য। কখনো কখনো জিন সেই সীমারেখাটি অতিক্রমও করে, সেটি পানি হোক কিংবা বসবাসযোগ্য নয় এমন কোনো ভূমি। ১৯৯৫ সালের ৪ অক্টোবর, কিছু উপড়ে পড়া গাছ আর গাছের গুড়ির একটি ভেলা আনগুইলা নামের একটি ক্যারিবিয়ান দ্বীপের বেলাভূমিতে এসে পৌছেছিল। এই ভেলায় ছিল পনেরোটি সবুজ ইগুয়ানা; আরেকটি দ্বীপ, ১৬০ কিলোমিটার দূরে সম্ভবত গুয়াদেলুপ থেকে এর বিপদসংকুল একটি যাত্রা শেষে তারা জীবিতও ছিল। দুটি ঘুর্ণিঝড়, লুইস আর মেরিলিন, এর আগের মাসেই ক্যারিবিয়ান সাগরের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল, প্রচুর গাছ উপড়ে তাদের সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দিয়ে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এই ঝড় এমন কিছু গাছ ভেঙ্গে ফেলেছিল, যে গাছে ইগুয়ানারা বসে ছিল ( তারা গাছে চড়তে খুব ভালোবাসে, আমি পানামায় দেখেছিলাম), সেই গাছগুলোই উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল সমূদ্রে। অবশেষে তারা আনগুইলায় এসে পৌছায়, তাদের সেই অপ্রচলিত বাহন থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে এসে ইগুয়ানারা বেলাভূমিতে, এবং নতুন জীবন শুরু করেছিল, খাদ্য সংগ্রহ, প্রজনন এবং তাদের ডিএনএকে নতুন দ্বীপের বাসভূমিতে ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমে।

আমরা জানি এটি ঘটেছিল কারণ আনগুইলাতে এই ইগুয়ানাদের আসার ব্যপারটি দেখেছিল স্থানীয় মাঝিরা। বহু শতাব্দী আগে, যদিও সেই ঘটনার স্বাক্ষ্য দেবার মত কেউ তখন ছিলনা, এরকমই কোনো ঘটনা ঘটেছিল প্রায় নিশ্চিৎভাবে বলা যায়, যখন ইগুয়ানার পূর্বসূরিরা গুয়াদেলুপে এসে তাদের প্রথম বসতি গড়েছিল। এবং এরকমই কোনো ঘটনা প্রায় নিশ্চিৎভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারে গালাপাগোস দ্বীপের ইগুয়ানাদের উপস্থিতিকেও। আমাদের গল্পের পরের ধাপে আমরা তাদের কথাই আলোচনা করবো।

গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই দ্বীপগুলোই সম্ভবত চার্লস ডারউইনকে প্রথম অনুপ্রাণিত করেছিল বিবর্তন নিয়ে তার ভাবনায়, যখন এইচএমএস বিগলের একটি অভিযাত্রী হিসাবে তিনি সেখানে পা রেখেছিলেন ১৮৩৫ সালে। এটি মূলত একগুচ্ছ আগ্নেয় দ্বীপ, দক্ষিণ আমেরিকার উপকুল থেকে ৬০০ মাইল পশ্চিমে বিষুব রেখার কাছে প্রশান্ত মহাসাগরে এর অবস্থান। এগুলো প্রত্যেকটি নবীন ( মাত্র অল্প কয়েক মিলিয়ন বছর প্রাচীন), এগুলো তৈরী হয়েছিল সাগরের তলদেশে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে। এর মানে সব জীব, প্রাণি ও উদ্ভিদ এই দ্বীপগুলোয় বসতি গড়েছে অন্য কোনো জায়গা থেকে, খুব সম্ভবত দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে – বিবর্তনের সময়ের মাণদণ্ডে অতি সম্প্রতি কোনো সময়ে। একবার এখানে এসে বসতি গড়ার পর, প্রজাতিরা এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে অপেক্ষাকৃত কম দূরত্ব অতিক্রম করতে পেরেছিল, আর সেটি ঘটেছিল যথেষ্ঠ প্রায়শই ( হয়তো প্রতি শতাব্দীতে অথবা তেমন কোনো সময়ে এক বার বা দুইবার) কিন্তু যথেষ্ট পরিমানে কম একটি হারে, যে তারা পৃথকভাবে বিবর্তিত হতে পেরেছে – ক্রমশ পৃথক হয়েছে যেমন আমরা বলেছিলাম এই অধ্যায়ে – এই কদাচিৎ এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাবার মধ্যবর্তী সময় বিরতিতে।

কেউ জানে না কখন প্রথম ইগুয়ানারা গালাপাগোস দ্বীপে এসেছিল। সম্ভবত তারা কোনো কিছুতে ভেসে এসেছিল মূল ভূখণ্ড থেকে ঠিক যেমন করে ১৯৯৫ সালে আনগুইলাতে তারা এসেছিল। এখন মূল ভূখণ্ডের খুব কাছে নিকটবর্তী দ্বীপটির নাম সান ক্রিস্টোবাল (ডারউইনের সময় এটি পরিচিত ছিল এর ইংরেজী নাম চ্যাটহাম নামে), কিন্তু বহু মিলিয়ন বছর আগে আরো আরো অনেক দ্বীপও ছিল, যারা এখন সাগরে পানির নীচে ডুবে গেছে। ইগুয়ানারা হয়তো প্রথম এসেছিল এখন ডুবে যাওয়া কোনো দ্বীপে, এরপর তারা অন্য দ্বীপে পৌছেছিল মধ্যবর্তী দূরত্ব অতিক্রম করে, যাদের মধ্যে সেগুলো ছিল, যারা এখনও পানির উপর ভেসে আছে। একবার পৌছানোর পর, তারা সুযোগ পেয়েছিল একটি নতুন জায়গা পূর্ণ বিকশিত হবার জন্য, ঠিক যেমন ১৯৯৫ সালে আনগুইলাতে পৌছানো ইগুয়ানা করেছিল। গালাপাগোসের প্রথম ইগুয়ানারা বিবর্তিত হয়ে ভিন্ন হয়েছে মূল ভূখণ্ডের তাদের আত্মীয় প্রজাতি থেকে। আংশিকভাবে শুধু দূরে সরে যাওয়ার মাধ্যমে (ভাষার মত) আর আংশিকভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে, যা টিকে থাকার নতুন কৌশলকে সহায়তা করেছিল: তুলনামূলকভাবে অনুর্বর আগ্নেয় দ্বীপে, যা দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে খুব ভিন্ন।

এই দ্বীপপুঞ্জে প্রতিটি দ্বীপের নিজেদের মধ্যে দূরত্ব অনেক কম, তাদের যে কোনো একটির মূল ভূখণ্ডের থেকে যা দূরত্ব তার চেয়ে। সুতরাং দূর্ঘটনাবশত কোনো সমুদ্র অতিক্রম এই দ্বীপগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃতভাবে খুব সাধারণ ঘটনা ছিল: হয়তো হাজার বছরে একবার হবার চেয়ে প্রতি শতাব্দীতে একবার। এবং ইগুয়ানারা একসময় সব দ্বীপেই তাদের বসতি গড়েছিল। এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাওয়া হয়তো যথেষ্ঠ কদাচিৎ কোনো ঘটনা ছিল, যা ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপের মধ্যে বিচ্ছিন্নতায় বিবর্তনীয় ভাবে পৃথক হবার খানিকটা সুযোগ দিয়েছিল। পরবর্তীতে অন্য কোনো দ্বীপ থেকে আসা ইগুয়ানাদের জিন দ্বারা দূষিত করণ, যথেষ্ঠ দূর্লভ ঘটনা যা ইগুয়ানাদের গ্রুপদের অনেক বেশী বিবর্তিত হতে সুযোগ দেয়, এবং পরে যখন তারা অবশেষে মিলিত হয় তখন তারা আর নিজেদের মধ্যে প্রজনন করতে পারেনা। ফলাফল হচ্ছে তিনটি ভিন্ন প্রজাতির স্থলবাসী বা ল্যাণ্ড ইগুয়ানা এখন গালাপাগোসে, যারা আর নিজেদের মধ্যে প্রজনন করতে পারেনা। কনোলোফাস প্যালিডাস (Conolophus pallidus) প্রজাতিটিকে পাওয়া যায় শুধুমাত্র সান্তা ফে দ্বীপে। কনোলোফাস সাবক্রিস্টাটাস (Conolophus subcristatus) বেশ কয়েকটি দ্বীপে বাস করে, ফার্নান্দিনা,ইসাবেলা ও সান্তা ক্রুজ( প্রতিটি দ্বীপের ইগুয়ানা জনগোষ্ঠী সম্ভবত ভিন্ন প্রজাতিতে রুপান্তরিত হবার পথে আছে)। কনোলোফাস মার্থি (Conolophus marthae) ইসাবেলা নামে বড় দ্বীপের সবচেয়ে উত্তরের পাঁচটি আগ্নেয়গিরির শৃঙ্খলে সীমাবদ্ধ।

এটি প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়ের উদ্রেক করে। আপনি মনে করতে পারবেন যে আমরা বলেছিল একটি হৃদ অথবা একটি মরুদ্যানকেও দ্বীপ হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে, যদিও সেগুলোর কোনোটাই পানি দ্বারা পরিবেষ্টিত কোনো ভূখণ্ড নয়? বেশ, এই ভাবে এটি প্রযোজ্য ইসাবেলা দ্বীপের পাঁচটি আগ্নেয়গিরির ক্ষেত্রে। এই চেইনের প্রতিটি আগ্নেয়গিরিকে ঘিরে রেখেছে বেশ উর্বর আর সমৃদ্ধ জঙ্গল, যেগুলো এক ধরনে মরুদ্যানের মত, পরের আগ্নেয়গিরি থেকে এটি পৃথক মধ্যবর্তী মরুভূমি দ্বারা। বেশী ভাগ গালাপাগোস দ্বীপে একটি মাত্র বড় আগ্নেয়গিরি আমরা দেখি, কিন্তু ইসাবেলায় আছে পাঁচটি। যদি কখনো সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ে ( হয়তো বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য) ইসাবেলা হতে পারে সমূদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন পাঁচটি দ্বীপ। এখন যেমন আছে, আপনি ভাবতে পারবেন যে প্রতিটি আগ্নেয়গিরি এক ধরনে দ্বীপের মধ্যে একটি দ্বীপ। এভাবে মনে হয় ল্যাণ্ড ইগুয়ানা ( অথবা জায়ান্ট টরটয়েস), যাদের উদ্ভিদ খেতে হবে তারা শুধু এই আগ্নেয়গিরি ঢালেই তা খুজে পায়।

ভৌগলিক কোনো প্রতিবন্ধকতা দ্বারা বিচ্ছিন্নতা, যা কখনো অতিক্রম করা যাবে, তবে খুব হরহামেশাই যা ঘটবে না, প্রায়শই বিবর্তিনীয় বিভাজনের সৃষ্টি করে ( আসলেই এটাকে ভৌগলিক কোনো বাথা হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, আরো কিছু সম্ভাবনা আছে, বিশেষ করে কীটপতঙ্গদের ক্ষেত্রে, কিন্তু সরলতার কারণে আমি সেই বিষয়ে আলোচনা করবো না এখানে)। এবং একবার যখন বিভাজিত জনগোষ্ঠী যথেষ্ট দূরে সরে যাবে তারা আর পরস্পরের সাথে প্রজনন করতে পারবে না। তখন ভৌগলিক সীমারেখার আর দরকার পড়ে না। দুটি প্রজাতি তাদের স্বতন্ত্র বিবর্তনীয় পথে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, আর কখনো পরস্পরের ডিএনএকে দূষিত না করে। মূলত এই ধরনের বিচ্ছিন্নতা দায়ী কোনো একটি গ্রহে সব নতুন প্রজাতির উদ্ভবের জন্য। এমনকি, যেমনটি আমরা দেখবো, পূর্বসূরিদের মূল বিচ্ছিন্নতা, ধরুন শামুকরা আমরা সহ সব মেরুদণ্ডী প্রাণির পূর্বসূরি থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল।

কোনো একটি পর্যায়ে গালাপাগোস এ ইগুয়ানাদের ইতিহাসে, একটি বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছিল, যা একটি অদ্ভুত প্রজাতি সৃষ্টি করেছিল। একটি দ্বীপে – আমরা জানি না কোনটিতে – একটি ল্যাণ্ড ইগুয়ানাদের স্থানীয় জনগোষ্ঠী পুরোপুরি ভাবে তাদের জীবনযাত্রা বদলে ফেলে। তারা আগ্নেয়গিরি ঢালে স্থলবাসী উদ্ভিদ খাবার বদলে, তারা সমুদ্র তীরে এসে সমূদ্র শৈবাল খাদ্য হিসাবে গ্রহন করেছিল। প্রাকৃতিক নির্বাচন সহায়তা করেছে সেই সব সদস্যদের যারা দক্ষ সাতারু, আজকের দিন অবধি তাদের উত্তরসূরিরা সমুদ্রের পানিতে ডুব দিয়ে পানির নীচে সমূদ্র শৈবাল খেতে অভ্যস্ত। তারা পরিচিত মেরিন ইগুয়ানা নামে, এবং ল্যাণ্ড ইগুয়ানার ব্যতিক্রম, তাদের গালাপাগোস ছাড়া আর কোথায় দেখা যায়না। তাদের বহু অদ্ভুত বৈশিষ্ট আছে যা তাদের সমুদ্রের জীবনে অভ্যস্ত হতে সুযোগ করে দিয়েছিল, আর এগুলোই তাদের আসলেই পৃথক করেছে গালাপাগোস ও পৃথিবী অন্য জায়গার ল্যাণ্ড ইগুয়ানা থেকে। তারা অবশ্যই ল্যাণ্ড ইগুয়ানা থেকে বিবর্তিত হয়েছিল কিন্তু তারা বিশেষভাবে গালাপাগোসের ল্যাণ্ড ইগুয়ানাদের নিকটাত্মীয় নয়। সুতরাং সম্ভাবনা আছে তারা হয়তো বিবর্তিত হয়েছে আরো আগের, বর্তমানে কোনো বিলুপ্ত জিনাস থেকে, যারা মূল ভূখণ্ড থেকে এই দ্বীপগুলোতে বসতি গড়েছিল বর্তমানের কনোলোফাসদের থেকে।

বিভিন্ন জাতের মেরিন ইগুয়ানা আছে, কিন্তু ভিন্ন প্রজাতির নয়, ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপে তাদের বাস। কোনো একদিন এই ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপের বর্ণের ইগুয়ানা সম্ভবত নিজেদের আবিষ্কার করবে এত দূরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে যাদের মেরিন ইগুয়ানা জিনাসের নতুন প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে। জায়ান্ট টরটয়েসদের সাথে কাহিনীটাও প্রায় একই, লাভা লিজার্ডরা, সেই অদ্ভুত উড্ডয়ন অক্ষম করমোরান্টরা, মকিংবার্ড, ফিঞ্চ এবং গালাপাগোসের বহু প্রাণি আর উদ্ভিদের সাথে। এবং একই ধরনের জিনিস ঘটে সারা পৃথিবী জুড়ে। গালাপাগোস শুধুমাত্র সুনির্দিষ্টভাবে সুস্পষ্ট উদহারণ। দ্বীপ ( হৃদ, মরুদ্যান এবং পর্বত সহ) নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করে। একটি নদীও তা করতে পারে। যদি কোনো প্রাণির পক্ষে নদী অতিক্রম যদি কঠিন হয়, নদীর দুই পারের জনগোষ্ঠীর জিন দূরে সরে যেতে পারে, ঠিক যেভাবে একটা ভাষা দুটি উপভাষায় বিচ্ছিন্ন হয়, যেটি আবার পরে আরো দুরে সরে গিয়ে দুটি ভাষা সৃষ্টি করে। পর্বতমালাও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে পারে একই দ্বায়িত্ব পালন করে, শুধুমাত্র দূরত্বও সেটি করতে পারে। স্পেনের ইদুরগুলো পুরো এশিয়া মহাদেশ অতিক্রম করে চিন অবধি পরস্পর প্রজনন করেছে এমন ইদুরদের শৃঙ্খল দিয়ে সংযুক্ত। কিন্তু অনেক সময় লাগে কোনো একটি জিন একটি ইদুর থেকে আরেকটি ইদুরের শরীরের মধ্যে দিয়ে্দেএতটা দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য, এই দূরত্ব পৃথক দ্বীপের মতই মনে করা যেতে পারে। এবং স্পেন ও চিনে ইদুরের বিবর্তন ভিন্ন ভিন্ন দিকে সরে যায়।

গালাপাগোসের ল্যাণ্ড ইগুয়ানাদের তিনটি প্রজাতির মাত্র কয়েক হাজার বছর পেয়েছে তাদের বিবর্তনের ধারায় পৃথক হবার জন্য। যথেষ্ট শত মিলিয়ন বছর অতিক্রান্ত হলে, কোনো একটি পূর্বসূরি প্রজাতির উত্তরসূরিরা যথেষ্ঠ পরিমান ভিন্ন হয় পরস্পরের থেকে যেমন, একটি তেলাপোকা থেকে কুমির যতটা ভিন্ন। বাস্তবিকভাবেই এটি আক্ষরিকভাবে সত্যি যে অনেকদিন আগে তেলাপোকার একটি প্র প্র প্র প্র ( অনেকগুলো প্র) পিতামহ ( এবং শামুক আর কাকড়ারা সহ আরো অনেক প্রাণি) যে কিনা মহা পূর্বসূরি (গ্রানসেস্টর শব্দটা ব্যবহার করি) কুমিরদের ( অন্য মেরুদণ্ডী প্রাণিরাও )। কিন্তু আপনাকে অনেক বছর পেছনে যেতে হবে, হয়তো এ বিলিয়ন বছরের বেশী, এররকম কোনো মহাপূর্বসূরি বা গ্রানসেস্টর খুজে বের করতে হলে আমাদের পেছনে যেতে হবে। আর এটি অনেক অনেক দিন আগে এমনকি আমাদের জন্য অনুমান করতে শুরু করা সেই মূল বাধাটি কি ছিল যা তাদের সেই শুরুতেই বিচ্ছিন্ন করেছিল। কিন্তু আমাদের জন্য সেটি অনেক বেশী প্রাচীন এমনকি অনুমান করতে শুরু করা যে কি ছিল সেই মূল প্রতিবন্ধকতা যা প্রথম তাদের বিচ্ছিন্ন করেছিল। সেটি যাই হোক না কেন, এটি অবশ্যই সমুদ্রে ছিল, কারণ সেই বহু প্রাচীন সময়ে কোনো প্রাণিরই বাস ছিলনা স্থলে।হয়তো আমাদের সেই মহাপূর্বসূরি বা গ্রা-সেস্টর শুধুমাত্র বাস করতে পারতো প্রবাল প্রাচীরে, এবং দুটি জনগোষ্ঠী তাদের নিজেদের আবিষ্কার করেছে এক জোড়া প্রবাল প্রাচীরে, যার মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করেছিল বসবাসের অযোগ্য গভীর সমূদ্র।

যেমন আমরা আগের অধ্যায়ে দেখেছিলাম, আপনাকে শুধুমাত্র ছয় মিলিয়ন বছর আগে যেতে হবে মানুষ আর শিম্পাঞ্জির সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম সাধারণ পূর্বসূরিকে খুঁজে বের করার জন্য। যা আমাদের জন্য যথেষ্ট সাম্প্রতিক অনুমান করা যে একটি সম্ভাব্য ভৌগলিক প্রতিবন্ধকতা হয়তো মূল বিভাজনের কারণ হয়েছিল। প্রস্তাব করা হয়েছে এটি আফ্রিকার গ্রেট রিফ্ট ভ্যালি, যেখানে মানব পূর্বসূরিরা বিবর্তিত হয়েছে পূর্ব দিতে, এবং শিম্পাঞ্জিরা ডান দিকে, পরে শিম্পাঞ্জিদের পূর্বসূরিদের বংশধারা বিভাজিত হয়েছে সাধারণ শিম্পাঞ্জি ও পিগমি শিম্পাঞ্জি বা বনোবো শাখায়। কঙ্গো নদীকেও প্রতিবন্ধক সীমা হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমনটি আমরা আগের অধ্যায়ে দেখেছি, জীবিত সব স্তন্যপায়ীদের ভাগ করে নেয়া এই মহাপূর্বসূরি বাস করতে প্রায় ১৮৫ মিলিয়ন বছর আগে। তারপর, এর উত্তরসূরিরা বিভাজিত এবং বিভাজিত এবং বিভাজিত হয়েছে বারবার, সৃষ্টি করে বহু হাজার স্তন্যপায়ী প্রজাতিদের যাদের আমরা বর্তমানে দেখি, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ২৩১টি মাংসাশী ( কুকুর, বেজী, ভালুক ইত্যাদি), ২০০০ প্রজাতির রোডেন্ট, ৮৮ প্রজাতি তিমি ও ডলফিন, ১৯৬ টি ক্লোভেন-হুফ বা ভাগ করা ক্ষুর বিশিষ্ট প্রাণি ( গরু, অ্যান্টেলোপ, শুকর, হরিন, ভেড়া), ঘোড়া পরিবারের ১৬ প্রজাতি (ঘোড়া, জেব্রা, টাপির, গশ্চার), ৮৭ প্রজাতির খরগোশ, ৯৭৭ প্রজাতির বাদুড়, ৬৮ প্রজাতির ক্যাঙ্গারু, ১৮ প্রজাতির এইপ (মানুষ সহ) এবং আরো অনেক অনেক প্রজাতি যারা ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে ( যার মধ্যে আছে বেশ কিছু বিলুপ্ত মানব প্রজাতি, যাদের আমরা কেবল জীবাশ্ম থেকে চিনি)।

মিশ্রণ, নির্বাচন এবং টিকে থাকা

আমি এই অধ্যায়টি শেষ করতে চাই সেই একই গল্পটি খানিকটা ভিন্ন ভাষায় বলে। আমি সংক্ষিপ্তভাবে জিন ফ্লো বা জিন প্রবাহের কথা উল্লেখ করেছিলাম। বিজ্ঞানীরা আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা বলেন যেটি হচ্ছে জিন পুল। এবং এর মানে কি সেটি আমি বিস্তারিত বলবো এখন। অবশ্যই আক্ষরিকভাবে জিনদের কোনো একটি পুল নেই। এই পুল শব্দটি প্রস্তাব করছে যেন কোনো তরল কিছু, যেখানে জিনরা হয়তো মিশ্রিত হয় নাড়াচাড়ার মাধ্যমে। কিন্তু জিনরা থাকে শুধুমাত্র জীবিত শরীরের কোষে। তাহলে জিন পুল বলে আসলে কি বোঝায়?

প্রতিটি প্রজন্মে, যৌন প্রজনন নিশ্চিৎ করে জিনগুলো যেন ভালোভাবে মিশ্রিত বা শাফল হয়। আপনার জন্ম হয়েছে আপনার বাবা ও মায়ের জিনের একটি অদলবদলের মিশ্রন নিয়ে, এর মানে আপনার চার জন দাদা, দাদী ও নানা, নানীর জিনের অদলবদল কৃত মিশ্রনে। বিষয়টি একইভাবে প্রযোজ্য জনগোষ্ঠীর সব সদস্যের জন্য বিবর্তনীয় সময়ের সুদীর্ঘ সময় ধরে, বহু হাজার বছর, বহু লক্ষ বছর। সেই সময় যৌন প্রজননের এই প্রক্রিয়া নিশ্চিৎ করে অদল বদল হয়ে যাওয়া জিনগুলো পুরো জনগোষ্ঠীতে খুব ভালোভাবে যেন রদবদল হয়, আসলে নাড়াচাড়া হয় এবং সেটাই অর্থবহ করে তোলে একটি বিশাল ঘুর্ণায়মান জিনের পুল হিসাবে বিষয়টি উল্লেখ করলেে – জিন পুল।

আপনার মনে আছে আমাদের দেয়া প্রজাতির সংজ্ঞাটি, এক গ্রুপ প্রাণি অথবা উদ্ভিদ যারা কেবল নিজেদের মধ্যে প্রজনন করতে পারে। এখন আপনি বুঝতে পারছেন কেন এই সংজ্ঞাটি গুরুত্বপূর্ণ। যদি দুটি প্রাণি একই জনগোষ্ঠীর মধ্যে একই প্রজাতির হয়ে থাকে, তার মানে তাদের জিনগুলো একই জিন পুলে মিশ্রিত হচ্ছে। যদি দুটি প্রাণি ভিন্ন প্রজাতির সদস্য হয়, তারা একই জিন পুলের সদস্য হতে পারেনা কারণ তাদের ডিএনএ যৌন প্রজননের সময় মিশ্রিত হতে পারে না, এমনকি যদি তারা একই দেশে বাস করে এবং প্রায়শই যদি তাদের দেখা হয়েও থাকে। যদি একই প্রজাতির জনগোষ্ঠী ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে, তাদের জিন পুলেরও সুযোগ থাকবে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার জন্য- এতই দূরে, যে একসময় তাদের যদি দেখাও হয়, তারা আর নিজেদের মধ্যে প্রজনন করতে পারবেনা। এখন তাদের জিনপুল মিশ্রনের সম্ভাবনার স্তর অতিক্রম করেছে এবং তারা রুপান্তরিত হয়ে ভিন্ন প্রজাতিতে এবং আরো দুরে তারা সরে যেতে পারে এমন একটি পর্যায় অবধি, তারা একে অপরের থেকে এতই আলাদা হবে যে যেমন মানুষরা আলাদা তেলাপোকা থেকে।

বিবর্তন মানে কোনো একটি জিন পুলে পরিবর্তন। জিন পুলে পরিবর্তন মানে যে কিছু জিনের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়, অন্যরা সংখ্যায় কমে যায়। জিন যেগুলো খুবই সাধারণ ছিল তারা দূর্লভ হয়ে পড়ে অথবা পুরোপুরিভাবে অপসারিত হয়। আর যে জিনগুলো একসময় দূর্লভ ছিল তারাই সাধারণ হয়ে পড়ে। এবং ফলাফল হচ্ছে কোনো প্রজাতির একজন বৈশিষ্ট্যসূচক সদস্যের যে আকার, আকৃতি অথবা রঙ আছে তা পরিবর্তিত হয়। এটি বিবর্তিত হয়, জিন পুলে জিনদের সংখ্যার পরিবর্তনের কারণে। সেটাই হচ্ছে বিবর্তন।

কেনই বা ভিন্ন ভিন্ন জিনের সংখ্যা পরিবর্তিত হয় প্রজন্মান্তরে ? বেশ, আপনি হয়তো বলবেন যদি তার না পরিবর্তিত হয় সেটাই বিস্ময়কর হবে, বিশেষ করে সময়ের এই অকল্পনীয় বিশালতায়। বহু শতাব্দী ধরে কিভাবে ভাষা পরিবর্তিত হয় সেটি ভাবুন। ইংরেজী ভাষার কিছু শব্দ যেমন দি (Thee) বা দাউ (Thou), জুণ্ডস (zounds) আর আভাস্ট (Avast), এবং stap me vitals এর মত অভিব্যক্তিগুলো কম বেশী ইংরেজী ভাষা থেকে পরিত্যাক্ত হয়েছে। অন্যদিকে I was like (অর্থ আমি বলেছিলাম বা I said) বাক্যটি এমনকি ২০ বছর আগের মত সাম্প্রতিক সময়েও অবোধ্য মনে হতো, যা এখন হরহামেশাই ব্যবহার হচ্ছে। তেমনি যেমন কুল (Cool) কোনো কিছু স্বীকৃতির একটি শব্দ হিসাবে।

আপাতত এই অধ্যায়ে, আমার দরকার হয়নি বেশী গভীরে প্রবেশ করার শুধুমাত্র সেই ধারণাটি ছাড়া যে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের জিন পুল বিচ্ছিন্ন হতে পারে, ভাষার মত। কিন্তু আসলেই প্রজাতির ক্ষেত্রে, এখানে দূরে সরে যাওয়া ছাড়াও আরো কিছু ঘটে। এই আরো কিছু হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন, চুড়ান্তভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া যা চার্লস ডারউইনের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কার। প্রাকৃতিক নির্বাচন ছাড়াও, আমরা আশা করতে পারি যে জিন পুল যারা ঘটনাচক্রে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তার ক্রমেই দূরে যায়। কিন্তু তারা দূরে সরে যায় বরং উদ্দেশ্যহীন একটি উপায়ে। প্রাকৃতিক নির্বাচন বিবর্তনকে একটি উদ্দেশ্যমূলক দিকে পরিচালিত করে: মূলত টিকে থাকা ও জিন হস্তান্তরের সফলতার দিকে। যে জিনগুলো জিন পুলে টিকে থাকে তারা হচ্ছে সেই জিনগুলো যারা টিকে থাকা ও প্রজনন সফল হবার জন্য উপযোগি। আর কোন জিনিসটি একটি জিনকে টিকে থাকতে সফল করে? এটি অন্য জিনদের সহায়তা করে শরীর নির্মাণ করার জন্য যারা টিকে থাকা ও প্রজনন সফল হবার ক্ষেত্রে দক্ষ: শরীর যারা যথেষ্ঠ দীর্ঘ সময় টিকে থাকে, যা তাদের সেটি করতে সহায়তা করে, সেই জিনগুলো পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর করে যেগুলো তাদের দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে সহায়তা করেছে।

এবং ঠিক কিভাবে তারা সেটি করে এটি প্রজাতি ভেদে ভিন্ন। জিন যেগুলো পাখি অথবা কোনো বাদুড়ের শরীরে বাস করে তার ডানা তৈরীতে সহায়তা করে। জিন যা মোলদের শরীরে বাস করে তা তাদের সাহায্য করে কোদালের মত শক্তিশালী সামনের হাত বানানোর জন্য। জিন যা টিকে থাকে সিংহের শরীরে, সেটি তাদের সাহায্য করে দ্রুত দৌড়ানোর পা এবং ধারালো নোখ আর দাঁত বানাতে সহায়তা করে। জিন যা টিকে থাকো অ্যান্টেলোপদের শরীরে তাদের জন্য দ্রুত দৌড়ানোর উপযোগি পা, তীক্ষ্ম শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। লিফ-ইনস্কেট দের শরীরে যে জিনগুলো টিকে থাকে পাতা থেকে আলাদা করা কঠিন এমন শরীর তৈরী করে। খুটি নাটি বিষয়গুলো যতই ভিন্ন হোক না কেন, প্রতিটি প্রজাতিতে এই খেলার নাম হচ্ছে জিন পুলে জিনের টিকে থাকা। এরপরে যখনই আপনি কোনো প্রাণি দেখবেন – যে কোনো প্রাণি- অথবা কোনো উদ্ভিদ, ভালো করে লক্ষ্য করবেন এবং এবং নিজেকে বলবেন যে আমি তাকিয়ে আছে একটি জটিল যন্ত্রের দিকে যার কাজ এটিকে তৈরী করা জিনগুলো পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর করা। আমি তাকিয়ে আছি জিনদের সারভাইভাল মেশিন বা টিকে থাকার যন্ত্রের দিকে।

এর পরে যখন আপনি আয়নার দিকে তাকাবেন, শুধু ভাববেন যে, আপনিও ঠিক তাই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ