৫৭ ধারা ও কিছু প্রশ্ন



ব্লাসফেমি আইন মধ্যযুগের ইউরোপে প্রবলভাবে চালু ছিল। যাজকেরাই ছিল সর্বেসর্বা। তাই নিজের স্বার্থে আঘাত লাগার কথা চিন্তা এলেই অধার্মিক ক্রিয়াকলাপ তকমা দিয়ে বিরোধীদের যা কিছু করা ফেলা যেত। গ্যালিলিও থেকে ব্রুনোর মত মানুষেরা যেখানে ছাড় পায়নি, সেই সময়ের ইউরোপে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা ছিল সহজেই অনুমেয়। ইউরোপে মধ্যযুগকে অন্ধকারময় যুগ হিসাবে ধরা হয়। আর সেই অন্ধকার যুগের আইনগুলোকে নিয়ে আমরা মধ্যযুগের ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছি। টাইম মেশিন ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মানুষেরা তৈরি করে ফেলেছে। ধর্মের যন্ত্রে চাপলেই হল, অতীতের যে কোন যুগে ফিরে যাওয়া যায়।

বাংলাদেশের ২০১৩-য় সংশোধিত ৫৭ ধারাটিতে কী বলা হয়েছে ? এই আইনের বক্তব্য ----

"If any person deliberately publishes any material in electronic form that causes to deteriorate law and order, prejudice the image of the state or person or causes to hurt religious belief, the offender will be punished for maximum 14 years and minimum 7 years imprisonment. It also suggested that the crime is non-bailable."

যার বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘কোনও ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মাপকাঠি কী? আমি যদি বললাম গৌতম বুদ্ধ নাস্তিক ছিলেন, তিনি ঈশ্বর সাধনার বিরোধিতা করেছিলেন। এই কথা বলার জন্য কি বর্তমানের তন্ত্রাচার, অজাচারে জড়িত বৌদ্ধরা আমার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলা ঠুকবে ! যদি হিন্দু পুরাণ থেকে উদ্ধৃত করে বলি ব্রহ্মা নিজ কন্যাকে দেখে কামলিপ্সু হয়ে পড়েছিলেন। তাও কি হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবে! কেউ যদি লিখল, হজরত মহম্মদ বৃদ্ধ বয়সে ছয় বছরের আয়েষাকে বিবাহ করেছিলেন তাতেও কি মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হবে? বাংলাদেশে কেউ যদি মামলা করে মাননীয়া শেখ হাসিনা বোরখায় ঢেকে থাকেন না বলে তার ইসলাম অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাও কি বাংলাদেশের ৫৭ ধারার আওতায় পড়বে?

সবথেকে ভালো বলেছেন শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ।  তিনি বলেছেন, "এটি একেবারেই একটি আপেক্ষিক বিষয়। কার কোন কথায় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে সেটা কেউ নির্দিষ্ট করে দিতে পারবে না। ভালবাসা এবং সহনশীলতার অভাবের কারণেই এসব ঘটছে। ধৈর্য্যশক্তি ও সহনশীলতা উভয়ের পক্ষ থেকে দেখালেই কেবল সহিংসতার পথ সমাজ থেকে পরিহার হবে। তবে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে, সেদিকে সবারই লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ বাংলাদেশে সব ধর্মের লোকের বাস করে।"

সত্যি তো। মুসলিমরা নিরাকারের উপাসক। এবার তারা যদি ভাবল সংখ্যালঘু হিন্দুদের মূর্তিগুলো তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে এবং এর বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ দায়ের করল, তাহলে কি ধরে ধরে হিন্দুদের জেলে ঢোকানো হবে। আবার হিন্দুদের কাছে গোরু ভগবান স্বরূপ। তারা যদি মুসলিমদের গোমাংস ভক্ষণের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে, তাও কি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বলে বিবেচিত হবে?

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় শুধু নয় বাংলাদেশ দন্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারা অব্দি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণে শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা আইনে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যায়িত নেই।
এই আইনের খসড়া ২০০৬ সালে বিএনপি সরকার প্রস্তাব করে। আর ২০১৩ সালে আওয়ামি লিগ সরকার এই আইনকে বৈধতা দেয়। বিরুদ্ধ মতকে রুখতে এমন আইন বেশ কার্যকরী। তাই দুই প্রধান দলই এই আইনটি নিয়ে বেশ উৎসাহী ছিলেন। ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিকদের জেলে ঢোকানো এখন জলভাত হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেছেন, ‘‘ধর্মীয় অনুভূতি কোনও সস্তা বিষয় নয় যে কারও কথাতে সেখানে আঘাত লাগবে। আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কনসেপ্টটাই ‘ব্যাকওয়ার্ড কনসেপশন’ বলে মনে হয় আমার। একটি গ্রুপই থাকে যারা কনফ্লিক্ট অথবা অরাজকতার জন্য বাহানা খোঁজে। তারা মুসলিম, হিন্দু কিংবা সেক্যুলার সব দেশে গিয়েই একই কাজ করবে, আমাদের দেশেও সেই একই কাজ হচ্ছে, এটা কোনও ইস্যুই না।’’

তিনি আরো বলেছেন, ‘আমি তো বলবো প্রথম এই অনুভূতিতে আঘাত করেছেন শফী হুজুর। তিনি নারীদের নিয়ে অশ্লীল কথা প্রথমে বলে কেবল ধর্মীয় নয়, সামাজিক, নৈতিক, মানসিক সব অনুভূতিতে তিনিই প্রথম আঘাত করেছেন। নারী মানেই ভোগের পণ্য এটা ইসলাম বলে না, অথচ তিনি নারীদের নিয়ে চূড়ান্ত রকমের অশালীন মন্তব্য করেছেন-তখন ধর্মীয় অনুভূতি কোথায় থাকে। এইসব অপব্যাখ্যাকারীরাই ইসলামের অনিষ্ট করছেন এবং এরাই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করছে। তারাই আবার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার কথা বলেন।’ 

সত্যি তো শফি হুজুর শুধু ধর্মীয় নয় মানব অনুভূতিতেও আঘাত করে চলেছেন। তিনি এখনো বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ান কি করে? না এই আইন শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও নাস্তিকদের দমন করার জন্য !

এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বার কাউন্সিলের ফাইনান্স কমিটির চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম। তাঁর কথায়, "কোনওভাবেই ধর্মীয় অনুভুতি সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। একজন মানুষ যদি সে সিঙ্গেলও হোন তারও একটি ধর্মীয় অনুভুতি থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বাংলাদেশে তাদেরই কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আসতে পারে, সংখ্যালঘিষ্ঠের ধর্মীয় অনুভূতি নেই, এটা ভাবার অবকাশ নেই। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে— রাষ্ট্রের কাছে ধর্মভিত্তিক কাউকে কোনও বিশেষ গোষ্ঠীকে আলাদা করার সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় না। সংবিধানে বলা হয়েছে, সব ধর্মের নাগরিকরা সমঅধিকার ভোগ করবে। সেখানে, কোনও নৃ-গোষ্ঠীর অবহেলিত মানুষটিও যদি হন, তারও সমান ধর্মীয় অনুভূতি রয়েছে এবং তিনিও আইনের চোখে সমান।"

শুধু যে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে তা নয়। গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমও ৫৭-র আইনে বলি হচ্ছে। গত চার মাসের মধ্যে তিনজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনের ধারায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে।

ধার্মিকদের ঈশ্বর বা আল্লাহ কি এতই দুর্বল! সাধারণ মানুষের সামান্য প্রশ্ন বা শব্দে ওনার সম্মানহানি হয় ! যে ঈশ্বর জগতের রক্ষাকর্তা, তিনি সামান্য বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়ে পড়েন ! তাহলে তো ঈশ্বরের ক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করবে।

জগতের সবকিছুই ঘটে ঈশ্বরের ইচ্ছেয়। তাহলে তো তথাকথিত 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতও' ঈশ্বর বা আল্লাহের কোন গূঢ় ইচ্ছের প্রতিধ্বনি ভাবতে আপত্তি কোথায় ?

না ধার্মিকেরা ঈশ্বর/আল্লাহ/গড/ধর্মীয় বিশ্বাসীদের সৃষ্টিকর্তার থেকেও নিজেকে ক্ষমতাবান ভাবতে শুরু করেছে। আল্লাহ বা ঈশ্বরের বিচারের অপেক্ষা না করে নিজেরাই বিচারদন্ড নিয়ে আঘাত করা শুরু করেছে।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বিষয়টি সরকারের মাথাতেও ঢোকে না, তবু আইন করতে দোষ কী? এটাই গণতন্ত্রের মহিমা। গরিষ্ঠতায় যা কিছু করে ফেলা যায়। মানুষকে দেখা হয় ভোট গণনার অঙ্কে। মানবিক মূল্যবোধের মাপকাঠি শূন্য।

তথ্যসূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন
              ঢাকা ট্রিবিউন
              প্রথম আলো

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ