জিহ্বা || আশানুর রহমান খান


অবশেষে দেশ আজ কোহলীর জিহ্বা বাহির করা নিয়ে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেল।

গ্রামে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, মরলাম চাচীর ঘিঁরায় বেঁধে। বাঙ্গালীর হয়েছে এখন সেই দশা।

১৬ ই এপ্রিল ২০১৪, আজ থেকে তিন বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩২৬ জন যাত্রী নিয়ে ফেরি সেওল ডুবে যায়। যাত্রীদের সবাই ছিল একটি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক। মাছধরা জেলেরা মাত্র ২২ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে পারলেও, বাঁকিদের সলিল সমাধি হয়।

শুধু দক্ষিণ কোরিয়া নয়, সারাবিশ্বে এ নিয়ে নিরব নিস্তব্ধতা নেমে আসে। মাত্র দশ দিনের মাথায় সকল দায়ভাড় নিয়ে পদত্যাগ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। আচ্ছা, আপনারা কেউ বলতে পারবেন, একটা ফেরি ডোবার সাথে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কী সম্পর্ক?

দেশটির জনগণ তাতেও থেমে থাকেনি। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে অনলাইন ও অফলাইনে। তখন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা চলছিল। দক্ষিন কোরিয়া এশিয়ার একটা বড়মাপের প্রতিনিধি সেই টুর্নামেন্টে।

উপায়হীন হয়ে সকল পার্লামেন্ট সদস্য মিলে তাদের রাষ্ট্রপতির ইম্পিচমেন্টের ব্যবস্থা করেন। এবং তা শেষপর্যন্ত আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালত ফেরি দুর্ঘটনায় দূর্নীতির ধোঁয়া তুলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। যাবতজীবন জেল হয় ফেরির ক্যাপ্টেনের, বিভিন্ন মেয়াদে জেল হয় আরও ২৬ জন কর্মকর্তার।

আচ্ছা, রাষ্ট্রপতি একটা দেশের ফেরি ডোবায় কী দূর্নীতি করতে পারে বলে আপনাদের মনে হয়?

১৯৫৩ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে দেশটির রেলমন্ত্রী নিয়োগ দেন। ১৯৫৬ সালের শুরুর দিকে আসাম ও দিল্লি এক্সপ্রেসের মধ্যে রেল দুর্ঘটনায় প্রায় দেড়শত লোকের প্রাণহানী ঘটে।

লাল বাহাদুর শাস্ত্রী সকল দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করেন। কিন্তু নেহেরু তা গ্রহণ করেন নাই। ফলে মন্ত্রীত্ব টিকে যায় শাস্ত্রীর।

সেই বছরেরই শেষের দিকে পুনরায় এক ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় চারশত জন মানুষের। এইবার পদত্যাগ পত্র জমা দিলে তা গ্রহণ করেন নেহেরু। নেহেরু হয়তো তা আগেই গ্রহণ করতে পারতেন। আমাদের দেশের সাংসদের মতো বলেন নাই, রেল দুর্ঘটনা দেয় আল্লাহ। আমার কী করার আছে!

তেমনই ১৯৯৯ সালের এক রেল দুর্ঘটনার দায় স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান রেলমন্ত্রী নিতেশ কুমার।

সারা পৃথিবীতে এই রকম হাজারটা ঘটনা আছে, যেখানে কোনো দুর্ঘটনা বা অব্যবস্থাপনার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে সরে যেতে দেখা যায়। আপনি চাইলে গুগুল করে তা জেনে নিতে পারেন।

এখন কথা হচ্ছে, একটা ঘটনা বা দুর্ঘটনার সাথে মন্ত্রীর সরে যাওয়ার কী সম্পর্ক? খুব সোজা, একেই বলে কর্তব্য কাজে অবহেলা। সুপিরিয়র রেস্পনসিবিলিটি।

গতকাল খবরের কাগজে দেখলাম, চাউলের মজুদ থাকার কথা ছিল ৮ লাখ টন, কিন্তু সেখানে মজুদ আছে ৭ হাজার ৮ শত টন। খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, মিল মালিকরা তার কথা শুনছেন না। যাদেরকে তিনি চাউল কেনার জন্য অনুমিত পত্র দিয়েছিলেন। মিল মালিকরা মন্ত্রীরর কথা শুনবে না, শুনবে চাচীর কথা। কারণ, ঘেরা তো চাচীর।

সরকারীভাবে ধান কেনার অনুমতিপত্র কারা পায় একটু ভেবে দেখবেন? এবং তারা যদি সেই ধান কিনে চাউল বানায়ে তা সরকারী গোডাউনে জমা না দেয় তবে সেই দায় কী জনগণের? এমন অপরাধের জন্য জনগণের উচিত গলায় ফাঁসি নিয়ে মরে যাওয়া। তবুও মন্ত্রীর মন্ত্রীত্ব টিকে থাক, ফুলে ফেঁপে উঠুক আওয়ামী মিল মালিকদের একাউন্ট।

পাহাড়ে দেড়শত জনের লাশ, খাবার নাই, সারাদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন, কেরোসিনের বিশাল লাইন। তাদের এই মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী? বা কার যে এমন স্বপ্ন ছিল একদিন পাহাড়ীরা পাহাড় ধসে অবরুদ্ধ হয়ে মরবে। মরছেও তাই।

না, আমি বলছি না আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী বা জনগণের নেত্রীকে তার জন্য পদত্যাগ করতে হবে? তিনি চাইলে ইংল্যান্ড থেকে এই সুযোগে আমেরিকাও ঘুরে আসতে পারেন। পাহাড়ে এমন শান্তি স্থাপনের জন্য তিনি একটা নোবেল আশা করতেই পারেন।

আমি বলছি না, এই হত্যার দায়ভাড় নিয়ে ভুমিমন্ত্রী আজই সরে যাক? তার এখনও অনেক কিছু খাওয়ার বাঁকি আছে যে। পাহাড় খাবে, বড় বড় অট্টালিকা খাবে, পাহাড়ীদের জীবন খাবে। আরও কতো কী!

তবে আমি এ বলতে চাই, ২০১৪ সালে কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়াও বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলত ইংল্যান্ড গিয়েছিল, কিন্তু তাদের দেশের মানুষ কারো জিহ্বা বাহির করা নিয়ে দুইভাগে ভাগ হয় নাই। তাদের ঠিকই মনে ছিল ৩০৪ শিশু বিনা অপরাধে নিহত। হয়তো ফুটবলটা তারা একটু কমই বোঝে!

দেশ স্বাধীনের মাত্র নয় বছরের মাথায় রেল দুর্ঘটনার পর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন নির্লজ্জের মতো ক্ষমতা আঁকড়ে না থেকে জনগণের কাতারে গিয়ে দাঁড়ানো উত্তম। আর সেই পথ ধরে নিতেশও সরে যায়।

কারণ, ঐ ট্রেনে একদিন তাদেরকেও যাত্রী বেশে উঠতে হতে পারে যে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ