বিচ্ছিন্ন জঙ্গল দলসমূহ (সমাজ ও সংস্কৃতি) || সব্যসাচী সরকার

আজকের উন্নত প্রযুক্তির যুগে, কল্পনা করা কঠিন যে বিশ্বের কোন রহস্য বাকি আছে| মনে হয় যেন প্রতিটি গাছকেই গবেষণা করা হয়েছে, প্রত্যেক প্রাণীর নামকরণ করা হয়েছে এবং প্রতিটা পর্বত আরোহণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, আমাজনের গোপন গভীরতা, পর্বতমালার শিখর, সাইবেরিয়ার বন্য জন্তুগুলো বা হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা ও জঙ্গল  গোষ্ঠীগুলি(ট্রাইবস)এখনও আধুনিক বিশ্বের থেকে আলাদা এবং বিচ্ছিন্ন।

আধুনিক বিশ্ব থেকে এখনো বিচ্ছিন্ন অবশিষ্ট এই জঙ্গল গোষ্ঠীগুলো শত শত বছর ধরে বসবাস করে আসছে, বন্যতাকে জড়িয়ে আধুনিক "সুবিধা" প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের পরিবেশে যে কোনও পার্থক্য অনুধাবন করা সত্যি এক রোমাঞ্চকর বিষয়। এরকম দশটি জঙ্গল গোষ্ঠী যারা এখনো আজকের আধুনিকতাকে পরিহার করে তাদের আধিপত্য বজায় রেখে চলেছে।

সেন্টিনেলিজ প্রজন্ম :-

আমাদের তালিকার প্রথম জঙ্গল গোষ্ঠী হল একটি ভারতীয় উপজাতি সেন্টিনেলিজ (Sentinelese)।বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরের মাঝামাঝি একটি ছোট ভারতীয় দ্বীপ যা উত্তর সেনানিলে নামে পরিচিত। গত ষাট হাজার বছর ধরে, এটি একটি জঙ্গল গোষ্ঠীর বাড়ি যারা বারবার বিশ্বের বাইরের সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এরা এখনো একটি "শিকারী/সংগ্রহকারী" জীবনধারায় বাস করে।এই উপজাতির সাম্প্রতিক বাইরের যোগাযোগ বলতে ছিল ২০০৬ সাল, যখন দুই জেলে ওই দ্বীপে অবতরণ করে। সেন্টিনেলিজ  জেলেদ্বয়কে হত্যা করে এবং তারপর একটি হেলিকপ্টার যেটা জেলেদের সন্ধান করতে পাঠানো হয়েছিল, তারা তীর দ্বারা আক্রমণ করে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। সম্ভবত এই শত্রুতায় তাদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন উপজাতি গোষ্ঠীর একটি বলে মনে করা হয়।

২. কোরোওয় জাতি :-

ইন্দোনেশিয়ার গিনির ঘন গ্রীষ্মমন্ডলীয় বনভূমি ও পর্বতমালায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যে জঙ্গল উপজাতি তারা কোরোওয় (Korowai) নামে পরিচিত। বাইরের বিশ্বের সাথে তাদের প্রথম যোগাযোগ ১৯৭০ সালে, যখন মিশনারিদের একটি দল কাঠের বাড়িতে বাস করে এবং পাথরের সরঞ্জাম ব্যবহার করে এমন একটি জনগোষ্ঠী আবিষ্কার করে। আজ তার সামান্যই পরিবর্তিত হয়েছে। কোরোওয়ে উপজাতির গ্রাম এত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যে তারা একে অপরের সাথে প্রায় কোনও যোগাযোগ রাখে না, এরা অপর জনগোষ্ঠীদের একা বাঁচতে দেওয়াই বিশ্বাসী। কোরোওয়ে দীর্ঘদিন যাবত এই ধারনাই বিশ্বাসী যে, কোন ঐতিহ্যগত পরিবর্তনের ফলে এমন একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হবে যা পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে, তাই তারা নিজের ঐতিহ্য নিয়ে এখনো একা থাকে।

অপ্রচলিত বিশ্বাসে বিশ্বাসীগণ :-

উত্তর রাশিয়ার বিস্তীর্ণ জঙ্গলে জনবসতি সীমিত, কিন্তু এটি একটি বিচ্ছিন্ন জনসংখ্যার বাড়ী যারা Old Believers নামে পরিচিত। ১৭শতকের দিকে একটি ছোট দল রাশিয়ান চার্চ থেকে বিছিন্ন হয় এবং একটি পৃথক সমাজ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম এদের অনুসন্ধান পাওয়া যায় ১৯৭৮ সালে, যখন হেলিকপ্টারে ভূতত্ত্ববিদরা সাইবেরিয়ার দূরবর্তী বনভূমিতে একটি ছোট ঘর দেখেছিলেন। তারা একটি পরিবার আবিষ্কার করেছিলেন যারা নির্জনে বসবাস করছিল এবং পরনে ব্যালকাপের বস্তা ছাড়া কিছুই ছিল না। তারা হাতে খোদাইকৃত পাত্রে খাবার খেয়েছিল, কাঠের মধ্যে খোরাকি ক্ষেত হতে সংগ্রহ করছিলো। এই পরিবারটি অপ্রচলিত বিশ্বাসে বিশ্বাসীদের সাথে জড়িত অনেক গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম।

৪. মাশকো পাইরো উপজাতি :-


সাম্প্রতিক কালে জনপ্রিয় পেরুভিয়ান নদীর পাশে একটি আদিম অ্যামাজন রেইনফরেস্ট উপজাতির সদস্যদের দেখা যাই, যাদের ধাতব রান্নার পাত্র এবং রামদার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ লক্ষণীয়। তারা মাশকো-পাইরো (Mashco-Piro) উপজাতি গোষ্ঠীর সদস্য,  যারা শত শত বছর ধরে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করে আসছে। পেরুর সরকার প্রাথমিকভাবে মাশকো-পাইরো গোষ্ঠীকে বাইরের জগতের থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, যাতে কৌতুহলপ্রিয় নৃতাত্ত্বিক বা লোভী ডেভেলপাররা এই এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে, এবং এদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষিত হয়। সম্প্রতি, স্থানীয় পর্যটন সংস্থাগুলি ভ্রমণকারীদের "মানব সাফারি" তে যাওয়ার সুযোগ দিতে শুরু করেছে, যেখানে তারা আদিম উপজাতির সাথে ঘনিষ্ঠ ও পরিচিত হতে পারে।

পিনটিউপি অ্যাবারিজিনাল উপজাতি :-

যখন ১৭৮৮ সালে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল তখন ব্রিটিশরা বহু আদিবাসী হত্যা করে, যারা বৃহৎ উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়েছিল। আধুনিক যুগে, এই গোষ্ঠীগুলির অধিকাংশই "সাদা মানুষের" সাথে পরিচিত। কিন্তু ১৯৮৪ সালে যাযাবর রাখালজাতি পিনটিউ জনগোষ্ঠী যখন প্রথমবার একটি সাদা ব্যক্তিকে দেখেছিলেন; তখন তাদের অনুমান ছিল তাদের সাক্ষাৎ একটি শয়তানের আত্মার সাথে হয়েছে। কয়েক বছর আগে পাশ্চাত্যদেশীয় আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের সাথে তাদের সম্মুখ যুদ্ধও হয়েছিল। এ সময় পিনটিউপদের কাছে ছিল বড় বর্শা এবং তাদের পরনে ছিল মানুষের চুলের তৈরি বেল্ট। পাশ্চাত্য অস্ট্রেলিয়ানরা বন্দুক দিয়ে তাদের সাবধান করার উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়ে, আর পিনটিউ উপজাতি ভয় পেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

৬. সুরমা উপজাতি :-

ইথিওপিয়াতে গবাদি পশুপালকদের একটি যাযাবর গোষ্ঠী রয়েছে যারা বাইরের জগতের সাথে সমস্ত যোগাযোগ এড়িয়ে চলত। তারা ইউরোপীয় উপনিবেশ বা তাদের চারপাশে চলতে থাকা যুদ্ধের ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখায় নি। ১৯৮০র দশকে বহির্জগতের সাথে সুরমাদের প্রথমবারের মতো যোগাযোগ হয়। তখন এক শ্বেতাঙ্গ রাশিয়ান ডাক্তারকে দেখে সুরমারা মনে করেছিল, তারা যেন চলমান মৃতদেহ কে দেখছে। এদের পুরুষরা হিংস্র লাঠি যুদ্ধের জন্য বিখ্যাত। তাছাড়াও তাদের একটি সুপরিচিত ঐতিহ্য হল তাদের বিবাহে আগ্রহী অল্পবয়সী নারীরা নিচের ঠোঁটের মধ্যে মাটির তৈরি প্লেট ঢুকিয়ে রাখে।

ভিয়েতনামের রাক উপজাতি :-

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ভয়ানক আমেরিকান বোমা হামলার পর উত্তর ভিয়েতনামের সৈন্যদের একটি দল রাক উপজাতির (Ruc Tribes) একটি দলের সাথে জঙ্গলে সম্মুখীন হয়েছিল।এরা বিচ্ছিন্নভাবে পূর্ব Quang Binh প্রদেশের মধ্যে বাস করত। সেই সময় থেকেই, ভিয়েতনাম সরকার বারবার রাক গোষ্ঠীদের প্রচলিত বিশ্বের সাথে সংযুক্ত করার প্রচেষ্টা করে, কিন্তু রাক গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে। রাক গোত্রের কিছু সদস্য এখনও জঙ্গলের গুহার মধ্যে বসবাস করে, এমনকি এখনও কিছু গোপন গুহা রয়েছে যেগুলো তাদের প্রবীণ ব্যাক্তিরাই জানেন।

পাপুয়া নিউ গিনি উপজাতি :-

যদি এমন কোন ভয় থাকে যা নতুন জগতের অনুসন্ধানকে বিরত করতে পারে, সেটি জঙ্গলের মধ্যে নরখাদকের হুমকি। আদিম উপজাতি Papua New Guinea Tribes পাপুয়া নিউ গিনির সমুদ্রের বনভূমির মধ্যে এখনও  বসবাস করে, যারা আধুনিক বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে বিরত থাকে । পাপুয়া নিউ গিনিতে অনুসন্ধান অভিযান চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু এগুলির কঠিন ভূখণ্ড, বর্ষাকালের বৃষ্টি এবং মাঝে মাঝে তারা যে গোষ্ঠীগুলির খোঁজ করছে তাদের আগ্রাসন দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে বিখ্যাত অনুসন্ধান এর উদাহরণ ছিল আমেরিকান ধনকুবের মাইকেল রকফেলার-এর নেতৃত্বে একটি অভিযান, যা তাঁর অন্তর্ধানের সঙ্গে শেষ হয়ে যায় এবং কথিত আছে আদিম উপজাতির নরখাদকদের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়।

আন্দামানের ভারতীয় বংশোদ্ভূত গোষ্ঠী :-

এটি আরেকটি ভারতীয় উপজাতি যারা এখনও আধুনিক উন্নয়ন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করে। ভারতীয় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে, এক সময়ে প্রায় ৭,০০০ Andamanese Indian Tribe মানুষ বিদ্যমান ছিল। ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে বাসিন্দার আগমনের সাথে সাথেএই দেশীয় গোষ্ঠীর অঞ্চল হারিয়ে যাওয়া এবং মহামারীর ফলে তারা সংখ্যাই কমতে শুরু করে। আজ ঐ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ৪০০জন মানুষ অবশিষ্ট রয়েছে,  তারা তাদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সশস্ত্র, তীরন্দাজ, বীর যোদ্ধা এবং "শিকারী/সংগ্রহকারী" হিসাবে বসবাস করে। অদ্ভুতভাবে, তারা কয়েকটি পরিচিত গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম ছিল, যারা এখনো বিংশ শতকে অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে অজ্ঞাত। 

১০এরিয়োর টোটোবিজোসড গোষ্ঠী :-

প্যারাগুয়ের গভীর বনের মধ্যে Ayoreo-Totobiegosode Tribe নামে একটি জঙ্গল উপজাতি রয়েছে, তারা বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগহীন আমেরিকার দক্ষিণাংশের নেটিভ ইন্ডিয়ানদের শেষ গ্রুপ। ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকে যখন নিউ টেরাউস মিশন এই দেশীয় গোত্রগুলির সাথে জোরপূর্বক যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল তখন বিতর্ক হয়েছিল, উপজাতির কিছু সদস্যদের মৃত্যুর পর জঙ্গলের কিছু সদস্যকে জঙ্গলের বাইরে টেনে আনা হয়। এই জঙ্গলের উপজাতিদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ হুমকি তাদের ভূমি দখল এবং ধ্বংস, যদিও সরকার তাদের সুরক্ষা দেয়, তবুও গবাদিপশু রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য বনভূমি এখনও অবৈধভাবে সাফ করা হচ্ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ